চীনা নববর্ষে একটি বিষয় বেশ নজর কাড়ল। ঐতিহ্যের চীনা নতুন পোশাকের পাশাপাশি বড়রা ছোটদের লাল খামে অর্থ ভরে হাতে তুলে দিয়ে আশীর্বাদ করেন। আর নববর্ষের প্রথম প্রহরে সবাই সমস্বরে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘শিন নিয়ান খোয়াই লা, কোয়া নিয়ান হাও’
বেইজিংয়ের হুথং এলাকা নানলু কু শিয়াংয়ে আসার আগ পর্যন্ত চীনা নববর্ষ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছিল না। বাংলা নববর্ষ কিংবা ইংরেজি নববর্ষের যে ধরন, চীনা নববর্ষও তেমন কি না জানা ছিল না।
আমাদের রাজধানীর মতো বেইজিংও পুরনো ও নতুনে বিভক্ত। বেইজিংয়ের হুথং ও পুরান ঢাকা চরিত্রে একই। বাংলাদেশের আবহমান সংস্কৃতির অনেক কিছু যেমন নতুন ঢাকায় টের পাওয়া যায় না, একইভাবে ঐতিহ্যের চীনা সংস্কৃতির অনেক কিছু হুথং এলাকায় না এলে টের পাওয়া যায় না।
বিশ্বজুড়ে ইংরেজি নববর্ষ যেভাবে পালিত হয়, চীনে তেমনটি দেখা যায় না।
চীনারা নিজেদের নববর্ষ ঘটা করে পালন করে। চীনা নববর্ষ ‘বসন্ত উৎসব’ কিংবা ‘চান্দ্র নববর্ষ’ নামেও পরিচিত। তবে চীনা মানুষের সঙ্গে অর্থাৎ চীনা পরিবারের সঙ্গে জড়িয়ে না গেলে বিদেশিদের জন্য বাইরে থেকে চীনা নববর্ষ সম্পর্কে অনেক কিছু অজানা থেকে যায়। চীনারা বিদেশিদের নিমন্ত্রণ জানালে পরিবারে না নিয়ে রেস্টুরেন্টে আতিথেয়তা শেষ করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন একঝাঁক চীনা ছেলেমেয়ের সঙ্গে মূল বিষয়ের ক্লাস শুরু হয়, তখন বিদেশি শিক্ষার্থী বলতে আমি আর সিরিয়ার ইউশা। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে চীনা সংস্কৃতি নিয়ে চীনা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আলাপে-আড্ডায় সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকলে বন্ধুর সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে ক্লাস বন্ধু শুলিউন বিশেষ বন্ধু হয়ে ওঠে। সপ্তাহের শেষে ছুটির দিনে হুথং এলাকার বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে নিয়ে বিচিত্র চীনা খাবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয় সে। জানাশোনা হয় চীনা জাতীয় খাবার পাও জে, জিয়াও জে, মানথো ইত্যাদি খাবারের সঙ্গে।
এর মধ্যে বেইজিং এলাকার মানুষের পছন্দের শীর্ষে বিভিন্ন ধরনের পাও জে এবং জিয়াও জে। চীনা নববর্ষে এ দুটি খাবার চীনজুড়ে বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়। একেক প্রদেশের জিয়াও জে এবং পাও জের স্বাদও ভিন্ন। আবার চীনজুড়ে বিশেষভাবে খ্যাত কওপুলি পাও জে। শুলিউনের সহায়তায় এসব খাবারের স্বাদও নেওয়া হয়।
চীনা নববর্ষ উপলক্ষে দেশটির মানুষ সরকারিভাবে সবচেয়ে লম্বা ছুটি পায়। এই সময়টায় প্রত্যেকে যেমন নিজ নিজ প্রদেশে নিজের পরিবারের কাছে ফিরে গিয়ে নববর্ষের আনন্দ ভাগাভাগি করে, একইভাবে এই সময়টায় চীনারা দেশজুড়ে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। প্রচলিত একটি কথা রয়েছে, চীনা নববর্ষে চীনারা একে অন্যকে চিনতে পারে না। কারণ এক প্রদেশের মানুষ বিপুল সংখ্যায় অন্য প্রদেশে ভ্রমণে চলে যাওয়ায় পরস্পর পরস্পরের কাছে অচেনা হয়ে ওঠে।
চীনাদের প্রিয় রং লাল। তাদের কাছে লাল রং মানে উৎসবের রং। ফলে চীনা নববর্ষে বাড়িঘর থেকে রাস্তাঘাট, বিনোদন এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, শপিং মল—সব কিছু লাল রঙের কাগজের বিচিত্র আলপনায় সাজানো হয়। একইভাবে নববর্ষের সময়টায় রাতে দেশজুড়ে আতশবাজির ঝলকানিতে ঝলমল করে ওঠে।
কথায় কথায় একদিন শুলিউন জানাল, নববর্ষের ছুটিতে ডরমিটরিতে একা বসে না থেকে ইচ্ছা করলে তার জন্মশহরে তাদের পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে আসতে পারি। বেইজিং থেকে চার ঘণ্টা দূরত্বে জানজিয়ে খউ শহরে তার পরিবার থাকে। এরই মধ্যে সে তার মা-বাবাকে আমার কথা জানিয়েছে। রাজি হলে তার বাবা বেইজিং এসে আমাদের নিয়ে যাবেন। চীনা পরিবারের সঙ্গে মিশে ভেতর থেকে চীনা সংস্কৃতি বোঝার ইচ্ছায় শুলিউনের প্রস্তাবে রাজি হলে সে তার মা-বাবাকে জানিয়ে দেয়।
জানজিয়ে খউ কবে যাওয়া হবে, কবে শুলিউনের বাবা বেইজিং এসে আমাদের নিয়ে যাবেন, আগেই ঠিক করে রাখা হয়। নববর্ষ উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের পরের দিন শুলিউনের বাবা মিস্টার ওয়াং লি নিজে গাড়ি চালিয়ে সকালে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটে এসে হাজির। শুলিউনের সঙ্গে প্রধান গেটে হাজির হলে তার বাবা চীনা কায়দায় আভিনন্দন জানান। কয়েক মিনিটের মধ্যে মিস্টার ওয়াং লি আমাদের নিয়ে জানজিয়ে খউয়ের পথে রওনা দেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দখলদার জাপানি সৈনিকদের সঙ্গে চীনা সৈনিকদের প্রবল যুদ্ধের জন্য শহরটি বিখ্যাত।
শুলিউনদের বাড়িতে পৌঁছলে চীনা রীতিতে বিদেশিকে বরণ করে নেওয়া হয়। প্রবল শীতে শহরটির বিভিন্ন স্থানে আইস স্কাল্পচার চোখে পড়ে। সেসব শিল্পকর্ম আবার রঙিন বাতি জ্বালিয়ে আলোঝলমল করে তোলা হয়েছিল।
সন্ধ্যা নামতেই শুলিউনের বাড়িতে শুরু হয়ে যায় নববর্ষের উৎসব। চীনারা বিশেষ দিনে খাবার টেবিল সাজায় অন্তত ২৫ থেকে ৩০ প্রকারের খাবারে। নববর্ষেও এর ব্যতিক্রম নয়। এসব খাবারের সঙ্গে থাকে চীনা ট্র্যাডিশনাল পানীয়। এর মধ্যে বিখ্যাত মাওথাই।
তবে চীনা নববর্ষে একটি বিষয় বেশ নজর কাড়ল। ঐতিহ্যের চীনা নতুন পোশাকের পাশাপাশি বড়রা ছোটদের লাল খামে অর্থ ভরে হাতে তুলে দিয়ে আশীর্বাদ করেন। আর নববর্ষের প্রথম প্রহরে সবাই সমস্বরে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘শিন নিয়ান খোয়াই লা, কোয়া নিয়ান হাও।’ বাংলা করলে অর্থ দাঁড়ায়—শুভ নববর্ষ, দেশের জন্য মঙ্গল বয়ে আনুক। আবার চান্দ্র নববর্ষ উপলক্ষে একেক বছর একের প্রাণীর নামে চীনা নববর্ষের নামকরণ করা হয়। যেমন, আজ বুধবার চীনাদের যে নতুন বছর শুরু হচ্ছে, এবার এই নতুন বছরকে ‘সর্পবর্ষ’ নামকরণ করা হয়েছে।
এসব তো এখন বলছি। তবে// শুলিউনদের বাড়িতে যখন গিয়েছিলাম তখন এসব চীনা রীতির কিছুই জানতাম না। শুলিউনের মা যখন আমার হাতে নতুন জামা তুলে দিয়ে আশীর্বাদ করছিলেন তখন একটি লাল খামও ছিল, কিছু পরে শুলিউনের বাবা এবং দাদিও আমার হাতে লাল খাম তুলে দিয়ে আশীর্বাদ করলেন, আমি শুলিউনকে জিজ্ঞেস করি, এই লাল খাম কিসের? সে মুখে রহস্য ছড়িয়ে বলে দিল, ‘বেইজিং গিয়ে খুলবে, তার আগে নয়। এখন খুললে তোমার অমঙ্গল হবে।’ এর পরের দিন শুলিউনের খালা-খালুর বাসায় আমাকে নিয়ে গেলে তাঁরাও আমার হাতে লাল খাম তুলে দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। শুলিউনের কথা মান্য করে (বলা চলে চীনা সংস্কৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে) বেইজিংয়ে ডরমিটরিতে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত একটি খামও খুলিনি। পরে খুলে দেখলাম, প্রত্যেকটি খামের ভেতর চীনা নতুন টাকা। আমি ছোট ছেলে কিংবা মেয়ে না হলেও একজন বিদেশি হিসেবে চীনারা আমার হাতে লাল খাম তুলে দিয়ে আশীর্বাদ জানিয়েছিলেন। স্মৃতি হিসেবে টাকাভর্তি সেই খামগুলো এখনো আমার কাছে সংরক্ষিত আছে।

নববর্ষ উপলক্ষে এ ধরনের লাল খামে দেওয়া হয় সালামি