আওয়ামী লীগ আমলে বঞ্চিত দাবি করে আবেদন করা দেড় হাজার কর্মকর্তার (অবসরপ্রাপ্ত) মধ্যে ৭৬৪ জনকে সামাজিক মর্যাদা ফেরত দিল সরকার। পাশাপাশি তাঁদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। গতকাল রবিবার শেখ হাসিনার আমলে বঞ্চিত এসব কর্মকর্তাকে উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব, গ্রেড-১ ও সচিব পদে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
আলাদাভাবে জারি করা মোট পাঁচটি প্রজ্ঞাপনে সচিব পদে ১১৯, গ্রেড-১ পদে ৪১, অতিরিক্ত সচিব পদে ৫২৮, যুগ্ম সচিব পদে ৭২ এবং উপসচিব পদে চারজনকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়।
ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন মন্ত্রিপরিষদসচিব ও বিসিএস ১৯৮২ নিয়মিত ব্যাচের মেধাতালিকায় প্রথম হওয়া ড. শেখ আবদুর রশীদ, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব মো. সিরাজ উদ্দিন মিয়া, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গনি, পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সিনিয়র সচিব) এম এ আকমল হোসেন আজাদ, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব এহছানুল হক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. এ এস এম সালেহ আহমেদ, ড. নেয়ামত উল্যা ভুঁইয়া, মমতাজ আহমেদ প্রমুখ।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কর্মকর্তারা এক বা একাধিক পদে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির তারিখ থেকে বিধি মোতাবেক প্রাপ্যতা অনুযায়ী সব আর্থিক সুবিধা পাবেন। বর্তমান অর্থবছরে তাঁদের বকেয়া পাওনার ৫০ শতাংশ দেওয়া হবে। অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ দেওয়া হবে পরবর্তী অর্থবছরে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বয়স ৫৭ বা ৫৯ বছর পূর্তি পর্যন্ত সর্বশেষ পদোন্নতিপ্রাপ্ত পদে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে বহাল ছিলেন বলে বিবেচিত হবেন। অবসরোত্তর ছুটি বা অবসর প্রস্তুতি ছুটি শেষে অবসরের জন্য নির্ধারিত তারিখে সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গেছেন মর্মে বিবেচিত হবেন। কর্মকর্তারা বিধি মোতাবেক তাঁদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী বকেয়া বেতন-ভাতা ও পেনশন সমন্বয়পূর্বক আর্থিক সুবিধা পাবেন।
পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এর আগে জারীকৃত পিআরএল বা এলপিআর আদেশ বাতিল করা হয়েছে।
বেতন নির্ধারণের সময় অবসরোত্তর ছুটি বা অবসর প্রস্তুতি ছুটি সমন্বয় করা হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, এই ৭৬৪ জন বঞ্চিত কর্মকর্তা শুধু সামাজিক মর্যাদা এবং তাঁদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ পেলেন। যে পদেই তাঁরা ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পান না কেন, তাঁরা কিন্তু প্রশাসনে নিয়োগ পাবেন না। তাঁদের নিয়োগ দিতে হলে আলাদাভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিতে হবে। সেটা সরকার চাইলে যে কাউকেই দিতে পারেন।
এর আগে আওয়ামী লীগ আমলে অবসরে যাওয়া বঞ্চিত ৭৬৪ জন কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়ে আর্থিক সুবিধা দেওয়ার সুপারিশ করে বঞ্চনা নিরসন কমিটি গত ১০ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের প্রতিবেদন দেয়। এরপর বিষয়টি অনুমোদনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। বিস্তারিত আলোচনা শেষে পরিষদ সিদ্ধান্ত দেয়, উপসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে এসব কর্মকর্তাকে ‘ভূতাপেক্ষ’ পদোন্নতিও দেওয়া হবে। তবে সরকারি চাকরিতে তাঁদের পুনর্বহাল করা হবে না বা তাঁরা কখনো এই দাবি করতে পারবেন না।
আর্থিক কৃচ্ছ্রসাধনের কারণে প্রথম দফায় শুধু বকেয়া বেতন পাবেন বঞ্চিত এসব কর্মকর্তা। এ জন্য ২১ কোটি টাকা ছাড় করার অনুমোদন দেয় উপদেষ্টা পরিষদ। পর্যায়ক্রমে এসব কর্মকর্তার আনুতোষিক ও পেনশন বাবদ অর্থ ছাড় করা হবে। গত বছর ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এ নিয়ে নাম প্রকাশ করে দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক উপদেষ্টা কালের কণ্ঠকে জানান, উপদেষ্টা পরিষদে তাঁদের ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি ও আর্থিক সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদন করা হয়েছে। সরকারের ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রথম দফায় বঞ্চিত কর্মকর্তাদের বকেয়া বেতন বাবদ অন্তত ২১ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে অর্থ বিভাগকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকি পাওনা টাকা দেওয়া হবে।
জানা গেছে, যোগ্যতা থাকার পরও ‘রাজনৈতিক’ তকমা দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে প্রশাসনে হাজারো কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এই কর্মকর্তাদের বছরের পর বছর ফেলে রাখা হয়েছে ‘গুরুত্বহীন’ পদে। মেধাবী, দক্ষ ও যোগ্য অনেক কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে ফেলে রাখা হয়েছিল দীর্ঘদিন। কাউকে কাউকে দেওয়া হয়েছিল বাধ্যতামূলক অবসর।
গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। সেই থেকে প্রশাসনে আমূল পরিবর্তন আসতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়োগ বাতিল করে অবসরে থাকা বঞ্চিত যোগ্য কর্মকর্তাদের প্রশাসনে নিয়োগ দেওয়া হয়। আর পদোন্নতিবঞ্চিত প্রশাসনে কর্মরত প্রায় ৭০০ কর্মকর্তাকে দেওয়া হয় পদোন্নতি।