<p>রাতের আঁধারে চাঁদের আলোয় কিছুটা আলোকিত ঘন জঙ্গলে ভরা জনপদ। সেই আলো-আঁধারির খেলায় কিছু মানুষের চোখে ঘুম নেই। মানুষ যখন গভীর ঘুমে, তখন তারা ব্যস্ত সীমান্তে। সীমান্তের ওপার থেকে এপারে আসবে গরুর পাল। নির্ঘুম মানুষগুলোর অপেক্ষা সেই গরুর পালের জন্য। রাত যত গভীর হয়, ততই বাড়ে গরুর ঢল। সীমান্তের পাহাড়ি পথ মাড়িয়ে একটু এগোলেই অপেক্ষায় আছে ট্রাকের বহর। সেই ট্রাকে দলে দলে সওয়ার হচ্ছে একের পর এক গরু। তারপর রাতের আঁধারেই সেই ট্রাক চলে যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে।</p> <p>এভাবেই কাঁটাতারের ঘেরা, খরস্রোতা নদী আর পাহাড় পাড়ি দিয়ে ওপার থেকে আসা গরু মিশে যাচ্ছে বাংলাদেশের হাটবাজারে। যার নাম ‘বার্মাইয়া গরু’।</p> <p>কক্সবাজারের কাছের সীমান্ত উপজেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির কালাচাইন্দা এলাকায় এটাই নিত্যরাতের দৃশ্য। এই কাজে স্থানীয় রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষক, সন্ত্রাসী ও প্রশাসনের কিছু ব্যক্তি জড়িত থাকায় চোরাচালানের এই চক্রটি বেশ শক্তপোক্ত। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে মায়ানমারের ওপারের গরু এপারে আনতে চোরাকারবারিদের তাই ঘাটে ঘাটে দিতে হয় বখরা। সেই বখরা দিয়ে সীমান্ত পথে এই চোরাচালান হয়ে উঠে অত্যন্ত সরল ও মসৃণ। বিপরীতে সীমান্তরক্ষীদের চোখ এড়াতে চলে নানা কিসিমের কেরামতি।</p> <p>শুধু বান্দরবান কিংবা কক্সবাজার সীমান্ত নয়, দেশের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এভাবেই চোরাই গরু আনছে একাধিক বড় চক্র। এতে সরকার হারাচ্ছে বড় আকারের রাজস্ব।</p> <p>এদিকে মায়ানমার ও ভারত থেকে গরু আসবে না—সরকারের এমন ঘোষণায় দেশি খামারিদের বুকে আশা জাগলেও সীমান্ত দিয়ে দেদার গরু ঢোকায় তাঁদের সেই আশা নিরাশায় পরিণত হয়েছে। তাঁরা এখন লোকসানের শঙ্কায় পড়েছেন। যদিও প্রশাসনের দাবি, মায়ানমার থেকে গবাদি পশুর অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।</p> <p>অন্যদিকে গরু পাচারের কারণে সীমান্ত এলাকার খামারের পশুর শরীরে নানা ধরনের রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। খামারিদের অভিযোগ, দেশে বৈধ পথে আনা পশুর নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। অথচ চোরা পথে আসা গরুর শরীরে রোগ আছে কি না তা জানারও সুযোগ নেই।</p> <p>চোরাপথ খোলা : ২০১৪ সালে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে বৈধ পথে গরু আসা বন্ধ হয়ে যায়। চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে বাড়ানো হয় গবাদি পশু পালন। দেশে এখন ছোট-বড় মিলিয়ে ২০ লাখ খামার আছে। ভারত ও মায়ানমারের কড়াকড়ির কারণে কয়েক বছর ধরে সীমান্ত পথে তেমন গরু আসেনি। কিন্তু ইদানীং সীমান্ত পথ অনেকটাই ঢিলেঢালা।</p> <p>যেভাবে পাচার হয়ে আসে : স্থানীয়রা বলছেন, গরু চোরাচালানের ক্ষেত্রে সীমান্ত পার করার জন্য দুই ধরনের লোককে কাজে নামায় চোরাকারবারিচক্র। একটি গ্রুপ গরুর সঙ্গেই থাকে; আরেকটি গ্রুপ রাস্তায় পুলিশ-বিজিবি থাকে কি না তা জেনে কারবারিকে খবর দেয়। তারা গরুপ্রতি এক থেকে দুই হাজার টাকা করে পায়। সীমান্ত পার হওয়ার পর দেশের কোনো হাট থেকে টাকার বিনিময়ে গরু কেনার নকল কাগজপত্রও তৈরি করে নেওয়া হয়। এতে পথে আর পুলিশি ঝামেলায় পড়তে হয় না। রাতের আঁধারে সীমান্ত পার হওয়া গরু নির্বিঘ্নেই দিনের আলোতে দেশের বিভিন্ন হাট-বাজারে পৌঁছে যায়।</p> <p>সীমান্তের ১৪ পয়েন্ট : কক্সবাজার ও বান্দরবানের ১৪টি পয়েন্ট ব্যবহার করে গরু চোরাচালান করে কারবারিরা। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির কম্বনিয়া, তুমব্রু, বাম হাতিরছড়া, ফুলতলী, চাকঢালা, লম্বাশিয়া, ভাল্লুকখাইয়া, দৌছড়ি, বাইশফাঁড়ি, আশারতলী ও জামছড়ি এবং কক্সবাজারের রামু উপজেলার হাজিরপাড়া, বালুবাসা, ডাক্তারকাটা ও মৌলভীরকাটা দিয়ে চোরাপথে মায়ানমারের গরু আসছে।</p> <p>অবৈধ গরু যেখানে বৈধ হয় : অন্যদিকে মায়ানমার থেকে চোরা পথে আসা গরু নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের চাকঢালা বাজার, রামুর গর্জনিয়া বাজার ও ঈদগাহর উপজেলার ঈদগাহ বাজারের রসিদের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়। এই তিন বাজারে রসিদ নিয়েই ট্রাক ভর্তি করে মহাসড়ক দিয়েই অবৈধ গরু বৈধপন্থায় দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার হচ্ছে।</p> <p> </p> <p> </p>