<p>এশিয়ান গেমস—‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন এশিয়া’। অলিম্পিকের পর বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদদের অনুষ্ঠান। এশিয়ার ক্রীড়াচত্বরে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধ সৃষ্টি আর কৃষ্টির। গতি, শক্তি, শৈলী আর বীরপনার। এ ছাড়া এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে খেলাধুলার মাধ্যমে প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন, সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ও সম্মিলিতভাবে এশিয়া ক্রীড়াঙ্গনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এই গেমসের লক্ষ্য। এই গেমস প্রতিটি অংশগ্রহণকারী দেশের খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদদের দেশাত্মবোধ বাস্তবে প্রতিফলনের মঞ্চ।</p> <p>এশিয়ান অলিম্পিয়াডের কথা উঠলে প্রথমেই আসবে ভারতের ভূমিকা। ভারত এই গেমসের স্বপ্নদ্রষ্টা শুধু নয়, এশিয়ান গেমস ফেডারেশন গঠন করেছে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে। এরপর প্রথম গেমস সফলতার সঙ্গে আয়োজন করেছে (১৯৫১ সালে) নিজ দেশে। এশিয়ান গেমসের চিন্তা যে ভারতীয়র মাথা থেকে এসেছে তিনি হলেন গুরুদত্ত সোন্ধী—শিক্ষাবিদ, ক্রীড়ানুরাগী ও অলিম্পিকের আদর্শের পূজারি। ১৯৪৮ সালে লন্ডনে চতুর্দশ অলিম্পিক চলাকালে এশিয়ার বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে এশিয়ান গেমস নিয়ে আলোচনা করেন গুরুদত্ত সোন্ধী। খোলাখুলিভাবে জানান তাঁর চিন্তা। এশিয়ার ক্রীড়া সংগঠকরা তাঁর চিন্তাকে সমর্থন জানান। লন্ডনেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ১৯৫১ সালে ভারতের দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হবে প্রথম এশিয়ান গেমস। গঠিত হয় এশিয়ান গেমস ফেডারেশন। সবার সম্মতিতে গুরুদত্ত সোন্ধীকে মনোনীত করা হয় ফেডারেশনের প্রথম সম্পাদক।</p> <p>দিল্লির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে ১৯৫১ সালের ৪ থেকে ১১ মার্চ প্রথম এশিয়ান গেমস অনুষ্ঠিত হয়। গেমস অনুষ্ঠানের পেছনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুর উৎসাহ ও সাহায্য স্মরণীয়। আনুষ্ঠানিকভাবে গেমসের উদ্বোধন করেন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ। অংশ নিয়েছিল ১১টি দেশ। প্রথমবার অন্তর্ভুক্ত ছিল ফুটবল, বাস্কেটবল, অ্যাথলেটিকস, সাঁতার, সাইক্লিং ও ভারোত্তোলন।</p> <p>ফুটবলের ফাইনালে ভারত ইরানকে ১-০ গোলে পরাজিত করে প্রথম এশিয়াডে চ্যাম্পিয়ন হয়। কৃতী বাঙালি খেলোয়াড় শৈলেন মান্না এই দলের অধিনায়ক ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে ১৯৫৮ সালে টোকিওতে তৃতীয় এশিয়াডে পূর্ব পাকিস্তানের কৃতী বাঙালি ফুটবলার নবী চৌধুরী পাকিস্তান দলের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কোনো বাঙালি এই প্রথম পাকিস্তান জাতীয় দলের অধিনায়ক হন। নবী চৌধুরী ছাড়াও আরো পাঁচজন ফুটবলার টোকিও গেমসে ফুটবল দলে স্থান পেয়েছিলেন। তাঁরা হলেন আশরাফ চৌধুরী, চিংগা মং চৌধুরী, মারী, কবীর আহমেদ, মঞ্জুর হাসান মিন্টু ও আমির জং চৌধুরী গজনবী। পঞ্চাশের দশকে আমাদের এ অঞ্চলে বাঙালির ফুটবলের মান কোন পর্যায়ে ছিল, এই ‘সিলেকশন’ থেকেই এটা সহজে বোঝা যায়। পূর্বসূরিদের মাঠের সেই ফুটবলে এখন চলছে অমাবস্যা। ফুটবলে নেই সেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ।</p> <p>১৮তম এশিয়ান গেমস এবার ইন্দোনেশিয়ায়। আজ ১৮ আগস্ট থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়ে সমাপ্তি ঘটবে ২ সেপ্টেম্বর। গেমসে ৪০টি খেলার ভেন্যু রাজধানী জাকার্তা ও পালেম বাংয়ে। অংশ নেবে ৪৫টি দেশ থেকে প্রায় ১১ হাজার ক্রীড়াবিদ ও খেলোয়াড়। বাংলাদেশ থেকে ১৪টি খেলার ডিসিপ্লিনে (ফুটবল, হকি, বাস্কেটবল, কাবাডি, বিচ ভলিবল, গলফ, অ্যাথলেটিকস, সাঁতার, শুটিং, আর্চারি, ভারোত্তোলন, কুস্তি, রোইং ও ব্রিজ) অংশ নেবেন ১১৭ জন খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদ। গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মার্চপাস্টে বাংলাদেশের পতাকা বহন করবেন ভারোত্তোলনকারী ক্রীড়াবিদ সাবিয়া আক্তার। সাবিয়া ভারতে অনুষ্ঠিত গত সাফ গেমসে স্বর্ণপদক জিতেছেন এবং স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত (২০১৪) কমনওয়েলথ গেমসে আত্মবিশ্বাস ও সাহসের সঙ্গে সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো করেছেন।</p> <p>এদিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাকার্তা গেমস উদ্বোধনের আগেই গত ১৪ আগস্ট থেকে শুরু হয়ে গেছে ফুটবল কম্পিটিশন। ‘বি’ গ্রুপে প্রথম খেলায় বাংলাদেশ পরাজিত হয়েছে ৩-০ গোলে। শক্তিশালী দল উজবেকিস্তানের বিপক্ষে এই পরাজয় অপ্রত্যাশিত নয়। বিজয়ী প্রতিপক্ষ আমাদের অনূর্ধ্ব-২৩ দল থেকে ‘টেকনিক্যালি’ ও ‘ট্যাকটিক্যালি’ অনেক বেশি এগিয়ে। দ্বিতীয় ম্যাচে বাংলাদেশ প্রথমে গোল করে এগিয়ে থেকেও শেষ পর্যন্ত ১-১ গোলে ড্র করেছে থাইল্যান্ডের সঙ্গে। সুযোগ কাজে লাগাতে না পেরে বাংলাদেশ জয় ধরে রাখতে পারেনি। শেষ ম্যাচটি খেলতে হবে কাতারের বিপক্ষে। এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশ এ পর্যন্ত মাত্র তিনটি খেলায় জিতেছে। প্রথমে ১৯৮২ সালে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে ২-১, ১৯৮৬ সালে নেপালকে ১-০ এবং ২০১৪ সালে আফগানিস্তানকে পরাজিত করেছে ১-০ গোলে।</p> <p>বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালের থাইল্যান্ডের ব্যাংককে (অষ্টম আসরে) প্রথম অংশ নেওয়ার পর থেকে বিগত সব এশিয়াডে অংশ নিয়েছে। দেশ প্রথম পদকের মুখ দেখেছে ১৯৮৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে। সেবার বক্সিংয়ে ৮১ কেজি লাইট হেভিওয়েটে ব্রোঞ্জ জয় করেন মোশাররফ হোসেন। এরপর এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে আর কেউ এশিয়াডে ব্যক্তিগত পদক জিততে পারেননি। ১৯৯০ সালে চীনের বেইজিং এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশের জাতীয় খেলা কাবাডি। আর এই কাবাডিতে (দলীয় ইভেন্ট) প্রথম রৌপ্যপদক জয় করে বাংলাদেশ। এখন পর্যন্ত এশিয়াডে ১২টি পদক পেয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে একটি স্বর্ণপদক (পুরুষদের ক্রিকেটে ২০১০ সালে) ২০১০ সালে চীনের গুয়ান জু এশিয়ান গেমসে। অন্যগুলো পুরুষ কাবাডি, নারী ক্রিকেট, নারী কাবাডিতে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদক। কাবাডি দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি পদক এনে দিয়েছে।</p> <p>ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় এবার নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো এশিয়াডের আয়োজন। এর আগে চতুর্থ গেমস অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৯৬২ সালে জাকার্তায়। সেই গেমসে স্বাগতিক দেশ ও এশিয়ান ক্রীড়া ফেডারেশনকে বিভিন্ন ধরনের বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ কলুষিত হয়েছে মূলত আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কারণে।</p> <p>এশিয়ান গেমস আমাদের জন্য বড় শক্ত ও কঠিন—বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই বাস্তবতা। প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে এই চত্বরে আমরা অনেক অনেক পিছিয়ে আছি। তাই এই গেমসে যেসব ডিসিপ্লিনে এবার অংশ নেওয়া হবে এগুলোর একটিতেও আত্মবিশ্বাস, সাহস এবং উজ্জীবিত হয়ে বলা সম্ভব নয় ব্যক্তিগত বা দেশীয় ইভেন্টে পদক জয় সম্ভব। বলা হয়েছে শুটিং, কাবাডি ও আর্চারিতে ভালো করার সম্ভাবনা আছে। তার মানে নিশ্চিত করে কিছু বলা সম্ভব নয়। শুটিং, আর্চারি, কাবাডি লম্বা সময় ধরে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রস্তুতি নিয়েছে। শুটিং আর আর্চারি তো ২০২০ অলিম্পিক সামনে রেখে লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাজ করছে। মনে রাখতে হবে, এশিয়াডে শুটিং ও আর্চারিতে তো বিশ্বের সেরারা অংশ নেন। সেখানে লড়াই করে পদক জেতা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কাবাডি ৯-১০ মাস ধরে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেও আস্থার অভাবে ভুগছে। তাদের বক্তব্য হলো, প্রশিক্ষণ ভালো হয়েছে, তবে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি। দেরিতে সরকারি অর্থ বরাদ্দ পাওয়ায় অন্যান্য খেলায় এক-দেড় মাসের বেশি প্রশিক্ষণের সুযোগ মেলেনি। খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদদের মুখে একই অভিযোগ—এত অল্প প্রশিক্ষণে এশিয়ান গেমসে তো কিছুই সম্ভব নয়। তবু নিজেদের সেরাটা দেওয়ার সাধ্যমতো চেষ্টা করব। খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদদের দোষারোপ করা যাবে না, তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়টিই তো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বিওএর মহাসচিব সব কিছু বুঝে, জেনে তো তাঁর অবস্থান থেকে অবাস্তব আশার কথা শোনাতে পারেন না। বিওএর বক্তব্য হলো, এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণ আগামী বছর মার্চে সাফ গেমসে অংশগ্রহণেরই প্রস্তুতি। আঞ্চলিক গেমসে বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থাও যে ভালো তা তো নয়। এখানেও তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হতে হবে। ক্রীড়াবিদদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি না করতে পারলে এবং তাঁদের সামর্থ্যের প্রতিফলন ঘটানোর উদ্যোগ না নিতে পারলে তো পুরো বিষয়টি আবার গতানুগতিক হতে বাধ্য। খেলার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতার অভাব ও উদাসীনতা দেশকে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে পিছিয়ে রেখেছে। এর ফলে খেলার ব্যবস্থাগুলো গত ৪৬ বছরেও তৈরি করা সম্ভব হয়নি। মুখের কথা আর আশ্বাস দিয়ে তো ক্রীড়াঙ্গন চলে না। এগুলো এখন বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। লক্ষ্য ঠিক করেই ঝাঁপ দিতে হবে। নিরলস প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতির জন্য পাঁচ-ছয় কোটি টাকার বেশি লাগে না। এটা বরাদ্দ করা হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভূমিকম্প ঘটবে না। এই অর্থ সময়মতো বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন বরাবর বরাদ্দ করা হলে এবং তা সঠিকভাবে কাজে লাগালে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে দেশের উজ্জ্বল চেহারা বের হয়ে আসতে সময় লাগবে না।</p> <p><strong>লেখক : </strong>কলামিস্ট ও বিশ্লেষক</p>