<p>সে ছিল এক প্রচণ্ড দুঃসময়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় তখন চলছে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে ফেলার চরম অভিঘাত। জাতীয় সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দোর্দণ্ড প্রতাপে তখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত জামায়াত-বিএনপি সরকার। ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে সরকার গঠন করেই আর দেরি করল না। জামায়াতের সুদীর্ঘ পরিকল্পনা, বাংলাদেশকে এক ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য জামায়াত-বিএনপির ক্যাডার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর, যাতে তারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। দেশের এক নম্বর ইংরেজি পত্রিকায় ২০০১ সালের ১৩ নভেম্বর খবর ছাপা হয়—অক্টোবরের নির্বাচনের পর পর ভোলার চরফ্যাশনে এক রাতে ২০০ হিন্দু মহিলাকে গণধর্ষণ করা হয়। শত শত পূর্ণিমা শীলের বুকফাটা কান্না আর চোখের জল মিশে যায় পদ্মা, মেঘনা, যমুনার জলের সঙ্গে। পূর্ণিমার মা-বাবার আহাজারিতে কেঁপে ওঠে বিশ্ববিবেক। বিশ্বের সেরা পত্রিকা দ্য ইকোনমিস্ট ২০০৩ সালের ২৩ নভেম্বর শিরোনাম করে—‘In Bangladesh religious minorities are safe only in the departure lounge.’ ব্যথিত হৃদয়ে হুমায়ুন আজাদ রচনা করলেন সেই বিখ্যাত গ্রন্থ—‘পাক সার জমিন সাদবাদ।’ তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে স্বদম্ভে ঘোষণা দিলেন, হুমায়ুন আজাদকে শাস্তি পেতে হবে ওই বই লেখার জন্য। সেটাই হলো। জামায়াত প্রদত্ত শাস্তিতে হুমায়ুন আজাদ স্বল্প দিনের মাথায় মৃত্যুবরণ করলেন। তখন রাষ্ট্রযন্ত্র নীরব থাকল।</p> <p>বাংলাদেশের মানুষের কাছে তখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বিএনপির কাঁধে চড়ে জামায়াত ক্ষমতায় বসে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তিনটি প্রধান লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছে। প্রথমত, পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশকে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র করার জন্য হিন্দুদের দেশ ছাড়া করা। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলার মতো রাজনৈতিক শক্তিকে চিরতরে বিনাশ করার জন্য আওয়ামী লীগকে একেবারে শেষ করে দেওয়া, যার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে। তৃতীয়ত, তাদের কথিত খেলাফত ও শরিয়া রাষ্ট্র কায়েম করার পথে সব বাধা দূর করার জন্য সশস্ত্র জঙ্গিদের মাঠে নামিয়ে দেওয়া। তৃতীয় এই লক্ষ্যটি বাস্তবায়নের জন্য মানুষের মনে ভয়ভীতি সৃষ্টি করতে তাদের জঙ্গিরা ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একযোগে প্রায় একই সময়ে দেশব্যাপী ৬৩টি জেলায় ৫২৫টি স্থানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। বোমা বিস্ফোরিত স্থানে চিরকুট পাওয়া যায়, যেখানে লেখা—জেএমবি-জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ, যেটি মূলত জামায়াতের গোপনীয় নিজস্ব সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পরবর্তী সময়ে যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের বেশির ভাগই ছাত্রশিবিরের সদস্য। একবার ভেবে দেখুন, <img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2019/08 August/17-08-2019/KK_ED_2A.jpg" style="float:left; height:221px; margin:12px; width:333px" />একযোগে একই সময়ে ৫২৫ স্থানে বোমা স্থাপন ও তার বিস্ফোরণ ঘটানো চাট্টিখানি কথা নয়, বিশাল কর্মযজ্ঞ। কত লোক এর সঙ্গে জড়িত হতে হয়, তার সমন্বয় সাধন, শলাপরামর্শ, বিস্ফোরকদ্রব্য বহন ও স্থাপন ইত্যাদি কর্মযজ্ঞ রাষ্ট্রের এত গোয়েন্দা সংস্থার নজর কিভাবে এড়িয়ে গেল। জামায়াত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় না থাকলে এটা কি সম্ভব হতো?</p> <p>সেই সময়ে জামায়াতের দুজন চিহ্নিত মশহুর যুদ্ধাপরাধী নিজামী ও মুজাহিদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ছিলেন। নিজামী প্রথমে কৃষি ও পরে শিল্পমন্ত্রী ছিলেন। আর মুজাহিদ ছিলেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। এই দুটি মন্ত্রণালয়ের বিস্তৃতি ও নেটওয়ার্ক রয়েছে তৃণমূল পর্যন্ত। রাষ্ট্রীয় এই নেটওয়ার্কের ওপর ভর করেই ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জেএমবি সদস্যরা এত বড় অপতৎপরতা চালাতে সক্ষম হয়েছে বলেই অনেকে মনে করেন। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের ঘটনাই তাদের একমাত্র অপকর্ম নয়। অনেক ঘটনার ধারাবাহিকতায় তারা এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঘটনা ঘটিয়েছে এবং এরপর যত দিন ক্ষমতায় ছিল তত দিন সশস্ত্র জঙ্গিদের মাঠে রেখেছে। ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসেই জামায়াত-বিএনপির ক্যাডার বাহিনীর জঙ্গিপনায় শঙ্কিত হয়ে বিশ্বের বড় বড় পত্রিকা বিশ্বসম্প্রদায়কে বাংলাদেশ সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য একের পর এক প্রতিবেদন ছাপাতে থাকে। ২০০২ সালের ২ এপ্রিল ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল প্রতিবেদন ছাপায়, যার শিরোনাম ছিল—‘পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও ভয়ংকর হয়ে উঠছে ইসলামিস্ট জঙ্গিগোষ্ঠী’। ২০০২ সালের ৪ এপ্রিল ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউতে বার্টিন লিন্টনের বিশাল প্রতিবেদন ছাপা হয়, যার শিরোনাম ছিল—‘বাংলাদেশ হতে সাবধান, সেখানে এখন জঙ্গিগোষ্ঠীর আস্তানা’। তারপর ২০০২ সালের ১৪ অক্টোবর টাইম ম্যাগাজিনে ছাপা হয় আলেক্স পেরির প্রতিবেদন—‘Deadly cargo’. যার সূত্রে বিশ্বের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মন্তব্য করেন, বাংলাদেশ হবে পরবর্তী আফগানিস্তান। তখন চারদলীয় জোটের প্রভাবশালী শরিফ ইসলামী ঐক্যজোটের নেতাকর্মীরা স্লোগান দেওয়া শুরু করল—‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান।’</p> <p>২০০৫ সালের ১৭ আগস্টে আশকারা পাওয়ার পর জঙ্গিগোষ্ঠী আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একের পর এক আদালতের ওপর আক্রমণ চালায়। স্লোগান দিতে থাকে তাগদি, অর্থাৎ মানুষের তৈরি আইন তারা মানবে না। ২০০৫ সালের ৩ অক্টোবর প্রায় একই সময়ে লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর ও চট্টগ্রাম জেলা আদালতে জেএমবি আক্রমণ চালায়। ২৯ নভেম্বর গাজীপুর আইনজীবী সমিতির হলঘরের ভেতরে বোমা ও গ্রেনেড হামলা হয়। ১৪ নভেম্বর আক্রমণ হয় ঝালকাঠি আদালত প্রাঙ্গণে। সোহেল চৌধুরী ও জগন্নাথ পাঁড়ে নামের দুজন বিচারক ঝালকাঠিতে নিহত হন। মানুষের মনে প্রশ্ন ওঠে, আদালত প্রাঙ্গণ, যেটি একটি সুরক্ষিত এলাকা, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত এলাকা, সেখানে জঙ্গিরা কী করে প্রবেশ করে এবং গ্রেনেড বোমা আক্রমণ চালিয়ে নির্বিঘ্নে চলে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের রক্তে তো বহমান রয়েছে সুকান্ত, নজরুল, রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধুর রক্ত। জ্বলে-পুড়ে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়। মানুষ আবার রুখে দাঁড়ায়। ২০০১-০৬ মেয়াদের শেষ প্রান্তে জামায়াত-বিএনপি সরকার শিখণ্ডী রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে ব্যবহার করে বহু ষড়যন্ত্র করার পরও গণধাক্কায় ক্ষমতা থেকে উত্খাত হয়। কিন্তু তাদের ষড়যন্ত্র থেমে যায়নি।</p> <p>রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে যারা ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের মতো ঘটনার সঙ্গে জড়িত হতে পারে, যারা ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের মতো ঘটনা ঘটাতে পারে, তারা রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে যাওয়ার পর নিজেদের অপকর্মের প্রত্যাঘাতের আশঙ্কায় আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এরই প্রমাণ পাওয়া যায় ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংঘটিত পিলখানার ঘটনার মধ্য দিয়ে। এর আরো প্রমাণ পাওয়া যায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় ঘোষিত হওয়ার সময়। প্রকাশ্য তাণ্ডবে সুবিধা করতে না পেরে তারা আবার সশস্ত্র জঙ্গিদের মাঠে নামিয়ে দেয়। দেশব্যাপী শুরু হয় টার্গেট কিলিং। ২০১৩-১৬—এই সময়ে নিরীহ মানুষসহ প্রগতিশীল ও অন্য ধর্মের ধর্মগুরুদের ওপর যখন একের পর এক আক্রমণ চলতে থাকে, তখন সাংঘাতিক এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এ রকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করাই ছিল জঙ্গিদের ওই সব টার্গেট কিলিংয়ের মূল উদ্দেশ্য, যাতে সরকার বাধ্য হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ বন্ধ করে দেয়। এ পরিস্থিতির সুযোগে বিশ্বের পরাশক্তি তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর না করার অনুরোধ জানায়। সেই অনুরোধ যখন রক্ষা করা হয় না, তখন তারা সুপরিকল্পিত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আওয়াজ তোলে—বাংলাদেশে আইএস (ইসলামিক স্টেট) জঙ্গিরা এসে গেছে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশকেও একটা জঙ্গি আক্রান্ত দিশাহারা রাষ্ট্রে পরিণত করার পাঁয়তারা তখন দেখা যায়। আইএস আছে, আইএস আছে—এই প্রপাগান্ডায় বাংলাদেশের একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠীও তখন সুর মেলায়। নাটোরের মুদি দোকানদার সুনীল গোমেজকে জঙ্গিরা হত্যা করার পর যখন আইএসের পক্ষ থেকে দায় স্বীকার করা হয়, তখন বাংলাদেশের এক শ্রেণির কথিত সচেতন মানুষকে তার সঙ্গে সুর মেলাতে দেখে অবাক হয়ে যাই। সামান্য কিছুর বিনিময়ে তারা দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিতে পারে।</p> <p>সব কিছুরই একটা সীমা থাকে। ২০১৬ সালের ১ জুলাই জঙ্গিরা হোলি আর্টিজানের ঘটনা ঘটিয়ে নিজেদের কবর রচনা করে ফেলে। বাংলাদেশের মানুষ আবার একাত্তরের মতো জেগে ওঠে। তরুণসমাজসহ প্রতিটি পাড়া-মহল্লায়, গ্রামে-গঞ্জে মানুষ জঙ্গিবিরোধী অবস্থান নেয়। জনগণ ও রাষ্ট্রশক্তি যখন একত্র হয়ে যায়, তখন সেই সমাজ ও দেশের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি কোনো অপশক্তিই ষড়যন্ত্র করে সফল হতে পারে না। মানুষের সচেতনতার মাত্রা বোঝা যায়, যখন দেখি পুলিশের অভিযানে নিহত জঙ্গির মরদেহ নিতে স্বয়ং সেই জঙ্গির মা নিজেই অস্বীকার করেন এবং বলেন, ‘কোনো জঙ্গি আমার সন্তান হতে পারে না।’ সুতরাং রাষ্ট্রের সদিচ্ছা থাকলে জঙ্গি আর অপশক্তি যা-ই বলি না কেন, তারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে না। ২০০১-০৬ মেয়াদে দেখা গেছে ঠিক এর উল্টো চিত্র। তখন সরকারের ভেতরেই জঙ্গিদের গডফাদার জামায়াত ছিল। তাই মানুষ অবাক হয়ে দেখল—২০০৫ সালের ১৭ আগস্টে ৫২৫ স্থানে একযোগে বোমা ফাটিয়ে জঙ্গিরা নিশ্চিন্তে চলে গেল, রাষ্ট্রের কোনো সংস্থাই টের পেল না। সুতরাং বলতেই হবে, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্টের সিরিজ বোমার বিস্ফোরণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। আজ তারা সব দিক থেকে পিছু হটলেও নিঃশেষ হয়ে গেছে বা চুপচাপ বসে আছে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। এই সময়ে আপাতত আমরা একটা স্বস্তিকর পরিবেশে থাকলেও জঙ্গি আক্রমণের হুমকি থেকে মুক্ত নই।</p> <p>লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক</p> <p><a href="mailto:sikder52@gmail.com">sikder52@gmail.com</a></p> <p> </p> <p>ঘোষণা</p> <p>অনিবার্য কারণে মোফাজ্জল করিমের নিয়মিত কলাম ‘সেলাই করা খোলা মুখ’ আগামীকাল প্রকাশিত হবে।            বি. স.</p>