<p>গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বিষয়ক প্রস্তাব করেছিলেন ২০১৩ সালে। এটি এখন বিশ্বজুড়ে একটি প্রবণতার নাম; প্রায়ই সংবাদের শিরোনাম হয়—বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার সংবাদেও। এ উদ্যোগে দক্ষিণ এশিয়ার যেসব দেশ প্রথমে শামিল হয়েছে বাংলাদেশ তাদের একটি। বাংলাদেশসহ অনেক দেশ চীনের প্রতি তাদের আস্থার ভিত্তিতে বিআরআই-কে বিপুল সমর্থন দিয়েছে। আমরা তাদের সমর্থনদানের বিষয়টি উচ্চমূল্য দিয়ে থাকি।</p> <p>বিআরআই এখন পর্যন্ত বিশ্বের দেখা সবচেয়ে বড় গণ-উদ্যোগ। এর প্রতি সমর্থন যেমন আছে, তেমনি এ বিষয়ে চীনের প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ ও অনুমানপ্রসূত ধারণাও আছে। বিআরআইয়ের ধরন সম্পর্কে চীন বারবার ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলেও কিছু মহল সেসব ব্যাখ্যা মানতে নারাজ। তারা এ উদ্যোগের বিরুদ্ধে অসার অভিযোগ তোলে এবং তুলতে প্ররোচিত করে। সর্বশেষ অভিযোগগুলোর একটি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অব ডিফেন্স র‌্যান্ডাল জি শ্রিভারের। জানা যায়, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সফরের সময় তিনি বলেছেন, বিআরআই স্বতন্ত্র ও উন্মুক্ত (ফ্রি অ্যান্ড ওপেন) আঞ্চলিক উন্নয়ন সমর্থন করে না; সংশ্লিষ্ট দেশের সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক আইনের সুরক্ষাও নিশ্চিত করে না। এ অভিযোগ ভিত্তিহীন। চীন বৈশ্বিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে শাসনব্যবস্থা বিষয়ক ইস্যুগুলোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এসব বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র যে অবস্থান নিয়েছে তার সাপেক্ষে চীনের অবস্থান প্রায় বিপরীত। এমন মিথ্যা ও দায়িত্বহীন অভিযোগ এতদাঞ্চলে শান্তি ও উন্নয়নের জন্য ন্যূনতম মাত্রায়ও সহায়ক নয়।</p> <p>বিআরআই সত্যিকার অর্থেই কী, সামগ্রিকভাবে কিসের প্রতিনিধিত্ব করে সে ব্যাপারে ধারণার ঘাটতি রয়েছে; বিশেষ করে কিছু উন্নত দেশ অযথাই এ উদ্যোগকে আন্তর্জাতিক রীতির প্রতি হুমকি হিসেবে উপস্থাপন করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি বিআরআই এবং এর মূলমন্ত্র নিয়ে স্পষ্টকরণমূলক ব্যাখ্যা দেওয়ার তাগিদ বোধ করছি। উন্মুক্ততা, অন্তর্ভুক্তির প্রয়াস ও পারস্পরিক সুবিধা এর বৈশিষ্ট্য।</p> <p>বিআরআই কী?</p> <p>বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রস্তাব করা হয়েছে মহাদেশসমূহ ও দেশগুলোর মধ্যে সংযুক্তির কাঠামো তৈরি করার জন্য, যাতে উন্নয়নসহ বেশ কিছু বিষয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করা যায়। এর মূল ইতিহাস নিহিত পুরনো সিল্ক রোডে। সিল্ক রোড ইউরেশীয় অঞ্চলে নানা বাণিজ্যপথের সমন্বিত একটি ব্যবস্থা হিসেবে ২০০০ বছর আগে চালু হয়েছিল। এটি সন্নিহিত অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে রেশম, পোরসেলিন-পাত্র, মসলা, পানীয় ও অন্যান্য পণ্যের বাণিজ্য সম্প্রসারণ করেছিল। পূর্বাঞ্চলে চীন ছিল এ বাণিজ্য ব্যবস্থার সূচনাবিন্দু। চীন আবারও সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট ও একবিংশ শতকের ম্যারিটাইম সিল্ক রোড বেল্ট সৃষ্টিতে সূচনাকারীর ভূমিকা পালন করেছে। এসবের উদ্দেশ্য গোটা বিশ্বকে বাণিজ্য-প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট করা। বিআরআই বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলকে সংশ্লিষ্ট করে, উন্নয়নের বিভিন্ন ধাপকে সম্পর্কিত করে, বিভিন্ন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ধর্মকে সম্পর্কিত করে এবং বিভিন্ন প্রথা ও জীবনাচারকে সম্পর্কিত করে। এটি উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, সহযোগী ও শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের উদ্যোগ। এটি মানবজাতির সহযোগী ভবিষ্যিবষয়ক একটি কমিউনিটি গঠনের উপায়; অধিকতর ভালো বিশ্বব্যবস্থার চীনা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রক্রিয়া।</p> <p>বিস্তর পরামর্শ, যৌথ ভূমিকা ও সুবিধা বণ্টনের নীতি হচ্ছে এর ভিত্তি। পাঁচটি বড় ক্ষেত্রে, যেমন—নীতি-সমন্বয়, অবকাঠামো ও সুবিধাবলির সংযুক্তি, বাধাহীন বাণিজ্য, আর্থিক সহযোগ এবং নিবিড় নাগরিক-বন্ধন—সহযোগিতার মাধ্যমে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জন ও বণ্টনের পথ বাতলায় বিআরআই। নিঃসন্দেহে বড় অবকাঠামো প্রকল্প এবং বাণিজ্য ও বিনিয়োগকেন্দ্রিক সক্রিয় অর্থনৈতিক উদ্যোগ এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক। তবে সাংস্কৃতিক বিনিময়, প্রযুক্তি স্থানান্তর এবং নাগরিক-নাগরিক সংযোগের ক্ষেত্রেও এর অনেক কিছু করার আছে।</p> <p>চীনা দূতাবাসের উদ্যোগে ও বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগঠনের সহযোগিতায় ‘হ্যাপি চায়নিজ নিউ ইয়ার গালা’ বার্ষিক সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। ছয় বছর ধরে এ উৎসব আয়োজিত হচ্ছে। পর্যটন, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশিদের চীনে যাওয়া বিস্ময়কর হারে বাড়ছে। শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য প্রচুর চীনা পণ্ডিত ও বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশে আসছেন। সবই বিআরআইয়ের মৌলিক বিষয়াদির অংশ।</p> <p>বিআরআই কেন?</p> <p>দেড় শর বেশি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠন চীনের সঙ্গে বিআরআই সহযোগিতা দলিলে স্বাক্ষর করেছে। ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত চীন ও বিআরআই দেশগুলোর বাণিজ্য ছয় ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ওই সব দেশে চীনের বিনিয়োগ ৯০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে এবং দুই লাখ ৪৪ হাজারের বেশি স্থানীয় লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। বৈশ্বিক শান্তি ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী হয়ে উঠেছে বিআরআই। দিন দিন এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে; সারা বিশ্বে এর স্বীকৃতি বাড়ছে। এ কারণেই বিআরআই একত্রে অগ্রসর হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে আরো অনেক দেশ ও সংস্থার কাছে বিবেচিত হচ্ছে।</p> <p> </p> <p>প্রথম পর্বের গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশ এ উদ্যোগের সুফল পাওয়ার ক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে রয়েছে। ২০১৮ সালে চীন-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১৮.৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ওই বছর বাণিজ্য বৃদ্ধি হয়েছে ১৬.৮ শতাংশ। বলা চলে, এ বছর দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য-অংশীদার হবে বাংলাদেশ। জি-টু-জি প্রকল্পে বাংলাদেশ এখন চীনের প্রধান অংশীদার; চীনা বিনিয়োগের বড় গন্তব্যও। বাংলাদেশের জনগণের স্বপ্নের পদ্মা সেতু চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপের সহযোগিতায় পূর্ণোদ্যমে এগিয়ে চলেছে। চীনের অর্থ-সহায়তায় বাংলাদেশজুড়ে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, আগেও হয়েছে। আরো প্রকল্প অপেক্ষমাণ রয়েছে। চীন-বাংলাদেশ সহযোগিতা এখন সবচেয়ে দৃঢ়, যা বিআরআই-সহযোগিতার সত্যিকার সামর্থ্যের কথাই বলে।</p> <p>বিআরআই কি ঋণফাঁদ?</p> <p>যে অভিযোগ সচরাচর করা হয় সেটি হলো—বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বিশাল ঋণের বোঝা চাপিয়ে দেয়। কিছু দেশকে তাদের পরিশোধের সক্ষমতার অতিরিক্ত ঋণ দেয়। এর উদ্দেশ্য, দেশটির কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা অথবা কিছু পশ্চিমা মিডিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী ঋণের ফাঁদে ফেলা। অবশ্য এ অভিযোগ চীন অথবা সংশ্লিষ্ট দেশের কর্মকর্তারা বারবার নাকচ করেছে।</p> <p>শ্রীলঙ্কার উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী চীন থেকে নেওয়া তাদের ঋণ মোট ঋণের মাত্র ১০.৬ শতাংশ। এর ৬১ শতাংশের সুদহার আন্তর্জাতিক সুদহারের চেয়ে অনেক অনেক কম। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, পার্লামেন্ট স্পিকার ও বিরোধী দলের প্রধান—সবাই বলেছেন, তাঁদের বর্তমান ঋণের বড় অংশটি এসেছে বহুজাতিক ঋণসংস্থাগুলো থেকে, চীন থেকে নয়। বরং চীনের সহযোগিতা নিলে তাঁরা ঋণ-সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে একই কথা। তাদের মোট ঋণের মাত্র ১০ শতাংশ চীনের।</p> <p>মোদ্দা কথা, বিআরআই তার অংশীদারদের জন্য কোনো ঝুঁকি সৃষ্টি করবে না। এ উদ্যোগের ছয় বছরের কার্যক্রমে বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে।</p> <p style="text-align:right"><strong>লেখক: </strong>বাংলাদেশে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রদূত</p> <p style="text-align:right">ভাষান্তর ও সংক্ষেপণ: সাইফুর রহমান তারিক</p>