ঢাকা, মঙ্গলবার ১৮ মার্চ ২০২৫
৪ চৈত্র ১৪৩১, ১৭ রমজান ১৪৪৬

ঢাকা, মঙ্গলবার ১৮ মার্চ ২০২৫
৪ চৈত্র ১৪৩১, ১৭ রমজান ১৪৪৬

মিয়ানমারে টেকসই গণতন্ত্রের পক্ষে বিশ্ব

  • গাজীউল হাসান খান
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
মিয়ানমারে টেকসই গণতন্ত্রের পক্ষে বিশ্ব

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ-পূর্ববর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাঝেমধ্যে বাঙালির একটি জনপ্রিয় প্রবাদ উল্লেখ করতেন তাঁর বিভিন্ন জনসভার ভাষণে। তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে তিনি বলতেন, ‘বারবার ঘুঘু তুমি খেয়ে গেছ ধান, এইবার ঘুঘু তব বধিব পরান।’ মিয়ানমারের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দেশটির সামরিক কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামী ছাত্র-জনতা যেন সে প্রবাদবাক্যটি নিয়েই এখন সর্বত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলছে। তারা চেয়েছিল, তাদের প্রিয় নেত্রী অং সান সু চির নেতৃত্বে একটি নির্বাচিত সরকারের অধীনে দেশ পরিচালনা করতে।

দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা ঠেকিয়ে রাখার জন্য মিয়ানমারের সামরিক স্বৈরশাসকরা তৎপর রয়েছে। সামরিক স্বৈরশাসনের অধীনে মিয়ানমারে একটি বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করাই তাদের নীলনকশার মূল উদ্দেশ্য বলে দেশটির রাজনীতি কিংবা অধিকার সচেতন মানুষের বিশ্বাস। তাদের ধারণা, মূলত সে কারণেই গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য ও বাতিল ঘোষণা করেছে সামরিক বাহিনী।
দেশের নবনির্বাচিত প্রধান কর্মাধ্যক্ষ অং সান সু চিকে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেছে মিয়ানমারের জান্তা।

মিয়ানমারের মিলিটারি সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং দেশে সামরিক আইন জারি করেই নবনির্বাচিত নেত্রী অং সান সু চিসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তার করেছেন এবং অন্তরিন করেছেন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উইন মিনকে। সামরিক জান্তার অভিযোগ, গত নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ ছিল না। সে নির্বাচন নিরপেক্ষ ও কারচুপিমুক্তভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি।

তাই তারা (জান্তা) সে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল বলে ঘোষণা করেছে। সামরিক জান্তা নতুন নির্বাচন দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। তবে কবে ও কিভাবে অনুষ্ঠিত হবে সে নির্বাচন, তা এখনো উল্লেখ করেনি। এরই মধ্যে মিয়ানমারের জনপ্রিয় নেত্রী অং সান সু চিকে আদালতে তোলা হয়েছে। রাখা হয়েছে অন্তরিন অবস্থায়।
প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচিতদের স্থলাভিষিক্ত করে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার কাজ শুরু করা হয়েছে। মিয়ানমারে অতীতের সামরিক অভ্যুত্থান কিংবা হস্তক্ষেপের কথা ছেড়ে দিলেও গত দুই দশক সামরিক শাসকরা একটানা দেশ শাসন করেছে। তারা ১৯৯০ থেকে ২০২০ পর্যন্ত শাসনক্ষমতা ধরে রেখেছিল। তার পরও তারা একটি ১১ সদস্যের মিলিটারি স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কাউন্সিল গঠন করে তাদের রাজনৈতিক ও বিশেষ করে প্রশাসনিক প্রভাব বজায় রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল।

বিভিন্ন রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপ ও বাধ্যবাধকতার মধ্যে মিয়ানমারের জননেত্রী অং সান সু চি বিগত অর্ধদশক সেনানায়কদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছিলেন। সামরিক স্বৈরশাসকরা অং সান সু চির জনপ্রিয়তা এবং গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি জনগণের আস্থার কথা ভালো করেই জানতেন। রাজনীতি ও শ্রেণিগতভাবে তাঁরা ছিলেন এ অবস্থার ঘোর বিরোধী। অন্যান্যের মধ্যে তাদের একটি ধারণা জন্মেছিল, জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে দেশ রসাতলে যাবে, বিভিন্ন অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। এবং শেষ পর্যন্ত বহু বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র জাতিভিত্তিক সংঘর্ষ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মিয়ানমারের অখণ্ডতা ধরে রাখা যাবে না। তার প্রভাব প্রতিবেশী ভারত কিংবা এমনকি চীনেও পড়তে পারে। সে রাজনৈতিক বোঝাপড়াকে ভিত্তি করে বাণিজ্য ও সামরিক সাজসরঞ্জামের সরবরাহকে কেন্দ্র করে প্রতিযোগিতামূলকভাবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন ও ভারতের সঙ্গে মিয়ানমারের অপ্রকাশিত অথচ গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। কিন্তু বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৫ থেকে সু চির সঙ্গে সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে সে বছর অং সান সু চির রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি জাতীয় নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয় লাভ করেছিল। সে পরিস্থিতি কিংবা অবস্থাদৃষ্টে মিয়ানমারের ধূর্ত সামরিক গোষ্ঠী একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। নির্বাচিত দেশনেত্রী অং সান সু চির রাজনৈতিক বক্তব্য, কর্মকাণ্ড কিংবা গতিবিধির ওপর সামরিক গোষ্ঠী তীক্ষ নজর রাখছিল। শুরু থেকেই তারা তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ ছাড়া তারা তাদের হাতে যথেষ্ট ক্ষমতা ধরে রেখেছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। সংসদে এক-চতুর্থাংশ আসন তাদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল।

এই রাজনৈতিক অচলাবস্থা কিংবা পরিস্থিতিকে মিয়ানমারবাসী খুব একটা সহজভাবে নিতে পারেনি। তারা একটি দৃশ্যমান ও অর্থবহ পরিবর্তনের অপেক্ষায় ছিল। ২০১৫ থেকে ২০২০ সালকে ‘স্থিতিশীল গণতন্ত্রের আবির্ভাবকাল’ বলে মিয়ানমারবাসী উল্লেখ করে থাকে। সে জন্য রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে গত নভেম্বরের নির্বাচনটি ছিল তাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভের কারণে সু চি সামরিক শাসকদের কাছে নতুনভাবে মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ান। তারা দেখতে পায় একে একে তাদের সব আশঙ্কাও এখন দ্রুত সামনে এগিয়ে আসছে। সু চির বিপুল বিজয় দেশে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রত্যাশাকে সুদৃঢ় করে তুলছিল। একুশ শতকের মিয়ানমারের তরুণরা অত্যন্ত আধুনিক ও পাশ্চাত্যমুখী। এ ছাড়া গণতন্ত্রমনা ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। সে কারণে সারা মিয়ানমারে এখন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেছে। গত ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে শতাধিক আন্দোলনকারী সামরিক বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে। রেঙ্গুন, মান্দালয়সহ বিভিন্ন নগরীতে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। কখনো কখনো, বিশেষ করে সপ্তাহান্তে সারা রাত গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরা, কারখানার শ্রমিকরা এবং এমনকি অফিস-আদালতের কর্মচারীরা সামরিক শাসন ও শাসকদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে পড়েছে। তারা অবিলম্বে সু চির মুক্তির দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে রাখছে। তারা সু চির নিঃশর্ত মুক্তি এবং সামরিক শাসনের অবসান চায়। এরই মধ্যে নিশিকালীন কারফিউ প্রত্যাহার ও আন্দোলনকারীদের ঘরবাড়ি তল্লাশির মতো কাজগুলো বন্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে। সামরিক আইন প্রত্যাহার ও সভা-সমিতির ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নিতে সর্বাত্মক এক আন্দোলনে নেমেছে ছাত্র-জনতা।

মিয়ানমারের এবারের গণ-অসন্তোষ ও গণ-আন্দোলনের চরিত্র বেশ কিছুটা ভিন্ন প্রকৃতির বলে মনে করা হয়। ছাত্র-জনতা মিয়ানমারে আর সামরিক বাহিনীর ছড়ি ঘোরানো চলতে দিতে চায় না। ২০১৬-১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে সংঘটিত সহিংসতা এবং গণহত্যারও প্রতিকার কিংবা সমাধান চায় সংগ্রামী ছাত্র-জনতা। সামরিক জান্তার প্রতি চীনের সমর্থন কোনোভাবেই সমর্থন করে না প্রতিবাদী মানুষ। তাদের ধারণা, চীন ও ভারতের সমর্থনের কারণেই মিয়ানমারে সামরিক স্বৈরশাসন টিকে রয়েছে। তাই চীনের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন কারখানা ও শ্রমিকদের ওপর হামলা চালিয়েছে আন্দোলনকারীরা। এ অবস্থায় জাপান তাদের দুটি যৌথ মালিকানার কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সামরিক শাসক অং হ্লাইং ও তাঁর ঊর্ধ্বতন সহকারীদের বিরুদ্ধে। জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যবস্থা নিচ্ছে সামরিক শাসক ও মিয়ানমারের বাণিজ্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এ কথা ঠিক, সমগ্র মুক্তবিশ্ব এখন অং সান সু চির মুক্তি, সামরিক শাসনের অবসান এবং সর্বোপরি মিয়ানমারে একটি টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে। বর্তমান বিশ্বে সামরিক ব্যক্তিদের প্রভাবাধীন একমাত্র দেশ হচ্ছে এখন মিয়ানমার, যা সভ্য ও গণতান্ত্রিক বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম নাগরিককে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। তাদের প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা বছর গড়িয়ে গেলেও সুস্পষ্টভাবে কোনো পদক্ষেপই নিচ্ছে না এখনো। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। এভাবে আধুনিক যুগে একটি দেশ কিংবা একটি জাতি বেশিদিন চলতে পারে না। মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী সাধারণ মানুষ অবিলম্বে এর অবসান চায়। চীন ও ভারতের মতো শক্তিশালী দেশগুলো এটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারছে না, এমন নয়। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সার্বিক দিক থেকে উত্তরোত্তর চাপ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে গণতন্ত্রকামী মানুষ মনে করে। এভাবে এমন একটি পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তোলা যেতে পারে না। সামরিক জান্তাদের স্বৈরাচারী কার্যকলাপের অবসান হওয়া অত্যাবশ্যক। এ অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে হবে মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী মানুষকে। অতিদ্রুত প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে হবে বিদেশের মাটিতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের। মিয়ানমারের সংগ্রামী জনতা শূন্য হাতে এবার ঘরে ফিরবে না। তারা গণ-আন্দোলনের পাশাপাশি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। সুতরাং তাদের এবারের সার্বিক সংগ্রাম বিফলে যাবে বলে মনে হয় না।

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

gaziulhkhan@gmail.com

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

জাতি ও শ্রেণির প্রশ্নে বিভক্ত সমাজ

    সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
শেয়ার
জাতি ও শ্রেণির প্রশ্নে বিভক্ত সমাজ

জাতি ও শ্রেণির প্রশ্নে উপমহাদেশে এবং বাংলাদেশেও আমরা চার ধরনের চিন্তা ও দুশ্চিন্তার তৎপরতা দেখি। প্রথমটি জাতীয়তাবাদী, দ্বিতীয়টি উদারনৈতিক, তৃতীয়টি ধর্মীয় মৌলবাদী এবং ৪ নম্বরটি সমাজতান্ত্রিক। এদের ভেতর বিরোধ আছে, কিন্তু স্বল্প সন্ধানেই ধরা পড়বে যে মস্ত মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও প্রথম তিনটি একই ধারার এবং চতুর্থটি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকারের। জাতীয়তাবাদী, উদারনৈতিক ও ধর্মীয় মৌলবাদীরা একে অপরের থেকে দূরেই থাকে, মৌলবাদীরা তো অপর দুই পক্ষ থেকে খুবই দূরের, কিন্তু তবু অন্তর্গতভাবে তিন ধারাই এক ধারা এই অর্থে যে তিনটিই পুঁজিবাদে বিশ্বাসী।

পুঁজিবাদের ভেতরের খবরটি হলো সম্পত্তির ব্যক্তিমালিকানায় বিশ্বাস। সমাজতন্ত্র নানা রকমের হয় বলে প্রচার করা হয়ে থাকে, কিন্তু ওই মতবাদের কেন্দ্রে আছে ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার। সমাজতান্ত্রিক ধারাটি তাই অন্য তিন ধারার কেবল প্রতিপক্ষই নয়, শত্রুপক্ষও বটে। অন্যরা চায় শ্রেণিব্যবস্থাকে কোনো না কোনোভাবে রেখে দিতে, সমাজতন্ত্রীরা চায় সেটিকে ভেঙে ফেলতে।
মিলনের কোনো সুযোগই নেই।

জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন প্রকাশ ঘটে। তবে প্রধান প্রকাশ দুই রকমেরএকটি আগ্রাসনের, অপরটি আত্মরক্ষার। ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশের জাতীয়তাবাদ ছিল আগ্রাসনের, লক্ষ্য ছিল লুণ্ঠন; আর যে ভারতবর্ষীয়রা ব্রিটিশকে বিতাড়িত করে স্বাধীন হতে চাইছিল, তাদের জাতীয়তাবাদটি ছিল আত্মরক্ষার।

পার্থক্যটি স্পষ্ট, কিন্তু মিলটি এখানে যে দুই পক্ষের কোনোটিই পুঁজিবাদে অবিশ্বাসী ছিল না, শত্রু-মিত্র উভয় পক্ষই ছিল পুঁজিবাদী। ব্রিটিশরা এসেছিল সম্পদ লুণ্ঠন করে নিজেদের দেশে নিয়ে যাবে এই ইচ্ছায়, এখানে তারা ছিল আগ্রাসী জাতীয়তাবাদী। আর স্বাধীনতার জন্য যে জাতীয়তাবাদীরা লড়ছিল, তারা চাইছিল দেশের সম্পদ দেশে রাখবে। তবে সে সম্পদ যে সবার সমান অধিকারে থাকবে, তা নয়। তাদের দ্বারা যে জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হবে, তাতে শ্রেণিব্যবস্থা অক্ষুণ্ন থাকবে; যার অর্থ হলো যারা ধনী, তারা সুযোগ পাবে আরো ধনী হওয়ার।
আর যারা দরিদ্র, তারা যদি দরিদ্রতর হতে থাকে। তবে সেটি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ চলবে, তবে ব্যবস্থাটিকে ভাঙা চলবে না। মূল লড়াইটি আসলে ছিল দখলদার বিদেশি পুঁজিবাদীদের সঙ্গে উঠতি দেশি পুঁজিপন্থীদের।

জাতি ও শ্রেণির প্রশ্নে বিভক্ত সমাজদেশীয় জাতীয়তাবাদীদের ভেতরে সশস্ত্র বিপ্লবীরা ছিল। বিপ্লবী তারা এই অর্থে যে অহিংস নয়, সশস্ত্র; নইলে অহিংস গান্ধীবাদীদের সঙ্গে তাদের মৌলিক কোনো বিরোধ নেই। কারণ গান্ধীবাদীদের মতো তারাও ব্যক্তিগত সম্পত্তির পবিত্রতায় আস্থা রাখত। গান্ধী নিজে বিলাসিতাকে ঘৃণা করতেন, বস্তিতে থাকতে তাঁর অসুবিধা হতো না, কিন্তু তাঁর কাঙ্ক্ষিত রামরাজ্যে ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে না এমন অলক্ষুনে চিন্তাকে তিনি কখনো প্রশ্রয় দেননি। তিনি কংগ্রেসেরই নেতা। কংগ্রেসকে তিনি জনগণের কাছে নিয়ে গেছেন, কিন্তু জনগণের স্বার্থে নয়। কংগ্রেস ছিল বিত্তবানদের দল, তিনি তাদের স্বার্থই দেখতেন। শ্রমিক ও কৃষকরা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হোক, এটিও তাঁর কাম্য ছিল না। সমাজতন্ত্রীরা তখনো প্রবল হননি, কিন্তু ওই উঠতি সমাজতন্ত্রীরাও তাঁকে প্রীত করেনি, বিরক্তই করেছে। ওদিকে সহিংস বিপ্লবীরাও সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন চায়নি, তারা সনাতন ধর্মের পুনরুজ্জীবনে বিশ্বাস করত। এই বিপ্লবীদের অনেকেই আন্দামানে নির্বাসিত হয়েছিল। ১৯৩৭ সালে মুক্তি পেয়ে তাদের কেউ কেউ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিল। তাদের কথা আলাদা। বলা যায়, তারা একটি সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিল, যে কাজটি অন্যরা করতে পারেনি।

জওয়াহেরলাল নেহরু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে একসময় তিনি প্রায় কমিউনিস্টই হয়ে যাচ্ছিলেন, হতে পারলেন না। কারণ টের পেয়ে গেলেন যে কমিউনিস্টরা যথেষ্ট ভারতীয় নয়। দেখা যাচ্ছে, জাতীয়তাবাদ কতটা প্রভাব ফেলেছিল তাঁর ওপর; আর ওই জাতীয়তাবাদের কারণেই তিনি বাপুজির সঙ্গেই রয়ে গেলেন, যে বাপুজি আবার তাঁর নিজের পাশে রাখতেন বড় শিল্পপতি ঘনশ্যামদাস বিড়লাকেও। কমিউনিস্টদের শ্রেণিসংগ্রাম বাপুজির অনুসারী নেহরুর পছন্দ হওয়ার কথা নয়। নেহরু বছরের পর বছর কারাযন্ত্রণা ভোগ করতে পেরেছেন, তাই বলে শ্রেণিচ্যুত হয়ে যাবেন এবং সামাজিক বিপ্লবের পক্ষে লড়বেনএমনটি তাঁর পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। তাঁর রাজনীতি বুর্জোয়া গণতন্ত্রীরই। তাঁর শাসনামলে কমিউনিস্টরা যে সুবিধায় ছিল তা নয়, খুব অসুবিধায়ই ছিল।

স্বাধীনতার প্রশ্নে নেহরুর তুলনায় সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন অনেক বেশি অনমনীয়। গান্ধীর নেতৃত্বকে আপসকামী মনে করে সেটিকে পরিত্যাগ করে তিনি চলে গিয়েছিলেন সামরিক অভিযানের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ আধিপত্যের অবসান ঘটানোর পথে। সুভাষ বসু সমাজতন্ত্রের কথা ভাবতেন এবং ভারতবর্ষের সমস্যার পথ যে সমাজতান্ত্রিক, সেটিও মানতেন। কিন্তু তিনিও জাতীয়তাবাদীই ছিলেন; নেহরুর চেয়ে কম নয়, বরং বেশিই। তাই দেখি তিনি কংগ্রেস ছেড়ে ফরওয়ার্ড ব্লক গড়ছেন ঠিকই, কিন্তু ফরওয়ার্ড ব্লক কংগ্রেসের ভেতরই থেকে যাচ্ছে। গান্ধীকে জাতির পিতা উপাধি তাঁরই দেওয়া। সে জন্য এটি অস্বাভাবিক ছিল না যে সমাজতন্ত্রকে তিনি ভারতবর্ষীয় রূপ দিতে চাইবেন। তাঁর মতে, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের সমাজতান্ত্রিক পথটিই ছিল সঠিক, মার্ক্স-এঙ্গেলসের পথের তুলনায়। অর্থাত্ সমাজতন্ত্র থাকবে আবার ব্যক্তিমালিকানারও অবসান ঘটবে না। মালিকের সঙ্গে শ্রমিকের যে বিরোধ অনিবার্য ছিল, সেখানে তাঁর প্রবণতা মালিকের দিকেই ঝোঁকার। ঝুঁকেছেন যে তার দৃষ্টান্তও রয়েছে।

এটির উল্লেখ আছে মণি সিংহের আত্মজীবনীতে। ১৯২৮ সালের কথা। মণি সিংহ তখনো কমিউনিস্ট হননি, তবে শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। কলকাতার উপকণ্ঠে মেটিয়াবুরুজে বিড়লাদের পাটকলে শ্রমিকরা ধর্মঘট করেছে। পুলিশ ও মালিকের পোষা বাহিনীর যৌথ আক্রমণে শ্রমিকরা বিধ্বস্ত। এরই মধ্যে মালিকপক্ষ শ্রমিকদের এক সভা ডেকেছে; বিড়লারা যে মহত্, তাঁরা যে শ্রমিকের মা-বাবা এসব কথা বলার জন্য। মণি সিংহ তখন যুবক, বয়স ২৮; তিনি ধর্মঘটি শ্রমিকদের সঙ্গে ছিলেন। শোনা গেল মালিকপক্ষের সভায় সুভাষ বসু আসবেন, ধর্মঘটের বিরুদ্ধে বলার জন্য। শুনে মণি সিংহ ঘাবড়ে গেছেন। শ্রমিকরা তাঁকে সাহস দিয়েছে, বলেছে আপনাকে কিছু করতে হবে না, সুভাষ বসুর বক্তব্যের পর দাঁড়িয়ে শ্রমিকদের মত কী, তা জানতে চাইবেন। সুভাষ বসু ঠিকই এসেছিলেন। ধর্মঘট তুলে নেওয়ার পক্ষেই বলেছেন তিনি। শ্রমিকরা শুনেছে। শুনে চুপ হয়ে গেছে। শ্রমিক নেতারা চায়ের দোকান থেকে একটি টুল নিয়ে এসেছিল। মণি সিংহ সেটির ওপর দাঁড়িয়ে তাঁর জীবনে প্রথম এবং সংক্ষিপ্ততম বক্তব্যটি দিয়েছিলেন। ধর্মঘটের পক্ষে শ্রমিকদের শিখিয়ে দেওয়া কথা কয়টিই শুধু বলেছিলেন। এতেই কাজ হয়েছে। স্তব্ধতা ভেঙে শ্রমিকরা চিৎকার করে বলে উঠেছে, হরতাল চালু রহেগা। সভা পণ্ড হয়ে গেছে। হরতাল চালু থেকেছে। বিড়লারা সমঝোতায় এসেছেন।

সুভাষ বসু পুরোপুরি বাঙালি ছিলেন। রাজনীতিতে তাঁর প্রবেশ চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে। চিত্তরঞ্জনের চেষ্টা ছিল বাংলার রাজনীতিকে ভারতীয় রাজনীতি থেকে পৃথক রাখার; চেষ্টাও করেছিলেন, কিন্তু অকালমৃত্যুর দরুন কাজটা খুব একটা এগোতে পারেনি। বাংলার রাজনীতি যদি ভারতের রাজনীতি থেকে আলাদা থাকতে পারত, তাহলে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের জন্য অবশ্যই সুবিধা হতো এবং কংগ্রেস যে এক জাতিতত্ত্বের সাম্প্রদায়িকতাকে পুষ্ট করার কাজটা করছিল, সে কাজে কিছুটা হলেও বিঘ্ন ঘটত। সুভাষ বসুর বাঙালিত্ব কিন্তু বাংলার রাজনীতিকে সর্বভারতীয় রাজনীতির আওতামুক্ত করার কাজে উৎসাহের সঞ্চার করতে পারেনি, তিনি রয়ে গেছেন ভারতীয় রাজনীতিতেই। ১৯৪৬-৪৭-এ তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শরত্চন্দ্র বসু সর্বভারতীয় ওই রাজনীতি যে বাংলাকে খণ্ডিত করতে তৎপর হয়ে উঠেছিল, সেটা চোখের সামনে দেখতে পেয়েছেন। বাংলার অখণ্ডতা রক্ষার জন্য তিনি আবুল হাশিম ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে যুক্ত উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কাজটায় সুভাষ বসু সময়মতো যদি হাত দিতেন, তবে সেটা উপমহাদেশের জন্য মঙ্গলজনক হতো বলেই আমাদের ধারণা।

পরাধীন ভারতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা যে জাতীয়তাবাদী রূপ নেবে, সেটা ছিল অনিবার্য; তবে জনগণের মুক্তির আন্দোলন শক্তিশালী হতো, যদি তাতে সমাজতান্ত্রিক উপাদান কার্যকর থাকত। কিন্তু জাতীয়তাবাদী সংগ্রামটা সংগঠিতরূপে শুরুই হয়েছিল সমাজ বিপ্লবের সম্ভাবনাকে ঠেকানোর জন্য। ওই সূচনাটা ঘটে ১৮৮৫ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে। উদ্যোগটা এসেছিল একজন ব্রিটিশ আইসিএস অফিসারের দিক থেকে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন উঠতি ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধিরা। ব্রিটিশ শাসকরা খুবই ভয় পেয়ে গিয়েছিল, ১৮৫৭ সালের সিপাহি অভ্যুত্থান দেখে। তাদের দুশ্চিন্তা ছিল যে পরবর্তী কোনো অভ্যুত্থানে সাধারণ মানুষের সঙ্গে যদি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যুক্ত হয়ে যায়, তবে ফরাসি বিপ্লবের মতো ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে। মধ্যবিত্তকে তারা তাই কাছে টেনে নিতে চেয়েছে, মধ্যবিত্তের জন্য সুযোগ করে দিতে চেয়েছে অভাব-অভিযোগের দরখাস্ত নিয়ে হাজির হতে। বলা বাহুল্য, শ্রেণিগত কারণেই এই মধ্যবিত্ত ওপরের দিকে উঠতে চেয়েছে, তারা ভীষণ ভয় পেয়েছে নিচের দিকে নামতে। তারা ইংরেজকে ভয় করত, কিন্তু আতঙ্কিত হতো সমাজ বিপ্লবের আশঙ্কায়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সর্বভারতীয় জাতীয়তাকে প্রধান রাজনৈতিক সত্য করে তুলল। বলা বাহুল্য, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য প্রধান সমস্যাটা জাতিগত ছিল না, ছিল শ্রেণিগত; কৃষক শোষিত হচ্ছিল জমিদার ও মহাজনের হাতে, শ্রমিকদের শোষক ছিলেন পুঁজির মালিকরা, কিন্তু জাতীয়তাবাদী রাজনীতি শ্রেণিবাস্তবতাকে আড়ালে ঠেলে দিয়ে জাতীয় ঐক্যকে প্রধান করে তোলে; আমরা সবাই ভাই ভাই আওয়াজের নিচে চাপা পড়ে যায় ভাই ভাই ঠাঁই ঠাঁই-এর নিষ্ঠুর বাস্তবতা।

ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ প্রচার করল, বলল ঐক্যের কথা, কিন্তু সে ঐক্যের ভেতরে চাপা রইল না সাম্প্রদায়িকতা এবং ক্রমান্বয়ে ঐক্যের ভৌগোলিক দিকটাকে ছাপিয়ে উঠল ধর্মের দিকটা। সে ধর্ম সনাতন ধর্ম। রণধ্বনি উঠল বন্দেমাতরমের, যার ফলে নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবারের পাল্টা আওয়াজ ওঠার পটভূমিটা তৈরি হয়ে গেল। যে শাসকরা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস গঠনে উৎসাহ জুগিয়েছিল, তারাই আবার উৎসাহ দিল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ গঠনের। চেষ্টা শুরু হলো সম্প্রদায়কে জাতিতে পরিণত করার। শুরুতে ভোট ছিল শতকরা মাত্র দুজনের; তারই মধ্যে বিভাজন দাঁড় করানো হলো হিন্দু-মুসলমানের পৃথক নির্বাচনের। পরিণামে কী ঘটেছে, সেটা তো আমরা জানি। সমাজতন্ত্রীরা সংগঠিত হচ্ছিল, তাদের আওয়াজ ছিল ইনকিলাব জিন্দাবাদ, বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক। হিন্দু-মুসলমানকে তারা নিয়ে আসতে চেয়েছে বিপ্লবের পক্ষে, কিন্তু তাদের আওয়াজটা জোরদার হয়নি। কারণ ছিল। প্রধান কারণ জাতীয়তাবাদীদের গলার জোর। তারা বিত্তবান, নেতারা উচ্চশিক্ষিত, সংবাদপত্র তাদের পক্ষে। ব্রিটিশ শাসকরাও তাদের উৎসাহ দিয়েছে। উঠতি জাতীয়তাবাদীরা ব্রিটিশকে ভয় পায়, কিন্তু আরো বড় ভয় তাদের কৃষককে, কারণ জমিদারি ব্যবস্থার সুবিধাগুলো তারা ভোগ করে। তারাই আবার পেশাজীবী, ব্যবসা-বাণিজ্যও তারাই করে। এর মধ্যে কৃষক যদি খেপে ওঠে, তাহলে তো সর্বনাশ। সে জন্য শ্রেণি হিসেবে সমাজ বিপ্লবের অনুমোদন তারা তো দেয়ইনি, উল্টো যতভাবে পারা যায় ওই ধরনের বিপ্লবের বিরোধিতা করেছে। অন্য ব্যাপারে প্রবল শত্রুতা থাকলেও বিপ্লববিরোধিতার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ স্বার্থ আর ভারতীয় বিত্তবানদের স্বার্থ এক হয়ে গেছে; যেন বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মিলন, অভিন্ন এক শত্রুর বিরুদ্ধে।

 

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

শিল্প-কারখানা চালু রাখতে হবে

    মো. আবু জাফর সামছুদ্দিন
শেয়ার
শিল্প-কারখানা চালু রাখতে হবে

শিল্প-কারখানা দেশের সম্পদ, জনগণের সম্পদ। শিল্প-কারখানা ধারাবাহিক কর্মসংস্থানের প্রধান উৎস। শিল্প-কারখানা কাঁচামালকে পণ্যে রূপান্তর করে, মানুষের অভাব পূরণ করে, সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করে এবং বিশ্বের বিভিন্ন মত ও পথের মানুষের দৈনন্দিন অভাব পূরণ করে। দেশের সীমানা পার হয়ে শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত পণ্য সমগ্র পৃথিবীর মানুষের অভাব পূরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।

শিল্প-কারখানার মাধ্যমে রচিত হয় সমগ্র পৃথিবীর মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধ। মানবসভ্যতার এক বিশাল ভূমিকায় অবদান রয়েছে শিল্প-কারখানার। শিল্প-কারখানা ছাড়া কৃষিপণ্য রূপান্তর করা সম্ভব নয়। ফলে শিল্পের বিকাশ বন্ধ হলে কৃষি খাত অব্যবহৃত থেকে যাবে এবং কৃষিক্ষেত্রেও কর্মসংস্থান সংকুচিত হবে, যার পরিণতিতে বেড়ে যাবে বেকারত্ব।

শিল্প-কারখানার মালিক কে? আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে একজন উদ্যোক্তাই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক। কিন্তু বিষয়টি অন্যভাবে চিন্তা করা যায়। একজন উদ্যোক্তা তাঁর শুধু নিজস্ব পুঁজি দিয়ে শিল্প-কারখানা স্থাপন করেছেন এমন অনুপাত নিতান্তই নগণ্য। আর্থিক প্রতিষ্ঠান শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য অর্থায়ন করে থাকে।

তাহলে আমরা কি বলতে পারি শিল্প-কারখানার মালিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, উত্তর না। আর্থিক প্রতিষ্ঠান আপামর জনতার কাছ থেকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সঞ্চয় একীভূত করে তহবিল গঠন করে সেই তহবিল শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ করে। তাহলে শিল্প-কারখানার মূল মালিক একটি দেশের আমানতকারীরা, যাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয় ওই শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই শিল্প-কারখানার মালিক জনগণ।  

কর্মসংস্থান এবং বাজারব্যবস্থা সমন্বয়ের জন্য সব অর্থব্যবস্থায় ও সরকারি উদ্যোগে শিল্প-কারখানা স্থাপিত হয়ে থাকে।

মালিক কি সত্যি সরকার? না, সরকার ওই শিল্প-কারখানা স্থাপন করে থাকে জনগণের কাছ থেকে সংগৃহীত ট্যাক্সের অর্থ থেকে অথবা জনগণের কাছ থেকে ঋণ করা অর্থ থেকে। সেই শিল্প-কারখানার মালিকও জনগণ।

শিল্প-কারখানা চালু রাখতে হবেপরোক্ষ মালিকানার বিষয়টি ছাড়াও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের চালিকাশক্তি জনগণ। জনসাধারণ শ্রম ও সেবা প্রদান করে শিল্পপ্রতিষ্ঠান সচল রাখে। জীবিকার একটি প্রধান উৎস হিসেবে বেছে নেয় শ্রমিক ও সেবা প্রদানকারী আপামর জনগণ।

প্রতিটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য সরকার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সুবিধা প্রদান করে। জনগণের ট্যাক্স থেকেই সরকার ওই সুবিধা প্রদান করে। সব বিষয় বিবেচনায়ই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক জনগণ।

কিছু সময় ধরে শিল্পোদ্যোক্তা রাজনৈতিক দলের সক্রিয় সদস্য হিসেবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার নজির লক্ষণীয়। রাজনৈতিক পরিচয়ের মাধ্যমে নির্ধারিত হতো শিল্পোদ্যোক্তাদের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও ব্যাংক থেকে গৃহীত ঋণের পরিমাণ। অধিকন্তু উদ্যোক্তারা পুঁজিবাজারের সদস্যভুক্ত কিভাবে হবেন এবং কতটা ঝামেলামুক্তভাবে ব্যবসা করতে পারবেন তার নির্ধারকও ছিল রাজনৈতিক পরিচয়। সরকারি দলের বাইরে কোনো শিল্পোদ্যোক্তা নানা নিপীড়নের মাধ্যমে কোনো রকম নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হতেন। কোনো কোনো ব্যবসায়ী নিজের মতাদর্শকে বিলীন করে দিয়ে ব্যবসার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট দলের সদস্য হয়ে যেতেন। তাহলে ব্যবসায়ীসমাজ মোটামুটিভাবে পুরোটাই হতে হবে সরকারি দল। এতে ওই সরকার যত দিন ক্ষমতায় টিকে থাকবে, তত দিন পর্যন্ত তিনি ঝামেলামুক্তভাবে তাঁর ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারবেন। আর ভিন্নমতাবলম্বীরা প্রতিকূলতার মাঝে টিকে থাকার জন্য চেষ্টা করবেন।  

রাজনৈতিক ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যবসায়ীর ওপর নেমে আসে বিভিন্ন ধরনের হয়রানি, যা তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যকে আবার ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়। ফলে তাঁকে নানা দিকের উপদ্রব সহ্য করতে হয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যবসা বেদখল হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ব্যবসার দীর্ঘদিনের টানাপড়েনের মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি, যার পরিণতিতে ধীরে ধীরে খেলাপি ঋণগ্রহীতার তালিকায় তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নতুন ঋণের সংস্থান করতে ব্যর্থ হন। গ্যাস, বিদ্যুত্, অবকাঠামো সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন এবং শিল্পের সংকোচন হয়। রাজনৈতিক টানাপড়েনের শেষ ধাক্কাটা আসে আপামর জনতার ওপর। ভোক্তা ও আমানতকারীর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে ভাটা পড়তে শুরু করে। 

ব্যক্তির নিজস্ব রাজনৈতিক মতামত থাকতে পারে। এটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার একটি মৌলিক উপাদান। ব্যবসায়ী বলে তাঁকে সব সময় সরকারি দল করতে হবে এমনটি হওয়া উচিত নয়। শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে দেখতে হবে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মতো, যা দেশের প্রতিটি ব্যক্তির সম্পদ। 

রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে যেকোনো পরিবর্তনে শিল্প-কারখানাকে দুর্বল করার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কৌশল দৃশ্যমান। লুটপাট, ভয়ভীতি প্রদর্শন, অসহনীয় চাঁদাবাজির ফলে দুর্বল হয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ভিত। এ কাজের সঙ্গে সত্যিকার অর্থে কোনো রাজনৈতিক দলের সম্পৃক্ততা না থাকলেও স্বার্থান্বেষীচক্র এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে।

কখনো ভীতসন্ত্রস্ত মালিক আত্মগোপন করেন আবার কখনো মূলধন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাবে বন্ধ হয়ে যায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান।

জিডিপির প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের প্রয়োজনে সব প্রতিষ্ঠান সচল রাখতে হবে। কোনো রপ্তানিকারী শিল্প-কারখানা বন্ধ হলে আন্তর্জাতিক বাজার হারানোর আশঙ্কা থাকে। বিরূপ প্রভাব পড়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে। অভ্যন্তরীণ বাজারে বিপণনযোগ্য পণ্যসামগ্রী উৎপাদন বন্ধ হওয়ার ফলে দেশের অভ্যন্তরে সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়ে। এই সুযোগগুলোকে লুফে নেবে সংশ্লিষ্ট পণ্যের রপ্তানিকারক দেশগুলো। বিরূপ প্রভাব পড়বে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠান; যথাব্যাংকিং ব্যবস্থা এবং পুঁজিবাজারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার এই দুঃসময়ে যদি ১০ শতাংশ শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে ভেবে দেখতে হবে আমাদের জিডিপির ওপর কী নেতিবাচক প্রভাব পড়ে? এর ওপর যদি ১০ শতাংশ লোক নতুন করে বেকারত্বের কবলে পড়ে, তাহলে কী পরিমাণ সামাজিক অবক্ষয় নেমে আসবে, তা অনুমান করা সত্যি অনেক কঠিন। হাজারো অব্যবস্থাপনাকে মোকাবেলায় সরকার এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে, তার ওপর যদি অনিবারণযোগ্য সমস্যা সরকার ও জনগণের সামনে উপস্থিত হয়, তাহলে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ভেঙে পড়বে এবং দেশ একটি নিয়ন্ত্রণহীন রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

অপরাধী যে পরিচয়েরই হোক না কেন, তাকে আইনের মুখোমুখি করা প্রয়োজন। ব্যক্তির অপরাধের প্রভাব প্রতিষ্ঠানের ওপর পড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আপামর জনগণ তথা রাষ্ট্র।

আমাদের দেশে এখনো শক্তিশালী করপোরেট কালচার গড়ে ওঠেনি। তাই একটি শক্তিশালী দক্ষ ব্যবস্থাপনা পর্ষদ গঠন করে হলেও শিল্প-কারখানার উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। এ জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সমন্বয়ে আপৎকালীন ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট নিয়োগ করা যেতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তা এবং দক্ষ ও সত্ পেশাদার ব্যক্তিদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠান সচল রাখার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সেনাবাহিনীর মাধ্যমে দক্ষ ও পেশাদার ব্যক্তিদের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন এবং বণ্টনের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সফল ও দক্ষ সমগোত্রীয় উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে অথবা সংশ্লিষ্ট ট্রেড বডির সমন্বয়ে শিল্প-কারখানা সচল রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় আমাদের মানবসম্পদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কারিকুলাম তাত্ত্বিকের পরিবর্তে প্রায়োগিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা সময়ের দাবি। শিক্ষাব্যবস্থায় করণিক সৃষ্টির বিপরীতে নির্বাহী ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর দেশের শিল্প-কারখানা পরিচালনার জন্য বিদেশ থেকে দক্ষ জনবল আমদানি করা সত্যি আমাদের জন্য সম্মানজনক নয়।

আমাদের দেশের সব শিল্প-কারখানা সচল রাখতে হবে। উদ্যোক্তা হতে পারেন রাজনৈতিক, শিল্প-কারখানা অরাজনৈতিক। রাজনীতি কোনো অপরাধ নয়। রাজনীতির আবরণে অপরাধীচক্র এবং সুবিধাভোগীরা আইনের মুখোমুখি হোক, এটি জনগণের প্রত্যাশা। অন্যদিকে জনগণের সম্পদ শিল্প-কারখানাকে সবার ঊর্ধ্বে স্থান দিয়ে দেশের উৎপাদন, কর্মসংস্থান এবং সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এ দেশ হোক রপ্তানিমুখী দেশ, অন্য দেশের বাজার নয়। সব শিল্পপ্রতিষ্ঠান সচল থাকবে, এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ব্যাংকার্স ক্লাব অব বাংলাদেশ লিমিটেড

afarcu88@gmail.com

 

মন্তব্য

জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর গুরুত্বপূর্ণ

    এ কে এম আতিকুর রহমান
শেয়ার
জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর গুরুত্বপূর্ণ

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এ মাসের ১৩ তারিখ বিকেলে চার দিনের এক সফরে বাংলাদেশে আসেন। তাঁর এই সফর মূলত বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য হলেও বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও তিনি আলাপ-আলোচনা করেন। ১৪ তারিখ সকালে তিনি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং দুপুরের পর কক্সবাজারে অবস্থিত রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনে যান। সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতারে অংশ নেন আন্তোনিও গুতেরেস ও ড. ইউনূস।

সন্ধ্যার পর তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। পরের দিন জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয় পরিদর্শন ছাড়াও তিনি নাগরিক সমাজের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওই দিন তাঁর সম্মানে প্রধান উপদেষ্টার আয়োজিত ইফতার ও নৈশভোজেও তিনি যোগ দেন। ১৬ তারিখে সকালের দিকে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন।
     

দুই.

১৪ তারিখে জাতিসংঘ মহাসচিব কক্সবাজার বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রোহিঙ্গা শিবিরে চলে যান। সেখানে রোহিঙ্গা শিশুদের সঙ্গে একটি অনুষ্ঠানে কিছুটা সময় কাটানো ছাড়াও তরুণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁকে রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও পুষ্টি সংক্রান্ত সর্বশেষ পরিস্থিতিসংক্রান্ত একটি প্রেজেন্টেশন দেখানো হয়। তিনি রোহিঙ্গাদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের বিভিন্ন কর্মসূচিও পর্যবেক্ষণ করেন।

এরপর তিনি এক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বক্তব্য দেন। ওই বক্তব্যে তিনি যেমন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন, তেমনি এক গভীর মানবিক সংকটের উপনীত হওয়ার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি যেমন বলেছেন, তারা বাড়ি ফিরে যেতে চায়। মায়ানমার তাদের মাতৃভূমি। নিরাপদে, স্বেচ্ছায় এবং মর্যাদাপূর্ণভাবে ফিরে যাওয়াই এই সংকটের প্রাথমিক সমাধান।
তেমনি রাখাইন রাজ্যসহ মায়ানমারের পরিস্থিতি ভয়াবহ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, রাখাইনে সংঘাত এবং পদ্ধতিগত নিপীড়ন শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের অবশ্যই যাদের সুরক্ষার প্রয়োজন, তাদের সহযোগিতা করতে হবে।

জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর গুরুত্বপূর্ণজাতিসংঘ মহাসচিব ২০২৪ সালের মানবিক সহায়তার তুলনায় ২০২৫ সালে ওই সহায়তা ৪০ শতাংশ হ্রাস পাওয়ার ঝুঁকি প্রসঙ্গে বলেন, এটি একটি নিরবচ্ছিন্ন বিপর্যয় হবে। তিনি বাংলাদেশে আশ্রিত ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গার জন্য বিশ্ববাসীর সাহায্য-সমর্থনের খুবই প্রয়োজন রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি মায়ানমারে কয়েক দশক ধরে চলমান বৈষম্য ও নিপীড়ন এবং রাখাইনে জেনোসাইডের কথা তুলে ধরেন। মানবাধিকারের নৃশংস লঙ্ঘন থেকে বাঁচতে যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছে, সে কথাও তিনি বলেন। তাঁর বক্তব্য থেকে এটি স্পষ্ট যে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর পাশাপাশি অনেক মানবিক ও উন্নয়নমূলক এনজিও বিশাল তহবিল হ্রাসের ঝুঁকির মুখোমুখি হওয়ায় তার ভয়াবহ প্রভাব পড়বে মানুষের ওপর, যারা সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। সাহায্য তহবিল কাটছাঁট হলে মানবিক ক্ষতি হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে শরণার্থীদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য পরিস্থিতি অনুকূল না হওয়া পর্যন্ত আমরা হাল ছাড়ব না। পরিস্থিতি যতক্ষণ অনুকূল না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি যতক্ষণ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের পাশে না দাঁড়ায়, ততক্ষণ এই ইস্যুতে কথা বলে যাওয়ার আশ্বাস দেন।   

আমরা জানি, রোহিঙ্গা শিবিরগুলো সফরকালে জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা শিশু, তরুণ, মহিলাসহ বিভিন্নজনের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় সবাই রাখাইনে ফেরার প্রবল আকুতি ব্যক্ত করে। এ ছাড়া তারা রাখাইনে ফেরার আগ পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ আর কাজের সুযোগের বিষয়গুলো জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে তুলে ধরে। অন্যদিকে মাথাপিছু রেশন মাসে সাড়ে ১২ ডলার থেকে ছয় ডলারে নেমে আসায় তাদের বেঁচে থাকাটাই যে কঠিন হয়ে পড়েছে, তা-ও তারা জানায়।

তিন.

জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফরের কার্যক্রম শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে ১৪ মার্চ। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, তাঁর সরকারের নেওয়া বিভিন্ন সংস্কার পদক্ষেপ, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, রোহিঙ্গা ইস্যু, বিশ্বে শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা, আঞ্চলিক রাজনীতি ইত্যাদি সম্পর্কে জাতিসংঘ মহাসচিবকে অবহিত করেন। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় নিয়ে কথা বলেন। তিনি তাঁর সরকারের গৃহীত সংস্কারপ্রক্রিয়া এবং সেসবের বাস্তবায়ন সম্পর্কে জাতিসংঘ মহাসচিবকে জানান। তিনি উল্লেখ করেন যে ওই সব সংস্কার বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করবে জাতীয় নির্বাচন এ বছর, না আগামী বছর আয়োজন করা যাবে। প্রধান উপদেষ্টা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার ব্যাপারে তাঁর সরকারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন। জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে নেওয়া সংস্কার কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস দেন এবং আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে এই সংস্কারপ্রক্রিয়া একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং দেশের একটি বাস্তব রূপান্তর নিশ্চিত করবে।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গারা যাতে মায়ানমারের পশ্চিম রাখাইনে তাদের নিজেদের ভিটামাটিতে ফিরে যেতে পারে সে ব্যাপারে জাতিসংঘ মহাসচিবের সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি রোহিঙ্গারা যত দিন বাংলাদেশে থাকবে, ততদিন যাতে তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও মানবিক সহায়তা অব্যাহত থাকে সে বিষয়ে নিশ্চয়তা চান। জাতিসংঘ মহাসচিব রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন এবং তাদের জন্য সহায়তা সংগ্রহকে অগ্রাধিকার দেবেন বলে জানান। তিনি কক্সবাজারে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা কমে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, পৃথিবীতে এতটা বৈষম্যের শিকার অন্য কোনো জনগোষ্ঠী আমি দেখিনি। মানবিক সহায়তা কমানো একটি অপরাধ উল্লেখ করে তিনি বলেন যে পশ্চিমা দেশগুলো প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় দ্বিগুণ করলেও মানবিক সহায়তা হ্রাস করছে। জাতিসংঘ মহাসচিব জানান যে তিনি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন এবং তাদের জন্য সহায়তা সংগ্রহকে অগ্রাধিকার দেবেন।

জাতিসংঘ মহাসচিব বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বৈঠকে ভূ-রাজনীতি, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক জোট সার্কের বর্তমান অবস্থা এবং বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নানা দিক নিয়েও আলোচনা হয়।

চার.

১৫ তারিখে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বাংলাদেশ সফর করতে পেরে আনন্দিত বলে জানান। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এক বিরাট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি জানান, বৃহত্তর পরিসরে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার এবং সমৃদ্ধির ভবিষ্যতের জন্য জনগণের আশাকে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। তিনি বলেন, একটি ন্যায়সংগত, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে বাংলাদেশের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, আমি আপনাকে আশ্বস্ত করছি যে জাতিসংঘ শান্তি, জাতীয় সংলাপ, আস্থা এবং ঐকমত্যে সহায়তা করতে প্রস্তুত রয়েছে। সবার জন্য একটি টেকসই এবং ন্যায়সংগত ভবিষ্যত্ গড়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে কাজ করে আপনাদের অবিচল অংশীদার হিসেবে জাতিসংঘের ওপর নির্ভর করতে পারেন।

মায়ানমারে লড়াই বন্ধ করা ও সেখানে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মায়ানমারের সব প্রতিবেশী দেশের চাপ বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি বলে জাতিসংঘ মহাসচিব উল্লেখ করেন। তিনি এটি শুধু বাংলাদেশের জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মায়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে সম্মিলিতভাবে বিষয়টি সমাধানের জন্য কাজ করার আহ্বান জানান। আর এ জন্য প্রথম ধাপে সহিংসতা বন্ধ করে একই সঙ্গে এমন কার্যকর ব্যবস্থা গঠন করা, যাতে মায়ানমারে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাধানের পথ সুগম হয়, যা স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনকে সহজ করবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আরো বলেন, একই সঙ্গে আমাদের মায়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা জোরদার করতে হবে, যাতে প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়।

পাঁচ.

১৫ মার্চ বিকেলে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তাঁরা পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সৃষ্ট সম্ভাবনা এবং উদ্বেগ নিয়ে খোলাখুলিভাবে কথা বলেন। অপতথ্য আর বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়। প্রতিনিধিদলের কথায় দীর্ঘদিনের দুঃশাসনের ফলে কাঠামোগত পরিবর্তন হলেও সুশাসন প্রতিষ্ঠা না হওয়ার উল্লেখ করে নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ বাংলাদেশের জনগণের এসব অংশের লোকজনের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার বিষয়গুলো উঠে আসে।

জাতিসংঘ মহাসচিব তাঁদের কথা অত্যন্ত ধৈর্যসহকারে শোনেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি জটিল। তবে ব্যবসা, বিনিয়োগের জন্য নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। তবু বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কিছু বিষয়ে তাঁর আরো জানা প্রয়োজন। বিদ্যমান পরিস্থিতি যে জটিল, তিনি এবার বাংলাদেশ সফরে এসে মতবিনিময়ের পর বুঝেছেন। তাই তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের সংলাপ অব্যাহত রাখতে হবে।

ছয়.

রোহিঙ্গা ইস্যুটির দুটি দিক বেশি গুরুত্বপূর্ণতাদের জন্মভূমিতে সুষ্ঠু, নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসন এবং প্রত্যাবাসন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানকালে তাদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা। বাস্তবতার ভিত্তিতে বলতে গেলে এই দুই ক্ষেত্রই সংকটে পড়েছে। প্রত্যাবাসন হয় হয় করে সেই যে ঝুলে গেছে, সেই জট খুব তাড়াতাড়ি খুলবে বলে মনে হয় না। মায়ানমারের জান্তা সরকার, সর্বোপরি সেখানকার অভ্যন্তরীণ সহিংস পরিস্থিতি কবে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করবে, যাতে রোহিঙ্গাদের সঠিকভাবে প্রত্যাবাসন করা যাবে, তা কেউ বলতে পারবে না। অতএব আমাদের দ্বিতীয় সমস্যার দিকেই দৃষ্টি দিতে হবে, যাতে বাংলাদেশের আশ্রয়ে যত দিন আছে, তাদের অসুবিধা না হয়। তবে এর অর্থ এই নয় যে তাদের প্রত্যাবাসনের প্রচেষ্টা বন্ধ করে দিতে হবে। আমাদের একা নয়, বিশ্ববাসীকে নিয়েই এর সমাধান করতে হবে। তবে বর্তমান আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ কতটুকু এগোতে পারবে সে প্রশ্নটি থেকেই যায়। যা হোক, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে চাই, রোহিঙ্গারা যেন আগামী বছর মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের নিজ বাড়িতে ফিরে গিয়ে ঈদ উদযাপন করতে পারে, সে লক্ষ্যে জাতিসংঘের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করছি।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য খুবই গুরুত্ব বহন করে। অন্যদিকে তিনি নিজে বিভিন্ন আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের চলমান ঘটনাগুলো যেমন দেখলেন এবং জানলেন, তা জাতিসংঘের বাংলাদেশ সম্পর্কে ভবিষ্যত্ সাহায্য-সহযোগিতার সমীকরণ নির্ণয়ে অবশ্যই সহায়ক হবে।  

 

লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব

মন্তব্য

পুতিনের শর্তেই শেষ হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ

    মাহবুব আলম
শেয়ার
পুতিনের শর্তেই শেষ হচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ

ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা শুরু হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত মাসে (১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫) রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে এক দীর্ঘ টেলিফোন সংলাপের মধ্য দিয়ে এই আলোচনার সূচনা করেন। এরপর সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে ও তুরস্কের ইস্তাম্বুলে রুশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে মার্কিন কর্মকর্তারা মুখোমুখি বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে উভয় দেশের পক্ষ থেকে আলোচনাকে সন্তোষজনক মন্তব্য করে যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তিচুক্তির লক্ষ্যে আরো আলোচনা করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

সেই আলোচনাও শুরু হয়েছে। তবে কী শর্তে এই যুদ্ধ বন্ধ হবে, তা কোনো পক্ষই স্পষ্ট করেনি। এ বিষয়ে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভ বলেছেন, রাশিয়া এরই মধ্যে ইউক্রেনের যে চারটি প্রদেশ দখল করে রুশ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে, তাকে রুশ ভূখণ্ড হিসেবেই স্বীকৃতি দিতে হবে। সেই সঙ্গে ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য হবে না, নিরপেক্ষ থাকবে—এই মর্মে ইউক্রেনকে অঙ্গীকার করতে হবে।
আর ক্রিমিয়ার ওপর রাশিয়ার সার্বভৌমত্বকে মেনে নিতে হবে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই শর্তের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এখনো কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে এটি স্পষ্ট যে রুশ শর্তের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের আপত্তি নেই। আলোচনার পর মার্কিন কর্মকর্তারা সেই ইঙ্গিতই দিয়েছেন।

অবশ্য এই ইঙ্গিত নতুন কিছু নয়। ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মার্চ ও এপ্রিলে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ানের নেতৃত্বে ইস্তাম্বুলে যে যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তির আলোচনা শুরু হয়, তখনো এই ইঙ্গিত দেওয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা কূটনীতিক হিসেবে পরিচিত হেনরি কিসিঞ্জার ইউক্রেনকে কিছু ভূখণ্ড ছেড়ে দিয়ে অবিলম্বে শান্তিচুক্তি সম্পাদনের কথা বলেন। ওই বছর ২৪ মে সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বৈঠকে কিসিঞ্জার আবারও তাঁর কথার পুনরাবৃত্তি করেন। তিনি বলেন, অহেতুক হানাহানি না বাড়িয়ে ইউক্রেনের উচিত রাশিয়ার দাবি মেনে নেওয়া।

রাশিয়া যে জায়গা দখল করেছে তার মালিকানা ছেড়ে দেওয়া। তিনি আরো বলেন, যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে রাশিয়াকে পরাস্ত করা তো দূরের কথা, নিজের অস্তিত্ব নিয়েই হুমকির মুখে পড়বে ইউক্রেন। সেই সময় ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি ও একটি শান্তিচুক্তির বিষয়ে সম্মত হলেও শেষ মুহূর্তে চুক্তি স্বাক্ষর করা থেকে বিরত হয়। এ ঘটনার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, ‘আজ হোক, কাল হোক শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইউক্রেনকে বেদনাদায়ক আঞ্চলিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ অর্থাৎ শান্তির লক্ষ্যে ইউক্রেনকে তার নিজ ভূখণ্ড রাশিয়ার কাছে ছেড়ে দিতে হবে।

উল্লেখ্য, সেই সময় যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাশিয়ার শর্ত ছিল—১. ক্রিমিয়ার ওপর রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব মেনে নিতে হবে। ২. ইউক্রেনকে নিরস্ত্রীকরণ ও নাৎসি প্রভাব থেকে দূরে রাখতে হবে এবং ৩. দেশটির নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে।

ওই সময় শান্তিচুক্তির স্বার্থে রাশিয়া তার সামরিক অভিযানের লাগাম টেনে ধরে। কিয়েভ থেকে সেনা প্রত্যাহার করে এবং চেরনোহির দখল ছেড়ে দিয়ে সেনাদের রুশ সীমান্তের কাছে ফিরিয়ে নেয়। এ বিষয়ে তৎকালীন রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী আলেকজান্ডার ফোবিন বলেন, ‘সমঝোতার পথ তৈরির জন্য সেনা সরানো হয়েছে।’ সমঝোতা হলেও শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন শান্তিচুক্তিতে সই করা থেকে বিরত থাকে এরই মধ্যে এ বিষয়টি উল্লেখ করেছি।

সেই সময় যা ঘটেছিল তা হলো—২৯ এপ্রিল ইস্তাম্বুলে একটি শান্তিচুক্তির বিষয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেন সম্মত হয়। এবং পরদিন ৩০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে এই চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। ওই ঘোষণার এক ঘণ্টার মধ্যে পেন্টাগনের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, শান্তি আলোচনা রাশিয়ার কূটকৌশল। ওয়াশিংটন এই কূটকৌশলের ফাঁদে পা দেবে না। ভণ্ডুল হয়ে গেল শান্তি আলোচনা। টেবিলেই পড়ে থাকে চুক্তির খসড়া।

তারপর দীর্ঘ লড়াই। তিন বছরের রক্তক্ষয়ী লড়াই। এই লড়াইয়ে রাশিয়া ইউক্রেনের লুহানস্ক, দোনেত্স্ক, জাপোরিঝিয়াসহ চারটি প্রদেশ ও ইউক্রেনের মোট ভূখণ্ডের এক-পঞ্চমাংশ দখল করে নিয়েছে। এই ভূখণ্ডের পরিমাণ এক লাখ ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটারের বেশি। স্বাভাবিকভাবেই বদলে গেছে রাশিয়ার যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তির শর্ত। কারণ এই সময়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের দখলকৃত এলাকাকে রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করে ডিক্রি জারি করেছেন। অবশ্য গণভোট করে ওই অঞ্চলের জনগণের মতামত নিয়ে।

এখানে উল্লেখ্য, রাশিয়ার সেনারা যে অঞ্চল দখল করেছে, তা রুশ ভাষাভাষী অঞ্চল। এই অঞ্চলের দুটি প্রদেশ লুহানস্ক ও দোনেত্স্ক আগে থেকেই স্বাধীনতার দাবিতে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল।

রাশিয়ার শর্তের বিষয়ে ইউক্রেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের তীব্র আপত্তি রয়েছে, কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন এই আপত্তিকে পাত্তাই দিচ্ছে না। ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্ত হচ্ছে, যত দ্রুত সম্ভব এই যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, এই যুদ্ধের জন্য অতীতের বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনকে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য হিসেবে যে অর্থ দিয়েছে, সেই অর্থও ফেরত চাইছে। এ জন্য ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেনের মাটির তলায় যে মূল্যবান খনিজ সম্পদ রয়েছে, তা উত্তোলনের দাবি করেছে। দাবি করেই ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষান্ত হয়নি, অবিলম্বে এ বিষয়ে চুক্তি সম্পাদনের আহবান জানিয়েছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে। কার্যত এ লক্ষ্যেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৮ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জেলেনস্কি বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে দুই নেতার বাগবিতণ্ডা ঝগড়ায় পরিণত হয়। ফলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁকে হোয়াইট হাউস থেকে বের করে দেন। হোয়াইট হাউস থেকে বেরিয়ে জেলেনস্কি ছুটে যান ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে। ইউরোপীয় মিত্ররা তাঁর পাশে থাকার আশ্বাসও দেন। এতে ক্ষিপ্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইউক্রেনকে প্রদত্ত সব সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধের ঘোষণা দেন। সেই সঙ্গে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহও বন্ধ করে দেন। ফলে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি হোয়াইট হাউসের ঘটনার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে খনিজ সম্পদ চুক্তি সই করতে তাঁর সম্মতির কথা জানিয়েছেন। আরো জানিয়েছেন, যুদ্ধ বন্ধের ও একটি শান্তিচুক্তির বিষয়ে আলোচনা করতেও তিনি প্রস্তুত। এই প্রস্তুতির অংশ হিসেবে তিনি রিয়াদে সৌদি যুবরাজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। সর্বশেষ ১১ মার্চ জেদ্দায় মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বৈঠক করেছেন।

একটি বিষয়ে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে মার্কিন সাহায্য ছাড়া শুধু ইউরোপের সাহায্য নিয়ে ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে না। উল্লেখ্য, ইউক্রেন যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে দিয়েছে ৬৫.৯ বিলিয়ন ডলারের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য। সেখানে ইউরোপের সব দেশ মিলে দিয়েছে ৬৪.৯ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য। আর প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাঁর মেয়াদের শেষ সময়ে নতুন করে যে ৫৪ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য ঘোষণা করেন, তা আটকে দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।

এই অবস্থায় ইউক্রেনের সামনে যুদ্ধবিরতির আলোচনায় আসা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। তবে যুদ্ধবিরতি ও একটি শান্তিচুক্তি সম্পাদনে কত দিন লাগবে, তা এই মুহূর্তে বলা কঠিন। অবশ্য এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিকল্প চিন্তা-ভাবনাও শুরু করেছেন। তিনি জেলেনস্কিকে স্বৈরাচারী আখ্যা দিয়ে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করার চিন্তা-ভাবনা করেছেন। এ বিষয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনও একমত। পুতিন বেশ কিছুদিন ধরে বলে আসছেন জেলেনস্কির প্রেসিডেন্সির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাই তাঁর সঙ্গে আর কোনো আলোচনা নয়। আলোচনা হবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা হলো যুদ্ধের জন্য প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ইউক্রেনে সামরিক আইন জারি করেছেন। ইউক্রেনের আইন অনুযায়ী সামরিক শাসনের মধ্যে কোনো নির্বাচনের বিধান নেই। তার পরও এ বিষয়ে পর্দার অন্তরালে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে।

মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালৎস বলেছেন, ‘আমাদের এমন একজন নেতার প্রয়োজন, যিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করবেন, যিনি রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করবেন, যিনি যুদ্ধ থামাতে পারবেন।’ মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টার এই বক্তব্যের পর ইউক্রেনের ক্ষমতাচ্যুত আগের প্রেসিডেন্ট পেত্রো পেরেশেংকো ওয়াশিংটন সফর করেছেন। এই পেরেশেংকো রুশপন্থী হিসেবে পরিচিত ও প্রভাবশালী নেতা। তবে জনপ্রিয়তার নিরিখে তাঁর চেয়ে এগিয়ে আছেন সাবেক সেনাপ্রধান ভ্যালেরি জালুঝনি, বর্তমান গোয়েন্দাপ্রধান কিরিল দাদভ ও বিরোধী দলের নেতা লিমোশেংকো। এককথায় ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধের জন্য প্রয়োজনে ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে দেওয়া হবে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। কারণ রাশিয়া একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। তাকে পরাস্ত করার পরিণাম যে ভালো হবে না, এটি একজন বোকাও বোঝে। তাইতো বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই যুদ্ধকে অহেতুক যুদ্ধ বর্ণনা করে যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছেন। সেই সঙ্গে রাশিয়ার সঙ্গে বৈরিতার পরিবর্তে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর তাই রাশিয়ার শর্তেই শেষ হচ্ছে তিন বছরব্যাপী রক্তক্ষয়ী ইউক্রেন যুদ্ধ।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ