<p>নৃশংস করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে ভয়ংকর বিপদে বিশ্বমানবতা। করোনা শুধু প্রাণঘাতীই নয়, জীবিকাখেকোও। যে মানুষটির একসময় কাজ ছিল, আয় ছিল, সুন্দর সাজানো সংসার ছিল; করোনার থাবায় কাজ হারিয়ে তিনি এখন পথের ভিখারি। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি ও অক্সফাম বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে ‘করোনাকালে আয় ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতি : কিভাবে মানুষগুলো টিকে আছে’ শীর্ষক খানা জরিপে প্রকাশ করোনার কারণে গত এক বছরে ৬২ শতাংশ মানুষ তাদের কাজ হারিয়েছে। অনেকে আবার কাজ শুরু করতে সক্ষম হলেও কমেছে বেশির ভাগের আয়। করোনায় আয়ের ওপর সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের। তাদের আয় কমেছে ২২ থেকে ২৮ শতাংশ। যে মানুষটি কোনো দিন হাত পাতেননি, জঠরজ্বালা সইতে না পেরে লজ্জাশরম পায়ে ঠেলে তিনিও দিশাহারা হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন।</p> <p>সব ধর্মই বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর তাগিদ দিয়েছে। বাইবেলে ঘোষিত হয়েছে : ‘আর্তপীড়িত মানবতার প্রতি দয়া প্রদর্শন করা শ্রেষ্ঠ কর্তব্য।’ হিন্দু ধর্মে মানবতার সেবাকে ঈশ্বর সেবা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধর্মের এক অবতার চণ্ডীদাস বলেছেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপর কেহ নাই।’ স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, ‘নারায়ণ তথা ভগবান দরিদ্রদের মাঝে অবস্থান করেন, তাই দরিদ্রদের সেবার মাধ্যমে নারায়ণের সেবা সম্ভব।’ ইহুদি ধর্মে বলা হয়েছে, ‘নিজের খাবার ক্ষুধার্তের সঙ্গে ভাগ করো, গৃহহীনকে আশ্রয় দাও, বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দাও এবং সাহায্যপ্রার্থী আত্মীয় থেকে পলায়ন করো না।’ (ঈসায়ী, ৫৮:৭)</p> <p><img alt="" src="/ckfinder/userfiles/images/print/2021/05.May/12-05-2021/kalerkantho-ed-1a.jpg" style="float:left; height:300px; margin:12px; width:340px" />ইসলামে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে কোরআন ও হাদিসে বারবার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বিপদগ্রস্ত অভাবীদের সাহায্য করাও ইবাদত। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তাদের (বিত্তশালী) ধন-সম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’ (সুরা জারিয়াত : ১৯)। পবিত্র কোরআনে অন্যত্র মহান রব বলেন, ‘তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি তথা তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দরিদ্র, এতিম ও বন্দিদের খাদ্য দান করে।’ (সুরা দাহর : ৮)। এ ধরনের মানবিক কর্তব্য পালন রাত জেগে অবিরাম নফল নামাজ আদায় ও অবিরত নফল রোজার সমতুল্য। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বিধবা ও অসহায়কে সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর সমতুল্য।’ (বর্ণনাকারী বলেন) আমার ধারণা, তিনি আরো বলেন, ‘এবং সে ওই সালাত আদায়কারীর ন্যায়, যার ক্লান্তি নেই এবং ওই সিয়াম পালনকারীর ন্যায়, যার সিয়ামে বিরাম নেই।’ (বুখারি, ৬০০৭; মুসলিম, ৭৬৫৯) করোনার এই সংকটপূর্ণ মুহূর্তে ইসলাম আমাদের শেখায় মানবিক হতে। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে। অভুক্ত ব্যক্তিকে আহার্য দেওয়ার বিষয়ে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘মানুষের কল্যাণসংশ্লিষ্ট যত কাজ আছে, তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম হচ্ছে দরিদ্র ও ক্ষুধার্তকে খাবার দান করা।’ (বুখারি, ১২) রাসুল (সা.) ঘোষণা করেছেন, ‘একটি রুটি দানের কারণে তিন ব্যক্তিকে জান্নাতে পাঠানো হবে। ১. আদেশদাতা, ২. রন্ধনকর্তা, ৩. সেই পরিবেশনকর্তা, যে রুটি নিয়ে গরিবকে পরিবেশন করেছে।’ (হাকিম, তাবারানি) পবিত্র কোরআনের বহু জায়গায় মহান আল্লাহ তাআলা গরিব, অসহায় ও মিসকিনদের খাবার দান করার কথা বলেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তাকে দুটি পথ প্রদর্শন করেছি। অতঃপর সে দুর্গম গিরিপথে প্রবেশ করেনি। আপনি জানেন, সেই দুর্গম গিরিপথ কী? তা হচ্ছে দাসমুক্ত করা কিংবা দুর্যোগ ও সংকটের দিনে এতিম আত্মীয়-স্বজন ও ধুলো-ধূসরিত মিসকিনদের অন্ন দান করা।’ (সুরা বালাদ : ১০-১৬) আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম দিকে তোমাদের মুখ ফেরানোই সৎকর্ম নয়, কিন্তু সৎকর্ম হলো যে ব্যক্তি আল্লাহ, শেষ দিবস, ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ ও নবীগণের প্রতি ঈমান আনবে, আর সম্পদ দান করবে, তাঁর ভালোবাসায় আত্মীয়-স্বজন, এতিম, অভাবগ্রস্ত, মুসাফির, সাহায্যপ্রার্থী ও দাসমুক্তির জন্য এবং...’ (সুরা বাকারা : ১৭৭) দান করলে আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিদান পাওয়ার বিষয়ে হয়েছে, ‘যারা দিন-রাত প্রকাশ্যে ও গোপনে তাদের ধন-সম্পদ দান করে, তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের কাছে পুরস্কার রয়েছে; তাই তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা কোনো দুঃখও পাবে না।’ (সুরা বাকারা : ২৭৪) কোরআনে আরো বলা হয়েছে, ‘...তোমরা যা কিছু দান করো তা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করো, আর যা কিছু তোমরা দান করো, তার পুরস্কার পুরোপুরি প্রদান করা হবে।’ (সুরা বাকারা : ২৭২) দান দোজখের আগুন থেকে বাঁচায়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘...খেজুরের একটি অংশ দান করে হলেও তোমরা দোজখের আগুন থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করো।...’ (মুসলিম, ২২২১) দান করার দ্বারা ইহকালেও উপকার পাওয়া যায়। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘অবশ্যই দান-সদকা মানুষের হায়াত বৃদ্ধি করে। অপমৃত্যু থেকে বাঁচায় এবং অহমিকা দূর করে।’ (আল-মুজামুল কাবীর, ১৩৫০৮)। অন্য হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘দান আল্লাহর অসন্তুষ্টি লাঘব করে...।’ (তিরমিজি, ৬৬৪) ইসলামের দর্শন হচ্ছে গোটা সৃষ্টিকুল একটি পরিবারের মতো। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘হে মানুষ! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদের বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পারো।...।’ (সুরা হুজুরাত : ১৩) অন্য ধর্মের মানুষ এ সত্যকে অস্বীকার করবে কিভাবে সব মানবজাতি এক পরিবারভুক্ত? কল্পনা করে দেখুন, আপনি দামি পোশাক পরে রংবেরঙের খাবার খাচ্ছেন, আর একজন পরিবারপ্রধান পরিজনের জন্য পোশাক ক্রয় দূরে থাক, ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য সামান্য খাবার জোগাড় করতে ব্যর্থ হয়ে লজ্জায় বিমর্ষ হয়ে আছেন। আপনার হৃদয়ে একটুও কষ্ট অনুভব করেন না এ জন্য? মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, ‘The world has enough for everyone's needs, but not everyone's greed.’ হতে পারে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বণ্টন প্রক্রিয়ায় আমাদের কারো পাল্লায় বেশি জমা হয়েছে। এখন সুযোগ এসেছে বঞ্চিতদের সঙ্গে ভাগ করে কিছুটা ভারসাম্য তৈরি করার। জীবন-মৃত্যুর ব্যবধান একটুখানি করোনার স্পর্শ। মৃত্যু ওত পেতে রয়েছে আমাদের পাশেই। মৃত্যু যখন অত্যাসন্ন হবে। মৃত্যুপথযাত্রী যখন মৃত্যুকে সামনে দেখতে পাবে, তখন মৃত্যুপথযাত্রী কী বলবে সে বিষয়ে পবিত্র কোরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘মৃত্যু আসলে সে বলবে, হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আরো কিছু সময়ের জন্য অবকাশ দিলে, আমি সাদকা করতাম এবং সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। কিন্তু নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে, তখন আল্লাহপাক কাউকে অবকাশ দেবেন না।’ (সুরা মুনাফিকুন : ৯-১১)</p> <p>মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সমাজে সেই মানুষেরই একটা অংশ করোনার থাবায় অভুক্ত, অসহায়। তারা হাহাকার করছে, রোদন করছে। তারা আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গরিব-দুস্থসহ সমাজের আশ্রয়হীন, দুর্বল ও অসহায় মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য সব ধর্মেই তাগিদ দেওয়া হয়েছে। মানবিক বিপর্যয় ও দুর্যোগ মোকাবেলায় বিপদাপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে আর্তের সেবায় প্রত্যাশিত ভূমিকা রেখে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এখনই সুবর্ণ সময়।</p> <p>লেখক : অধ্যাপক, আইন বিভাগ</p> <p>চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p>zhossain1965@gmail.com</p>