<p>কিশোর অপরাধ আজ বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় অন্যতম চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী ১৮ বছরের কম বয়সী যেকোনো মানুষ যখন কোনো অপরাধে লিপ্ত হয়, তখন সেই অপরাধকে কিশোর অপরাধ বলে। ‘কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি’ কিশোর অপরাধের একটি নতুন দিক। ‘নাইন স্টার’ গ্যাংয়ের সদস্যরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্ব্বী সংগঠন ‘ডিস্কো বয়েজ’-এর সদস্যকে ছুরিকাঘাত করার পর ২০১৭ সালের গোড়ার দিকে রাজধানীতে কিশোর গ্যাংগুলোর কার্যক্রম প্রকাশ্যে আসে। এ ধরনের ঘটনাগুলো, বিশেষ করে ঢাকায় ‘গ্যাং কালচার’-এর উত্থান এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে তরুণ-তরুণীদের সম্পৃক্ততার চিত্র তুলে ধরে। গ্যাংগুলোর অদ্ভুত নামগুলো পড়ে যে কেউ অবাক হতে পারে; বিচিত্র সব নাম, যেমন—লারা দে, ফিল্ম ঝিরঝির, দেখ চিনে লো, কোপাইয়া দে, ডিস্কো বয়েজ, ছোটন গ্রুপ, পাওয়ার বয়েজ, নাফিজ ডন, বিগ বস, ডার্ক শ্যাডো ইত্যাদি। এ রকম ৫০টির মতো গ্যাং ঢাকায় তাদের অপরাধকর্ম করছে বলে পুলিশ ও র‌্যাব জানিয়েছে। আতঙ্কের ব্যাপার হলো, প্রায় আট হাজার থেকে ১০ হাজার কিশোর-কিশোরী বর্তমানে এসব গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত ও বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড, যেমন—ছিনতাই, মাদকাসক্তি ও মাদকের চোরাচালান, ইভ টিজিং, হত্যাসহ বিভিন্ন ভয়াবহ অপরাধ করছে।</p> <p>কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির পেছনের কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা বিভিন্ন উপাদান দেখতে পাই, যেগুলো কিশোর অপরাধের অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে মনে করা হয়। কিশোর অপরাধ বৃদ্ধির পেছনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে ধরা হয় পরিবারের ভূমিকাকে। বর্তমানের শিশু-কিশোররা ইউটিউব, ভায়োলেন্ট গেমস, পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে যাচ্ছে এবং এসব আসক্তিই মূলত তাদের মধ্যে ডেভিয়েন্ট বিহেভিয়ার (Deviant Behavior)বা সমাজবিচ্যুত ব্যবহারকে প্ররোচিত করে। এ ছাড়া আমরা গঠনমূলক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে যুক্ত করতে পারছি না। ফলে তারা নেতিবাচক ও সমাজবিচ্যুত কাজে আরো বেশি আগ্রহী হয়ে উঠছে। অনেক সময় মা-বাবারা প্রাইভেসি বা পার্সোনাল স্পেসের জন্য সন্তানদের আলাদা কক্ষে থাকতে দিচ্ছে এবং তাদের ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন দিচ্ছে। তাদের কক্ষে তারা কী করছে সেটি খেয়াল রাখছে না। একজন শিশুর বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বিভিন্ন উপাদান কাজ করে, যেগুলো পরবর্তী সময়ে শিশুকে ভালো অথবা অপরাধমূলক কাজে উৎসাহিত করে। যেমন—মা-বাবার মধ্যে যদি সব সময়ই উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্ক থাকে, তাঁদের মধ্যে যদি পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সম্মানসূচক সম্পর্ক না থাকে, তাঁরা যদি সব সময়ই ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত থাকে, তাহলে সন্তানরা এই ধরনের নেতিবাচক ব্যবহার থেকে সব কিছু শিখে বড় হয়। এটিকে আমরা বলি ‘সোশ্যাল লার্নিং থিওরি  (Social Learning Theory)’, যেখানে মূলত শিশুরা তাদের বেড়ে ওঠার সময় আশপাশের মানুষের ব্যবহার ও তাদের কাজগুলো দেখে এবং শেখে। তার ব্যবহারের একটি বড় অংশ হলো ‘সোশিয়ালি লার্নেড বিহেভিয়ার  (Socially Learned Behaviour)’ বা সামাজিকভাবে শেখা আচরণ, যেটি তারা অর্জন করে মা-বাবা, সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং সমাজব্যবস্থা থেকে। এ ছাড়া বর্তমানে আমরা দেখছি মাদকের করাল গ্রাসে কিশোর ও যুবসমাজ ভয়াবহভাবে পতিত, সম্প্রতি যার বলি হতে হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুরকে। পরিবার থেকে যথাযথ নির্দেশনা এবং সামাজিক নজরদারির অভাব আমাদের সন্তানদের ভায়োলেন্ট, মাদকাসক্ত করে তোলার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। তারই ফলস্বরূপ আমরা দেখছি নয়ন বন্ড, অপু ভাই, ঐশীদের মতো অপরাধীরা নৃশংস হতেও পিছু হটেনি। কিশোর গ্যাংয়ের দিকে আমরা তাকালে দেখতে পাই যে তাদের মধ্যে সহিষ্ণুতা একেবারে নেই বললেই চলে। আমরা এটাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বলি ‘সোশ্যাল ক্রাইমস’ এবং এর অনেক কারণ আছে, যার মধ্যে একটি হচ্ছে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া এবং অপরটি হচ্ছে এক্সপোজার- অপরাধগুলোর প্রতি আমরা কতখানি এক্সপোজ হচ্ছি। যে মানুষটি দেখে এসেছে বাসায় সব সময় এ ধরনের ক্রাইম হচ্ছে অথবা সহিংস আচরণ হচ্ছে, তার কিন্তু প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে সহিংস হওয়ার। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ‘সোশ্যাল রেসপন্স’। একটা সময় খুব ছোটখাটো অপরাধের ক্ষেত্রেও কিন্তু সমাজ কঠোর নেতিবাচক সাড়া দিয়েছে। এখন আমরা প্রত্যেকের জীবনকে স্বতন্ত্রকরণ ও একক জীবনে নিয়ে গিয়েছি। অর্থাৎ আমাদের সামাজিক সংহতি কমে গিয়েছে। ফলে সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকছে এবং আশপাশের মানুষরা কী করছে সেদিকে লক্ষ রাখছে না।</p> <p>তা ছাড়া রাজনৈতিকভাবেও এসব কিশোর অপরাধীকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পাতিনেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংগুলো গড়ে ওঠে এবং তারা বিভিন্ন নৃশংস অপরাধ করতেও সাহস পায়। এসব ১৮ বছর বা তাদের চেয়েও কম বয়স্ক কিশোররা ভালো-খারাপ কাজের পরিণাম কী হতে পারে সেটা বোঝে না। ফলে সেসব সুবিধাবাদী নেতারা তাঁদের অবৈধ ও হত্যাকাণ্ডের মতো নৃশংস কাজগুলো কিশোর অপরাধীদের দিয়েই করাচ্ছেন তাঁদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য।</p> <p>আমাদের বর্তমান সমাজে পাঠাগার, বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কার্যক্রম কমে গিয়েছে এবং সেটিকে দখল করে নিয়েছে মোবাইল ফোন ও আধুনিক প্রযুক্তি। ফলে বিভিন্ন নেতিবাচক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা দেখছি ফেসবুক, টিকটক, লাইকির মতো সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীরা বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িয়ে যাচ্ছে, এমনকি নারীপাচারের মতো ঘটনাও ঘটছে। আরেকটা কারণ হচ্ছে, সোশ্যাল ডেমনস্ট্রেশন অ্যাফেক্ট, যখন কোনো নাটক-চলচ্চিত্রে কোনো একটি ক্রাইমকে দেখানো হয়, সেটা যে রকম ডিটেইলিং করে দেখানো হয় সেটা থেকে কিন্তু তরুণ-কিশোররা যারা কি না এ ধরনের ক্রাইমের কথা কখনো ভাবেনি তারাও কিন্তু সেটা শিখে যায়। সুতরাং মিডিয়ার একটা অনেক বড় ধরনের ভূমিকা আছে এখানে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো অপরাধকে ফ্যান্টাসাইজ করা, অপরাধকে হিরোইজমের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া।</p> <p>এখন আসা যাক আমাদের আইন ও বিচারব্যবস্থায়। বাংলাদেশে বর্তমানে আটটি আইন সরাসরিভাবে শিশু-কিশোরদের অপরাধ, তাদের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছে। যদি কোনো কিশোর বা কিশোরী আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়, তবে তাকে কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে পাঠানো হয়। তবে কিশোর অপরাধীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার তুলনায় এজাতীয় কেন্দ্রের সংখ্যা কখনো পর্যাপ্ত নয়। তাদের জন্য সারা দেশে শুধু তিনটি সংশোধন কেন্দ্র রয়েছে। তদুপরি আমাদের কিশোর সংশোধন কেন্দ্রগুলোতে অনেক সমস্যা রয়েছে। এই কেন্দ্রগুলো প্রতিষ্ঠার প্রধান লক্ষ্য ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীদের সঠিক পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দেওয়া, যাতে তারা সংশোধন পদ্ধতি অনুসরণ করে সুস্থ ও স্বাভাবিকভাবে সমাজে প্রত্যাবর্তন করতে পারে। তবে অভিযোগ রয়েছে যে এই কিশোর-কিশোরীদের সংশোধনের পরিবর্তে এসব কেন্দ্রের কর্মকর্তারা নানাভাবে নির্যাতন করেন। তাঁরা বিভিন্ন বয়সের কিশোর-কিশোরীদের আলাদা করে রাখেন না। এমনকি তাঁরা তাদের পর্যাপ্ত খাবার, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয় না।</p> <p>কিশোর অপরাধ নির্মূলে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পরিবারের গুরুত্ব ও দায়িত্ব ুঅপরিসীম। কারণ পরিবারই হলো একটি শিশুর বেড়ে ওঠার প্রাথমিক প্রতিষ্ঠান। পরিবার যদি সন্তানদের ব্যবহার ও আচরণ গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে, সন্তানের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কী কী দরকার সে অনুযায়ী যদি তারা তাদের লালন-পালন করে, তাহলে সেগুলো একটি সুস্থ ও সুন্দর জীবন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আমাদের সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক আয়োজন বাড়াতে হবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রকে শিশুবান্ধব নীতি তৈরি করতে হবে। সরকার ও রাষ্ট্র যদি শিশুবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে পারে, শিশু উন্নয়নকেন্দ্রগুলোর উন্নয়ন সাধন ও সেখানে শিশু চারিত্রিক উন্নয়নমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে এবং শিশুর জন্য উপযোগী বিনোদনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে, তাহলে কিশোর অপরাধ কমে যাবে। অন্যদিকে কিশোর অপরাধীসহ শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলার পাশাপাশি বিভিন্ন সাইকোলজিক্যাল সেমিনার ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করা যেতে পারে। যেহেতু শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতির উন্নয়নের অন্যতম পরিচায়ক, তাই আমাদের কারিকুলামে পরিবর্তন এনে সেখানে নৈতিক শিক্ষার দিকে বেশি জোর দিতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের গ্যাং গঠন এবং সংঘবদ্ধ হতে ও গুরুতর অপরাধ সংঘটন করতে উৎসাহ দেয় এবং প্রভাবক হিসেবে কাজ করে এমন সব কারণ শনাক্ত করতে হবে। সর্বোপরি প্রাসঙ্গিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি এবং সে অনুযায়ী যদি প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে অচিরেই এ ধরনের অপরাধ দমন করা সম্ভব।</p> <p> </p> <p>লেখক : চেয়ারম্যান, অপরাধবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p>kfrahman@du.ac.bd</p> <p> </p>