<p>প্রায় দুই বছর ধরে সারা বিশ্বই যুঝছে কভিড নামের অতিমারির সঙ্গে। জীবনসংহারী এ রোগে দেশে দেশে দেখা গেছে-যাচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। যাঁরা বেঁচে গেছেন, যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের জীবনের সমীকরণও ওলট-পালট করে দিয়েছে-দিচ্ছে এই অতিমারি। স্বাস্থ্য ছাড়াও সামাজিক রীতিনীতি, সংস্কৃতি, শিক্ষাব্যবস্থা, অর্থনীতি—কোথায় ছাপ পড়েনি এর? করোনাভাইরাস সর্বগ্রাসী থাবা নিয়ে এগিয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে, তছনছ করেছে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র, পাল্টে দিয়েছে জীবনধারা, উৎপত্তি ঘটাতে বাধ্য করেছে ‘নতুন স্বাভাবিকতা’ ধারণার। এর রেশ ধরে পরিবর্তিত হচ্ছে মানুষের মনোজগৎ, সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়ছে ব্যক্তি ও সামগ্রিকভাবে সমাজের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। গতকাল কালের কণ্ঠে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, করোনার সময় মানসিক চাপে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন।</p> <p>কভিড রোগটির প্রাণনাশী ক্ষমতার কারণে নিজেই এক আতঙ্ক এবং ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ব্যাপক নেতিবাচক এক চাপ। এই রোগের কারণে নিকটজনের মৃত্যু, বেঁচে যাওয়া ব্যক্তির রোগ ও অপ্রতুল-অপ্রস্তুত স্বাস্থ্যসেবার অভিজ্ঞতা, হাসপাতাল ও আইসিইউতে মৃত্যু-বেদনা-কান্নার প্রত্যক্ষ দর্শন—সব কিছুই মানসিক স্বাস্থ্যকে ভঙ্গুর করার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া এই রোগ প্রতিরোধে নেওয়া ব্যবস্থাগুলো—আইসোলেশন, কোয়ারেন্টিন, শারীরিক দূরত্ব মেনে চলাসহ নানা স্বাস্থ্যবিধি, রোগের পরোক্ষ প্রভাবে বেড়ে যাওয়া বেকারত্ব, ভেঙে পড়া অর্থনীতি, স্থবির শিক্ষাব্যবস্থা, সুস্থ বিনোদনের সুযোগ সংকোচন—সব কিছুই মানসিক সমস্যা বৃদ্ধির অন্যতম নিয়ামক। বিভিন্ন দেশের গবেষণায় দেখা গেছে, কভিডকালীন মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা ও রোগ বেড়েছে ব্যাপক হারে। আমেরিকার নাগরিকদের ওপর পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, গবেষণায় অংশগ্রহণকারী প্রায় অর্ধেক নাগরিকই বলেছেন, তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে কভিড অতিমারি। ফলে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের প্রয়োজন পড়ছে আগের চেয়ে বেশি।</p> <p>বাংলাদেশে কভিডের কারণে মানসিক সমস্যা বা রোগের হার কতটা বেড়েছে সে ব্যাপারে জাতীয় পর্যায়ে উপসংহার টানার মতো গবেষণার অভাব থাকলেও ক্ষুদ্র পর্যায়ে এবং শিক্ষার্থীসহ নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ওপর পরিচালিত বেশ কিছু জরিপ ও গবেষণায় কভিডকালীন এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, বিষণ্নতায় আমাদের জনগণও যে আক্রান্ত হচ্ছে এবং আক্রান্তের হারটি যে শঙ্কাজনক, তা ফুটে উঠেছে।</p> <p>প্রসঙ্গত, ২০১৮-১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগিতায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে দেশব্যাপী পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ১৬.৮ শতাংশ কোনো না কোনো মানসিক রোগে ভুগছে। ১৮ বছরের বেশি যাঁদের বয়স, তাঁদের ৬.৭ শতাংশ বিষণ্নতা এবং ৪.৫ শতাংশ উদ্বেগজনিত রোগে ভুগছেন। অথচ আক্রান্তদের ৯২ শতাংশেরও বেশি মানুষ বিজ্ঞানসম্মত কোনো মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাননি বা নেননি। উদ্বেগ, বিষণ্নতাসহ বেশির ভাগ মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিই কিন্তু তাঁদের যে সমস্যা বা কষ্ট হচ্ছে—তা নিজেরাই বুঝতে পারেন। কিন্তু এই বুঝতে পারা সত্ত্বেও তাঁরা চিকিৎসা নিতে যান না। কারণ সমস্যা বুঝলেও সেটা যে ‘মানসিক রোগ’ তা তাঁরা বুঝতে পারেন না। আবার অনেকে নিজের সমস্যাকে ‘মানসিক’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারলেও মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের কাছে যান না। ভাবেন, লোকে কী বলবে! শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মাঝেও এই প্রবণতা দেখা যায়। মানসিক রোগে আক্রান্ত অনেক ব্যক্তিই চিকিৎসকের কাছে যান না, পরিবারও তাঁকে চিকিৎসা না করিয়ে ব্যাপারটি গোপনই রাখতে চায়। কারো কাছে আবার মানসিক রোগের লক্ষণ ইচ্ছাশক্তির দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ। কখনো কখনো শারীরিক উপসর্গ যে মানসিক রোগের কারণে হতে পারে তা-ও অনেকে মানতে চান না। ফলে মানসিক সমস্যার প্রতি গুরুত্ব না দিয়ে শারীরিক উপসর্গ নিয়েই ব্যতিব্যস্ত থাকেন।</p> <p>কভিডের কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাবে এমন সমস্যা ও রোগের প্রকোপ বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুযোগ ও সুবিধাও বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। কভিডের সময় আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিষণ্নতা, উদ্বেগসহ নানা মানসিক সমস্যা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে আত্মহত্যা-প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে—এই উদ্বেগজনক অবস্থাটি নিয়ন্ত্রণে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এ ধরনের মর্মান্তিক মৃত্যু প্রতিরোধে পরিবারের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহপাঠী-বন্ধু-শিক্ষক এবং প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বর্তমান মানসিক অবস্থাটি যাচাই বা অনুধাবনের উদ্যোগ নিতে হবে। কভিডকালীন মৃত্যু, দুর্ঘটনা, পারিবারিক ও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া শিক্ষার্থীদের তাদের অভিজ্ঞতা ও মানসিক অবস্থা শেয়ার করার সুযোগ করে দিতে হবে। প্রয়োজনে প্রশিক্ষিত কাউন্সেলর বা মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর সহায়তা নিতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলামাত্রই দেড় বছরের পড়াশোনার ঘাটতি পূরণে অতিরিক্ত পড়াশোনা-ক্লাস-পরীক্ষার চাপে না ফেলে ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানমুখী করতে হবে। দেড় বছরের অনভ্যস্ততার জড়তায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রুটিন ও নিয়মতান্ত্রিকতার সঙ্গে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। শিক্ষা যেন হয় আনন্দের সঙ্গে। চাপ না হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেন হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের কাছে চাপমুক্তির, স্বস্তির শ্বাস ফেলার জায়গা। মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত মনে হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিরোধ করা যাবে দুঃখজনক আত্মহনন।</p> <p>লেখক : মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা</p> <p> </p>