<p>অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে রাজনৈতিক দলে নাম লেখানো ও নির্বাচনে মনোনয়নের ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক বেশি বললে ভুল হবে না। তবে রাজনীতিতে থাকা নেতাদের নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও কলহের কারণে এক দল থেকে অন্য দলে যোগ দেওয়া অনেকটা এখন সহজ। সব দলের জন্য নয়, ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এবং সেই দলের পক্ষ হয়ে নির্বাচন করার ইচ্ছা অনেকের মধ্যে বেশি পরিলক্ষিত হয়। দেশে এখন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন চলছে। এখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রবণতা যেমন রয়েছে, তেমনি একেকটি ইউনিয়নে গড়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর সংখ্যা পাঁচেরও অধিক দেখা যায়। যাঁরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাচ্ছেন তাঁরা মন্ত্রী ও এমপিদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। দলের মনোনয়ন বোর্ড হিমশিম খাচ্ছে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে। নির্বাচন দলীয়ভাবে হওয়া সত্ত্বেও কোথাও কোথাও সদ্য যোগ দেওয়া এবং অতীতে অন্য দলে যুক্ত ছিলেন এমন কাউকে কাউকে মনোনয়ন দেওয়ারও ঘটনা ঘটেছে। এমনকি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার আসামিদের প্রথমে মনোনয়ন দিয়ে পরে প্রত্যাহার করা হয়। বাংলাদেশের রাজনীতি ও ক্ষমতাসীন দলের জন্য এমনটি শুধু অশনিসংকেতই নয়, ভয়াবহ এক পরিণতির অপেক্ষার পালা। শুধু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের কথা বলছি না, বর্তমানে সব জায়গায় বলয় আর পেশিশক্তির জন্য সঠিক চেতনার জায়গার মানুষের স্থলে জায়গা করে নিচ্ছে ঘাপটি মেরে বসে থাকা মানুষরা। আজকে এদের পাওয়া গেলেও বিপদে এদের পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সহজ কথায় আওয়ামী লীগের বিপদে এদের পাওয়া যাবে না, বরং বিপদে এরাই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের লোকজনকে ঘায়েল করতে একটুও পিছপা হবে না।</p> <p>রাজনৈতিক দলের আদর্শ ও নৈতিকতার প্রশ্নে কঠোর হওয়া অন্যায় ও অবিচারকে না বলা এবং সত্যিকার চেতনাকে ধারণ ও লালন করা। নতুন নেতৃত্বকে আমরা অস্বীকার করছি না; কিন্তু যাঁরা নতুন নেতৃত্বে আসবেন তাঁদের উচিত পুরনো নেতৃত্বের কাছে অনেক কিছু শেখা। তাঁদের সম্মান করা এবং তাঁদের পরামর্শ নেওয়া। নাটোরসহ বিভিন্ন জায়গায় আমরা দেখি কিভাবে দলের ত্যাগী ও বয়স্ক নেতাদের কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক পথ অবলম্বনের মাধ্যমে দলকে পরিচালিত করতে হয়। এই চেতনা সবার মধ্যে থাকলে সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচন করা কোনো বিষয়ই নয়। রাজনীতি একটি শিখন প্রক্রিয়া এবং এখানে মেধা ও নেতৃত্বকে খুঁজে বের করতে হয়। কিন্তু অধুনা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে নতুন ও নবীন নেতৃত্বের বিকাশ আমরা দেখছি; কিন্তু তাঁদের মধ্যে পুরনোদের সঙ্গে নিয়ে চলার প্রবণতার মধ্যে যেন ভাটা পড়েছে। তাঁরা পুরনোদের দিয়ে যেন চলতে চাচ্ছেন না। মনে রাখতে হবে পুরনোদের অভিজ্ঞতার অনেক মূল্য আছে। দল নতুনদের নিয়ে পরিচালিত হতে পারে। নবীনরা এমপি ও মন্ত্রী হবেন কিন্তু পুরনোদের মতামত ও পরামর্শ একেবারে বাদ দিয়ে কিংবা তাঁদের অবহেলা করে নয়। যখন এমন অবস্থা তখন দল নয়, নিজেদের বলয় ভারী করার জন্য বাছবিচার না করে দলে যুক্ত করানো দলের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। আগে জামায়াত কিংবা বিএনপি করতেন, সদ্য দলে যোগ দিয়েছেন তাঁদের মনোনয়ন দেওয়ার জন্য আমরা উঠেপড়ে লেগে যাই। কেন আওয়ামী লীগ কি সদ্য একটি দল যে তাঁদের মনোনয়ন দিতে হবে? বাংলাদেশের সবচেয়ে একটি পুরনো দলের নেতাকর্মীর কি দারুণ অভাব হয়েছে যে তাঁদের মনোনয়ন দিতে হবে? দলে যোগ দিয়েছেন ভালো কথা, কাজ করুন। কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করুন আপনি দলের আদর্শ ও চেতনার জায়গা দখল করেছেন। তারপর বিবেচনার বিষয়। মূলকথা হলো, যাঁরা এঁদের বিষয়ে সুপারিশ করছেন তাঁদের রাজনৈতিক আদর্শ ও চেতনা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তা না হলে জেনেশুনে কেন সুপারিশ করবেন।</p> <p>রাজনীতিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা তৈরি হওয়ার কারণে রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ার প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ফলে নেতাকর্মী নির্বাচনে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির পরিবর্তে মনোনয়ন বাণিজ্য বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। আর তখনই অভিযোগ ওঠে আর্থিক লেনদেন কিংবা স্বজনপ্রীতির। লক্ষ করলে দেখবেন অতীতে ভোট ছাড়া এমপি কিংবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়া ছিল কল্পনারও বাইরে। কিন্তু এখন হরহামেশাই হচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে। সাধারণ জনগণ একেবারে রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেছে কিংবা রাজনীতির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে তা তো নয়। কোন এক অদৃশ্য কারণে অনেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হচ্ছেন। এর ফলাফল আমাদের জন্য শুভ নয়। ভোটে নির্বাচিত একজন জনপ্রতিনিধির জনগণের কাছে যে জবাবদিহি থাকবে তা বিনা ভোটে নির্বাচিত একজনের থাকবে না। এ ধারা অব্যাহত থাকা আমাদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা দুর্বল থেকে আরো দুর্বল হয়ে পড়বে।</p> <p>রাজনীতিতে অংশ্রগ্রহণকে উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে রাজনীতির উৎকর্ষ বৃদ্ধি পায় এবং নতুন নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরি হয়। কিন্তু সেই পথ হতে হবে সুনির্দিষ্ট ও গণতান্ত্রিক পন্থায়। বঙ্গবন্ধু এক দিনে নেতা হননি। ধাপে ধাপে, শিখে শিখে তিনি বড় মাপের নেতা হয়েছেন। তাঁকে কাজ করে মানুষের মন জয় করে নেতা হতে হয়েছে। কিন্তু আজকে খুব সহজেই নেতা হওয়া যায়। খুব সহজেই জনপ্রতিনিধি হওয়া যায়। নেতা নির্বাচনে তীব্র প্রতিযোগিতার পরিবর্তে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেতা। মেনে নিচ্ছি অনেকে নেতা হতে চান এমন অনেকের নেতৃত্বের গুণাবলি রয়েছে কিন্তু নেতা হওয়ার সুযোগ হয় না। প্রক্রিয়াটি এমন হওয়া উচিত, যাকে যোগ্য মনে করি তাঁকে মনোনয়ন দেওয়া ও নির্বাচিত করা। রাজনীতিতে সরাসরি অংশ্রগ্রহণ বাড়ানো আমাদের মুখ্য বিষয় না হয়ে সরকার এবং দলের বেশি বেশি ভালো কাজ করা উচিত, যাতে সাধারণ জনগণের সরকারের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি পায়। ভালো কাজ করলে সাধারণ জনগণ সব সময় সরকারের সঙ্গে থাকবে। আমরা এমন একটি গণতান্ত্রিক আবহ তৈরি করতে পারি, যেখানে যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতা নির্বাচিত হবে। দল থেকে কিছু পাওয়ার পরিবর্তে দলে আর্থিক অবদান কতটুকু থাকবে তার মূল্যায়ন হবে এবং দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান থাকবে। তা করতে পারলে এখন যেমন শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলেও দলীয় পরিচয়ে রেহাই পাওয়া যায়, তখন হবে তার উল্টোটা। রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশগ্রহণে চাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি।</p> <p>লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p>neazahmed_2002@yahoo.com</p> <p> </p>