<p>২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে প্রথমবারের মতো সাধারণ ও বিজ্ঞান প্রযুক্তি ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে এক নতুন আশা সৃষ্টি হয়। কিন্তু বাস্তবে সেই আশা পূরণ হয়নি বলে মনে হচ্ছে। গুচ্ছ পদ্ধতির মূল লক্ষ্য ছিল, শিক্ষার্থীদের আর্থিক কষ্ট লাঘব করা, ভোগান্তি দূর করা, সময় সাশ্রয় করা ও হয়রানি বন্ধ করা; যার কোনোটি বাস্তবে দেখতে পায়নি। কার্যত একের পর এক সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে যাচ্ছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।</p> <p>গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি আবেদন ফি প্রথমে ছিল ৬০০ টাকা। পরে সেটি বৃদ্ধি করে এক হাজার ২০০ টাকা করা হয়েছে। গুচ্ছ কর্তৃপক্ষ বলেছিল, একবারই টাকা দিতে হবে। পরবর্তী সময়ে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় সার্কুলার দিয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা ভর্তির বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, প্রতি ইউনিটে আবার ভর্তি ফি দিতে হবে। যেমন—যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৫০ টাকা দিতে হবে প্রতি ইউনিটে আবেদনের জন্য। তাহলে যদি কোনো শিক্ষার্থী পাঁচ ইউনিটে আবেদন করেন, তাঁর খরচ হবে তিন হাজার ২৫০ টাকা। এভাবে যদি তিনি কমপক্ষে পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন, ব্যয় হবে ১৬ হাজার ২৫০ টাকা। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের কোনো আর্থিক সাশ্রয় হয়নি, বরং বেশি খরচ হচ্ছে। এদিকে আগামী বছর থেকে সেকেন্ড টাইম শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবেন না গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা ব্যবস্থায়। ফলে এ বছর বাদ যাওয়া লাখ লাখ মেধাবী শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।</p> <p>এ ছাড়া ‘বি’ ইউনিটের ফলাফলে গরমিলের অভিযোগ রয়েছে। কিছু শিক্ষার্থী যে বিষয়ে উত্তর করেননি তাঁকে সেটিতে মার্কস দেওয়া হয়েছে, আর যে বিষয়ে ভালো পরীক্ষা দিয়েছেন, সেটিতে খালি দেখানো হচ্ছে। কর্মদিবসে পরীক্ষার তারিখ হওয়ায় তীব্র যানজট, নিজের পছন্দের কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে না পারা এবং অন্যান্য অসংগতিতে অনেক স্বপ্নের গুচ্ছই তীব্র ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে লাখ লাখ ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থীর জন্য।</p> <p>ফলাফল ঘিরে শিক্ষার্থীদের আশঙ্কা দূর করতে সমাধান হিসেবে ফল চ্যালেঞ্জের সুযোগ দেয় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা কর্তৃপক্ষ। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৬ নভেম্বর ফল চ্যালেঞ্জের আবেদনের সময়সীমা (৭-১১ নভেম্বর) ও ফি নির্ধারণ করে বিজ্ঞপ্তি দেয় কর্তৃপক্ষ। তবে এ ক্ষেত্রে আবেদন ফি দুই হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। পাশাপাশি বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ রয়েছে, যদি কোনো শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়, তাহলে তাঁর সম্পূর্ণ টাকা ফেরত পাবেন। ফল চ্যালেঞ্জের জন্য দুই হাজার টাকা ফি  নেওয়ার সিদ্ধান্তে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। তাঁদের দাবি, এটি কোনো শিক্ষাবান্ধব সিদ্ধান্ত নয়, বরং বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত।</p> <p>পছন্দক্রম অনুযায়ী কেন্দ্র না পড়ায় ভর্তীচ্ছুদের বড় একটি অংশ আসনবিন্যাসের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এমন কেন্দ্রে আসন পড়েছে, যেখানে অনেকে অতীতে কখনো যাননি। এ ছাড়া পছন্দমতো যদি আসন না-ই দিতে পারে, তাহলে পছন্দক্রম পদ্ধতি রাখার মানে হয় না। ফলে ভোগান্তি, হয়রানি ও অর্থ খরচ কমাতে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করা হলেও প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি বেড়েছে।</p> <p>এখন প্রশ্ন হলো, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা কতটা শিক্ষার্থীবান্ধব তা নিয়ে নানা মহলে গুঞ্জন চলমান। যেসব অভিযোগ উঠেছে এবং যেসব সমস্যা রয়েছে, তা দ্রুত সমাধান করতে হবে। প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা ভর্তি বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার ফল দিয়ে কে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে ইচ্ছুক, তার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের ভর্তি মেধা তালিকা প্রকাশ করা উচিত। তাহলেই একমাত্র হয়রানি কমবে শিক্ষার্থীদের। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতি বাতিল করাই ভালো।</p> <p>গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে বলে মনে হচ্ছে। কারণ এখন আর কেউ নিজের এলাকা রেখে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে যাবেন না। ফলে আগে একটি বিভাগে অনেক জেলার ছেলেমেয়ে থাকতেন এবং তাঁদের মধ্যে কালচারাল, ভাষাগত যে পরিবর্তন হতো, এখন আর সেটি সম্ভব হবে কি না সন্দেহ থেকে যায়।</p> <p>এ ছাড়া গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষায় কিছু সিদ্ধান্ত আমার কাছে ঠিক মনে হয়নি। কারণ ওই সব সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে আমার কাছে প্রশ্ন জেগেছে। যেমন—বিজ্ঞান বিভাগে আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা জিপিএ ৮.০০-এর শর্ত পূরণ করে যাঁরা আবেদন করেছেন, তাঁদের সবাইকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান করা হয়নি। তেমনি মানবিক ও বাণিজ্য অনুষদে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এ সিদ্ধান্তের যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না? বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েটসহ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অতীতে এ রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। কারণ ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় মিলে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে কোনো শিক্ষার্থী ন্যূনতম যোগ্যতা পূরণ করে আবেদন করার পরও যদি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করতে পারেন, তা খুবই দুঃখজনক। যে কারণ বা যুক্তিতে তাঁদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে না দেওয়া মানে হলো ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা থেকে বঞ্চিত করা। গুচ্ছ না হলে এসব শিক্ষার্থী পাঁচ বা ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তির সুযোগ পেতেন বলে মনে করি। তাঁদের এভাবে বঞ্চিত করার অধিকার কি আমাদের আছে? ফলে ওই সব শিক্ষার্থীর কাছে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আশীর্বাদ নয়, অভিশাপ।</p> <p>বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির আবেদনে এত টাকা রাখার সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই ঠিক হচ্ছে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ থাকবে যাতে ভর্তির আবেদন ফি ইউনিটপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা হয়। দেশে অনুমোদিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ৫১টি। ২০টি সাধারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন হয় ১ নভেম্বর। এ ছাড়া কৃষি ও কৃষিপ্রধান সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হবে আগামী ২৭ নভেম্বর। অন্যদিকে ঢাকাসহ বড় পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা আলাদা তারিখে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি প্রকৃতপক্ষে তেমন হ্রাস পাচ্ছে না। অর্থাৎ গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সফল হবে তখনই, যখন একটি গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হবে ৫১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।</p> <p>লেখক : সাবেক সভাপতি, শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় (জাককানইবি), ত্রিশাল, ময়মনসিংহ</p> <p> </p>