<p>জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির সদস্য দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সম্প্রতি এক আলোচনাসভায় বলেছেন, দেশে তথ্যের অন্ধত্ব বিরাজ করছে। তথ্য গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। তাঁর মতে, একটা সময় দেশে তথ্যের শূন্যতা ছিল, এরপর সৃষ্টি হয় তথ্যের নৈরাজ্য; নৈরাজ্যের পর ছিল তথ্য প্রকাশের দ্বিধা।</p> <p>তবে এটা তো মানতে হবে যে বর্তমান সময়ে যার কাছে যত বেশি তথ্য আছে, সে তত বেশি সমৃদ্ধ; যদিও এই সমৃদ্ধির ফাঁকে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। আর এসব ঘটছে তথ্যের অবাধ প্রচার ও অজ্ঞতার কারণে। বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেন, সময়ের এই স্রোতমুখে সবচেয়ে বেশি তথ্য ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে, যা কোথাও কোথাও তথ্যসন্ত্রাসের আকারে রূপ নিয়েছে। তথ্যসন্ত্রাস বলার কারণ এর ওপর ভর করে হেনস্তা কিংবা আক্রমণের জোর নজির দৃশ্যমান। অথচ বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে মূল্যবান ও ব্যয়বহুল বিষয় হলো তথ্য।</p> <p>দ্রুতগতির এই যুগে তথ্যের অবাধ প্রবাহ ঠেকানোর সুযোগ নেই। কিন্তু এটা সত্যি, একটু সচেতন হলে এমন অপ্রত্যাশিত ও অপরিকল্পিত অনেক বিষয় এড়িয়ে চলা সম্ভব। ধরা যাক, দুই ব্যক্তির মধ্যে বিবাদ আছে। প্রথমজন অপেক্ষায় আছেন দ্বিতীয়জনকে বাগে পেতে অর্থাৎ নিরালায়-নির্জনে একাকী পেলে হামলার উদ্দেশ্যে। এদিকে দ্বিতীয়জন রেস্টুরেন্টে খেতে কিংবা দাওয়াতে গিয়ে সেখানে থাকা অবস্থায়ই একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রথম ব্যক্তিকে সুযোগ করে দিয়েছেন।</p> <p>এভাবেই তথ্যের নাগালে অনাচারের টার্গেটগুলো সহজেই আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সহজ সমাধান হলো অন্তত কোথাও অবস্থানকালীন ছবি বা অবস্থান সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ না করা।</p> <p>এ ক্ষেত্রে আরো মজার বিষয় যুক্ত করা যায়। পরিচিত এক ব্যক্তি প্রায়ই দামি দামি রেস্টুরেন্ট ও খাবারের ছবি দেন। কিন্তু কখনোই সেখানে নিজের ছবি দেন না। এ বিষয়ে তাঁকে প্রশ্ন করলে জানা যায়, সোসাইটি মেইনটেন করতে নাকি এসব ছবি দিতে হয়! নিজে যে টাকা বেতন পাই তা দিয়ে ওই সব জায়গায় যাওয়া সম্ভব নয়। তাই মাঝে মাঝে কিছু ছবি ডাউনলোড করেই দিয়ে দিই, এই যা!</p> <p>বিষয়টি বিস্ময়কর ও আতঙ্কের। কারণ এটি প্রমাণ করে স্বাস্থ্যের বিবেচনায় শৈশবের জাংক ফুড রচনা বা প্যারাগ্রাফ পড়লেও তা আমাদের বোধে সঞ্চালন ঘটাতে পারেনি। অন্যদিকে আমরা এমন সোসাইটি ধারণ করছি, যেখানে মিথ্যা, বানোয়াটের আশ্রয় নিয়ে সৎ, নিষ্ঠাবান মানুষদের চলতে হচ্ছে। অথচ আমাদের শৈশবে শেখানো উচিত বাজার থেকে কোনো বড় মাছ কিনলে অবশ্যই সেটা চট কিংবা অন্য কোনো ব্যাগ দিয়ে আবৃত করে আনতে। কারণ সেই মাছ দেখে যেন দরিদ্র প্রতিবেশী কষ্ট না পায়। অথচ আজ সোসাইটি নামের অদৃশ্য বাস্তবতাকে রক্ষা করতে মিথ্যা ছবির পসরা সাজাতে হয়।</p> <p>গভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলে এটা স্পষ্ট হয় যে এই ধরনের আচরণ আদতে এক শ্রেণির ভোগের মানসিকতা সৃষ্টি করছে এবং আরেক শ্রেণিকে জটিল অসুখের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যা সামাজিক শৃঙ্খলা ও স্বাস্থ্যে নব্য অস্থিরতার সংযোজন ঘটাচ্ছে।</p> <p>শৈশবের শিক্ষা বড় শিক্ষা। কারণ এটাই প্রাথমিক ও নিখুঁত শিক্ষা। তবে এখনকার সময়ে শৈশবের সেই পারিবারিক শিক্ষা ও আচরণগুলোকে ব্যাকডেটেড কিংবা পুরনো শিক্ষার তকমা দিয়ে তথাকথিত মহানগরীয় চাকচিক্যকে আত্মস্থ করতে অনেকেই অন্ধকারকে আশ্রয় করছেন। আধুনিকতার নামে অযাচিত তথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছেন, যা বিনা সাঁতারে নদী পাড়ি দেওয়ার মতো ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ শৈশবের জাংক ফুডতত্ত্ব ও সততার শিক্ষাকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চর্চা করলেই বহু অসুস্থ নামধারী সামাজিকতা, তথ্যসন্ত্রাস রুখে দেওয়া সম্ভব।</p> <p>আরেকটা বিষয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আবিষ্কার হয়েছিল মানুষে মানুষে যোগাযোগ স্থাপন, কর্মসম্পাদন ও আবেগের সীমানাকে ঘরের জানালায় নিয়ে আসার তাগিদে। কিন্তু শো অফের জামানায় সেই কাছে আসার গল্পগুলো বড় বিচ্ছিন্ন ও নির্মম রূপ নিয়ে ফেলছে। ভাঙনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাশাপাশি মুখোশের আড়ালেও মুখোশ তৈরি করছে।</p> <p>যার ফল মিথ্যা তথ্যের কারণে সত্যকে সন্দেহ। ব্যর্থকে চৌকস হিসেবে দেখার প্রবণতা বাড়ছে। তাই বলা যায়, শুধু শো অফের জারিজুরি বন্ধ হলেই বহু তথ্য-উপাত্ত সুরক্ষিত থাকবে। রক্ষিত হবে আমাদের সম্পর্ক ও সম্মান।</p> <p>লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক</p> <p>Raburabaya1993@gmail.com</p>