<p>পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালে রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় উর্দু-ইংরেজি মিশেল দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভোকেশন অনুষ্ঠানে ভাষণ দেওয়ার সময় উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করেছিলেন। শিক্ষকরা জিন্নাহর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন এমন তথ্য পাওয়া যায় না। শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন, ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’—তখন ছাত্ররা তাঁর সামনেই বসে চিৎকার করে বললেন—না, না, না।’ জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করে ছিলেন, তারপর বক্তৃতা করেছিলেন। আমার মনে হয়, ‘এই প্রথম তাঁর মুখের ওপর তাঁর কথার প্রতিবাদ করল বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যত দিন বেঁচেছিলেন আর কোনো দিন বলেননি—উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে।’</p> <p>ঢাকা থেকে জিন্নাহ চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশের মানুষ ভাষার প্রশ্নে রাস্তায় নেমে এসেছিল এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। জিন্নাহর অনুসারী-অনুরাগী ছিল ছাত্রদের মধ্যে। শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, ‘জিন্নাহ চলে যাওয়ার কয়েক দিন পরে ফজলুল হক হলের সামনে এক ছাত্রসভা হয়। তাতে একজন ছাত্র বক্তৃতা করেছিলেন, তাঁর নাম আমার মনে নেই। তবে তিনি বলেছিলেন, ‘জিন্নাহ যা বলবেন, তাই আমাদের মানতে হবে। তিনি যখন উর্দুই রাষ্ট্রভাষা বলেছেন—তখন উর্দুই হবে। আমি তার প্রতিবাদ করে বক্তৃতা করেছিলাম।’ জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হবে, একে বাঁচাতে হবে, রিকনস্ট্রাক্ট করতে হবে। অ্যান্ড আই ওয়ার্ন ইউ দ্যাট দেয়ার আর ফিফথ কলামিস্ট এমাংস্ট ইউ। কমিউনিস্টদের দ্বারা প্রভাবিত হবেন না ইত্যাদি।’</p> <p>মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর বক্তব্যের প্রতিবাদে ১১ তারিখে ধর্মঘটের আহ্বান করা হয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদ, সরদার ফজলুল করিম, কমরেড তোহাসহ অনেক নেতাকর্মী ধর্মঘটে পিকেটিং করেছেন। শিক্ষার্থীদের অনুরোধে সেক্রেটারিয়েট থেকে একজন মন্ত্রী এসে সহমত পোষণ করে বক্তৃতা দিয়েছেন। সরদার লিখেছেন, ‘আবদুল গনি রোড ধরে সেক্রেটারিয়েটের দক্ষিণ গেটে উপস্থিত হলাম। একজন ছাত্র মন্ত্রী আবদুল হামিদ সাহেবকে ধরে এনে বক্তৃতা দেওয়ালেন। তিনি তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘বাংলা ভাষা হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা ভাষা। সবচেয়ে ভালো ভাষা।’ এভাবে তিনি তাঁর জীবন রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলেন। এ মিছিলের প্রধান ভাগে ছাত্ররাই ছিলেন।</p> <p>ভাষা আন্দোলন বামপন্থী এবং জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৫২ সালে খাজা নাজিমুদ্দীন ঢাকায় এসে মুসলিম লীগের অধিবেশনে ২৬ জানুয়ারি ঘোষণা করেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ ফলে শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হন। ১৯৪৮ সালে খাজা নাজিমুদ্দীন ছাত্রদের সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন যে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক পরিষদে সুপারিশ করবেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানের মধ্যে শুধু জাতীয়তাবাদী চেতনার সৃষ্টি হয় না, পাকিস্তান সম্পর্কে সন্দেহ ও সংশয় শুরু হয়।</p> <p>১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে অভিযুক্ত শিক্ষকদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। শিক্ষকদের জেল থেকে ছাড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল বিবৃতি দিতে অস্বীকার করেছিল। এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণীর সর্বোচ্চ ফোরাম। প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের মেম্বার ছিলেন। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘তাঁকে যখন বললাম, আপনারা এটা কেন করলেন, তখন তিনি বললেন, তিনি তো চাননি। কিন্তু অন্য মেম্বাররা রাজি নন। আমি বললাম আপনাদের, যাঁকে জিজ্ঞেস করি তিনিই বলেন, তিনি এটা চান নাই। তাহলে ব্যাপারটা হলো কী করে?’ ভাষা আন্দোলনের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী এবং মুজাফ্ফর আহমদকে গ্রেপ্তার করেছিল। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক আরো বলেছেন, ‘৫২-এর ব্যাপারে শিক্ষক সম্প্রদায়ের মধ্য থেকে কেউ যে তেমন প্রমিনেন্ট পার্ট নিয়েছেন, এমন মনে পড়ে না। একুশে ফেব্রুয়ারি মোর অর লেস সবাইকে অ্যাফেক্ট করেছিল। কিন্তু কোনো শিক্ষক যে এর পেছনকার অর্গানাইজার ছিলেন, এমন নয়। মুনীরও নন, মুজাফ্ফরও নন।’</p> <p>১৯৫২ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘ড. শহীদুল্লাহ সাহেব তখন টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমি ভাবছিলাম, কোনো রেজল্যুশন শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে নেওয়া হলে তিনি কি খুশিমনে তা মেনে নিতে পারবেন, হোয়েদার হি উড ফিল হ্যাপি। তাই আমি আর মাযহার সাহেব (সরওয়ার ছিল কি না মনে নেই), —আমরা ড. শহীদুল্লাহর কাছে গিয়ে বলি, আমরা শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে মার্ডার অব দ্য স্টুডেন্টসকে কনডেমন করে ‘ছাত্র হত্যাকে’ নিন্দা প্রস্তাব নেব। আপনাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে এই রেজল্যুশন মুভ করতে হবে। দেখলাম, ড. শহীদুল্লাহ মার্ডার কথাটা মানতে রাজি হলেন না। তিনি বললেন : ‘মার্ডার’ কথাটা কওয়ার দরকার কী? আমরা বললাম মার্ডার কথাটা থাকতে হবে। তিনি আবার যখন বললেন : ‘মার্ডার’ কথাটা ঠিক হবে না, তখন আমরা বললাম, স্যার, আপনি তাহলে মিটিংয়ে উপস্থিত না থাকলেন। তাতে ড. শহীদুল্লাহ বললেন : আচ্ছা তাই হবে। আমি মিটিংয়ে থাকব না।’</p> <p>একুশে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভায় সভাপতি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অনুপস্থিতিতে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সভাপতিত্ব করার কথা ছিল। সভাপতি হিসেবে অবদুর রাজ্জাকের নাম ঘোষণা করা হয়। শেষ পর্যন্ত এই প্রতিবাদসভায় সভাপতিত্ব করেন ড. ইতরাত হোসেন জুবেরী। এ সম্পর্কে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, ‘আমরা মিটিং শুরু করব। নিয়মমাফিক কে যেন আমার নাম প্রস্তাব করল : ঠিক এই সময়ে ড. জুবেরী এসে উপস্থিত হলেন। ড. জুবেরীর সঙ্গে আগে আমার কোনো কথা হয় নাই। কিন্তু তিনি এসে প্রেসিডেন্টের চেয়ারে যেয়েই বসলেন। আমরা প্রথমে একটু থতমত খেলাম। তারপর আমি যেয়ে তাকে রেজল্যুশনটা দেখালাম। আমি বললাম : এই  রেজল্যুশনটা প্লেস করা হবে। এবং আপনি যখন প্রিসাইড করছেন তখন চেয়ার থেকে এই রেজল্যুশনটা আপনি মুভ করবেন। তিনি ‘মাডার’ কথাটা দেখে আপত্তি করলেন। আমি বললাম, না, এই রেজল্যুশনটাই নেওয়া হবে। এই সময়ে ইকোনমিকসের প্রফেসর আয়ারও বললেন, মার্ডার কথাটার দরকার কী? ‘ডেথ’ শব্দটা ব্যবহার করলেই তো হয়। দোজ টু আর সিনোনিমাস। এ কথা শুনে আমি বললাম, সিন্স হোয়েন মার্ডার অ্যান্ড ডেথ হ্যাভ বিকাম সিনোনিমাস? আয়ার অমনি চুপ করে গেলেন। আর কিছু বললেন না। তখন জুবেরী সাহেবও সমাবেশের অবস্থা দেখে আর কিছু বললেন না।’ ড. ইতরাত হোসেন জুবেরী পরবর্তী সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।</p> <p> </p> <p>লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়</p>