<p>আসন খালি রেখে এবার প্রথম বর্ষের শিক্ষাক্রম চালু করতে যাচ্ছে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কিছু বিভাগে এবার শিক্ষার্থী না-ও পেতে পারে, এমন আশঙ্কাও আছে। ঠিক এ অবস্থায় ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শ্রেণিপাঠ শুরু হচ্ছে। আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট আছে। অনেকে সব পরীক্ষা নিতে পারেনি। এসব বিশ্ববিদ্যালয় স্বাভাবিক শিক্ষাক্রমে ফিরে আসতে খুব বেশি সময় পাবে না। আবার নতুন ব্যাচের ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার প্রস্তুতির বিষয়টিও সামনে চলে এসেছে। </p> <p>শিক্ষার্থীদের ভর্তি জটিলতার পাশাপাশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন শূন্য থাকার বিষয়টি হতাশাজনক। বারবার অপেক্ষমাণ মেধাতালিকা প্রকাশ করার পরও আশানুরূপ শিক্ষার্থী পাওয়া যাচ্ছে না বলে কালের কণ্ঠে প্রকাশিত খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ এরই মধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের আলাদাভাবে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ভর্তির আবেদনপত্র ক্রয় করার বিধান রাখায় শিক্ষার্থীর হয়রানি ও আর্থিক খরচ বেড়েছে। এ ছাড়া ভর্তিপ্রক্রিয়ায় সময় নির্ধারণে জটিলতা দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের হয়রানি বেড়েছে। গুচ্ছ পদ্ধতি প্রথমবারেই মুখ থুবড়ে পড়ার মতো অবস্থা। উত্তীর্ণ হওয়া অনেক শিক্ষার্থী মেধাতালিকায় থেকেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হতে পারছে না।</p> <p>কালের কণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রথম বর্ষে ভর্তি নিয়ে গেল বছর গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তা গত ১০ মাসেও শেষ করা যায়নি। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করা হয়েছিল তা কার্যক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বেশ ভোগান্তিতে ফেলেছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই এখনো উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে আশানুরূপসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারেনি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গুচ্ছ পদ্ধতি উদ্ভাবন করার সময় যতটা সহজ ভেবেছিল বাস্তবে তাদের উদ্ভাবিত পদ্ধতি তাদের আরো বেশি জটিল অবস্থায় ফেলে দিয়েছে বললে অত্যুক্তি করা হবে না। </p> <p><img alt="" src="http://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/ckfinder/innerfiles/images/Print Version Online/print /2022/02.February/17-02-2022/121/1.gif" style="float:left; height:260px; margin:12px; width:332px" />এ অবস্থায় ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে স্কুল-কলেজ তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সীমিত পাঠদানের রুটিন অনুযায়ী শুরু হতে যাচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলে পাঠদানপ্রক্রিয়া নিশ্চয়ই গতি লাভ করবে। তবে গত দুই বছরের শিক্ষার বেহাল অবস্থাকে সামাল দেওয়া, সব শিক্ষার্থীকে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলে ফিরিয়ে আনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লেখাপড়ার স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া মোটেই সহজ কাজ হবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কতটি শিক্ষা কার্যক্রম গুরুত্বের সঙ্গে নিতে পারবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়ে গেছে।</p> <p>দেশের শিক্ষাব্যবস্থা করোনার অভিঘাতে বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছে। বলা হয়ে থাকে, দীর্ঘ এই করোনার সঙ্গে বসবাসে এক ধরনের নিউ নরমাল লাইফকে আমাদের মেনে নিতে হবে। তবে মেনে নেওয়ার বিষয়টি অভ্যস্ততার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। করোনা শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বের অনেক দেশের মতোই আমাদের এখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হয়েছে, শহরাঞ্চলের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইনে পাঠদান চালিয়ে গেছে। ছোট কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষা সেশনগুলো ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। তারা অনেকটা সফলও হয়েছে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং সব স্তরের স্কুলের বেশির ভাগই শিক্ষাবছর ধরে রাখতে পারেনি। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে খুব সীমিত আকারে শ্রেণিপাঠদান শুরু হলেও নভেম্বর-ডিসেম্বরে এসএসসি, এইচএসসি ও বার্ষিক পরীক্ষা থাকায় শিক্ষার্থীদের সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। স্কুল পর্যায়ে কিছু অ্যাসাইনমেন্ট এবং খুবই সীমিত আকারে কিছু শ্রেণিপাঠ ছাড়া সিলেবাসের অনেক কিছুই শিক্ষার্থীদের জানার সুযোগ হয়নি। ধারণা করা হয়েছিল, ২০২২ সালের শুরু থেকে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে পাঠদান ও শিক্ষাক্রম ধীরে ধীরে গতি লাভ করবে। কিন্তু ওমিক্রন আমাদের সেই আশায় বড় ধরনের ধাক্কা দিয়ে গেছে। </p> <p>উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বেসরকারি কিছু বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন মাধ্যমে শিক্ষাক্রম স্বাভাবিক রাখতে সক্ষম হলেও বেশির ভাগ সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ শিক্ষা কার্যক্রমে নানা ধরনের সমস্যায় ভুগছে। কলেজগুলোর মধ্যে সামান্যসংখ্যকই শিক্ষাক্রম সচল রাখার ক্ষেত্রে কিছুটা গতি ধরে রেখেছে। কিন্তু বেশির ভাগেরই অবস্থা নাজুক। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সচল হতে না হতেই ওমিক্রনের কারণে বন্ধ হয়ে আছে।</p> <p>২০২১ শিক্ষাবর্ষের এইচএসসির ফল ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়েছে। এখন এই শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষার উদ্যোগও শুরু করতে হবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কিন্তু মোটেও সময় ক্ষেপণ করবে না। শিক্ষার্থীদের অনেকেই এখন আর সময় ব্যয় করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বসে থাকবে না। সেই পরিস্থিতিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তিপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় ব্যয় করার ফল কী হতে পারে তা গত বছরের ভর্তিপ্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা থেকেই অনুধাবন করা যায়। সময় ক্ষেপণ করার ফলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবার ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকটে পড়তে পারে। সুতরাং মঞ্জুরি কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এখনই পূর্ব অভিজ্ঞতাকে মাথায় নিয়ে ভর্তি পরীক্ষার জট খুলে দিতে হবে, নিয়ম ও পদ্ধতিগত জটিলতার অবসান ঘটাতে হবে।</p> <p>বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় এইচএসসি, এসএসসির বা সমমানের পরীক্ষার জিপিএ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করার জন্য নিয়ম হতে পারে। কিন্তু ওই সব পরীক্ষার কোনো জিপিএ ভর্তি পরীক্ষার মেধা যাচাই বা তালিকা তৈরির জন্য নির্ধারণ করাটা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। স্রেফ ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের ওপর ভিত্তি করে মেধাতালিকা নির্ধারণের নিয়ম করা গেলে তা অনেক সহজ ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে। গুচ্ছ পদ্ধতিতেও সেটা কার্যকর করা গেলে প্রকৃত মেধাবীদের বাছাই করা অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য হতে পারে। তাতে মেধাবী শিক্ষার্থী পাওয়া নিয়ে এবার যে সমস্যাটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য তৈরি হয়েছে সেটি না-ও ঘটতে পারে। গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষার জটিলতা যত দ্রুত নিরসন করা যাবে তত দ্রুত পরবর্তী ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিও গ্রহণ করা সম্ভব হবে। </p> <p>বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গত দুই বছরে সৃষ্ট সেশনজটও তৈরি হয়ে আছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ নিয়ে হতাশাও রয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির অভিঘাত বাংলাদেশে কমবেশি সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় দুই বছরের শিক্ষা ও প্রশাসনিক স্থবিরতা দ্রুত নতুন করে কাটিয়ে ওঠার পরিকল্পনা কী নেওয়া হচ্ছে বা হবে সেটি এখনো স্পষ্ট নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমনিতেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে নানা পর্ষদের ওপর নির্ভরশীল থাকায় সময় ও মতপার্থক্যের জটিলতায় অনেক সময় তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়কেই করোনার এই ক্রান্তি এবং উত্তরকালের বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষা, গবেষণা, পরীক্ষা ও সেশনজট কমিয়ে আনার নানা ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। শিক্ষা কার্যক্রম দ্রুত স্বাভাবিক নিয়মে কার্যকর করা গেলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরবর্তী কর্মজীবনে প্রবেশের ক্ষেত্র সৃষ্টিতে তা সহায়ক হবে। এটিই এখন সময়ের দাবি। </p> <p>প্রশ্ন হচ্ছে, নতুন এই পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কতটা স্বাভাবিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেবে, শিক্ষার্থীরা কতটা এর সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারবে? অভিভাবকরাই বা কতটা সাপোর্ট দিতে পারবেন? যেসব প্রতিষ্ঠান গত দুই বছর অনলাইনের সহযোগিতা নিয়ে এগিয়েছিল তারা এগিয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু গ্রাম ও শহরাঞ্চলে যেসব প্রতিষ্ঠান পিছিয়ে পড়েছে কিংবা একেবারেই কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি, তাদের জন্য সামনের দিনগুলোতে শিক্ষায় নিউ নরমাল লাইফ আদৌ নরমাল হবে কি না সন্দেহ আছে। তাই এখন থেকেই পিছিয়ে পড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের তুলে আনার ক্ষেত্রে করণীয় ঠিক করতে হবে। বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে।</p> <p> </p> <p>লেখক : অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়</p>