<p>বাংলায় একটা কথা আছে ত্রিশঙ্কু অবস্থা, যাকে বলে উভয় সংকট। আবার আমরা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা যে বাক্যটি খুব ব্যবহার করে থাকি, সেটি হলো, ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ অবস্থা। ইংরেজিতে প্রচলিত শব্দ হলো  Catch twenty two. এবার রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে যে লড়াই, তাতে ভারত কী অবস্থান নেবে, সেটাও কিন্তু এ রকমই এক উভয় সংকটের অবস্থা।</p> <p>রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে, সেই যুদ্ধবিরতির চেষ্টা করা এবং সেই যুদ্ধবিরতি আদৌ সম্ভব হবে, নাকি শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে, অথবা যুদ্ধটা থেমেও থামবে না—এসব প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত। তবে একটা কথা খুব পরিষ্কার যে ভারতকে খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। অত্যন্ত সচেতনভাবে পা ফেলতে হচ্ছে। কেননা জাতিসংঘে রাশিয়ার পক্ষে ভোট দেওয়ানোর জন্যও ভারতের ওপর প্রবল চাপ ছিল।</p> <p>ভারতের দীর্ঘদিনের বন্ধু রাশিয়া। কাজেই ভারতের কাছে রাশিয়ারও একটা দাবি আছে। আমরা প্রতিরক্ষা খাতে প্রায় ৬০ শতাংশ রাশিয়ার কাছ থেকে গ্রহণ করে থাকি। সুতরাং এমন একটা পরিস্থিতিতে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা থাকা সত্ত্বেও আমরা রাশিয়ার পক্ষে ভোট দিইনি। আবার রাশিয়ার পক্ষে ভোট দিইনি মানে যে আমরা ন্যাটোর সদস্য হয়ে গেছি, তা কিন্তু নয়।</p> <p>রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে প্রথম থেকেই নিরপেক্ষ ছিল ভারত। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে ভারত উদ্বেগ প্রকাশ করলেও রাশিয়াকে সরাসরি আক্রমণ করেনি ভারত। এর মধ্যে ইউক্রেনের দূতের অনুরোধে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ফোনে কথাও বলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানের কথা বলেছিলেন তিনি। রাশিয়ার এই যুদ্ধের পদক্ষেপকে ভারত কটাক্ষ করলেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভোটদানে বিরত ছিল। রাশিয়া ও ইউক্রেনের এই যুদ্ধ নিয়ে ভারত কঠোর কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে।</p> <p>জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিশেষ অধিবেশনে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পেশ করা হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ১৩৫টি ভোট পড়ে। পাঁচটি সদস্য দেশ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। ভারতসহ ৩৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। কী কারণে ভারত ভোটদান প্রক্রিয়া থেকে বিরত ছিল, তা নিয়ে যুক্তি দেন জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি টি এস তিরুমূর্তি। তিনি বলেন, আলোচনা ও কূটনীতির মাধ্যমে এই বিবাদের সমাধান করতে হবে।</p> <p>রাশিয়া, ইউক্রেনসহ বিশ্বব্যাপী নেতাদের সঙ্গে আলোচনার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সে কথাই জানিয়েছেন। তিনি ইউক্রেনে ত্রাণ পাঠানো এবং সেখানে আটকে থাকা সাধারণ নাগরিকদের উদ্ধারের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। আন্তর্জাতিক আইন এবং দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য জাতিসংঘের সব সদস্য দেশকে আরজি জানিয়েছেন ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি।</p> <p>ভারত ন্যাটোর সদস্য না হলেও ভারতের ওপর আমেরিকা চাপ সৃষ্টি করছে এ জন্য, যাতে ভারত সরাসরি ইউক্রেনকে সমর্থন করে। ইউক্রেনের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো। ভারতের যে জৈব তেল, সেটাও ইউক্রেনের ফ্যাক্টরি থেকে এ দেশে আমদানি হয়। ইউক্রেনে অনেক ডিফেন্সের কারখানা আছে। যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল তখন বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এসব কারখানা তৈরি করা হয়েছিল। ইউক্রেনেও সেই সব কারখানার বেশ কয়েকটি আছে। সেই কারণে ইউক্রেন থেকেও বেশ কিছু অস্ত্র ভারতে আমদানি হচ্ছে। এখন এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনের সঙ্গে ভারত সম্পর্ক খারাপ করছে না। মানবতাবাদের প্রশ্নে ইউক্রেনের ওপর আক্রমণকে সমর্থন করছে না ভারত। কিন্তু ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে তো যুযুধান দুই পক্ষই। তাই কোনো একটা পক্ষে শামিল হয়ে ভারত যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে না। কেননা ভারত ন্যাটোর সদস্য নয়। আর ন্যাটোর সদস্য হতেও চায় না।</p> <p>আর একটা কথা, যেখানে চীন ও পাকিস্তান একটা অক্ষ তৈরি হয়েছে এবং এই চীন-পাকিস্তান অক্ষ রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখছে, সেখানে ভারত যদি এখন রাশিয়াবিরোধী হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়া অক্ষে আগামী দিনে আমাদের ভারতের ওপরে নিরাপত্তার অভাব তৈরি হতে পারে। আর ভারত মানে তো শুধু ভারত নয়, ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক সুবিদিত। চীনও বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। তা হলেও চীন ও পাকিস্তানের যে সম্পর্ক তা নিশ্চয়ই চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের হতে পারে না? এই পরিস্থিতিতে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা সম্প্রতি বলেছেন, ‘প্রতিবেশী রাষ্ট্রই হচ্ছে আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার। বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্র শুধু নয়—আর্থিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সব বিষয়ে আমরা সম্পর্ক সুদৃঢ় করছি।’ বাংলাদেশসহ সার্কের অন্য রাষ্ট্র এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত সম্পর্কটাকে আরো মধুর থেকে মধুরতর করতে চায়।</p> <p>এই পরিস্থিতিতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের লড়াইটা কাঙ্ক্ষিত নয়; যদিও তার প্রভাব ভারত থেকে অনেকটা দূরে। কিন্তু ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ, পাকিস্তান; এমনকি চীনও ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। সুতরাং এই মুহূর্তে ভারতকে অনেক বেশি সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। </p> <p>যারা রুশপন্থী তারা বলছে, ভারত তো বকলমে আমেরিকার ন্যাটোর সদস্য হয়ে যাচ্ছে। তাই ভারত আজ রাশিয়ার পক্ষে গেল না। আবার যারা আমেরিকাবিরোধী তারা আমেরিকার একেবারে সম্পূর্ণ পোঁ ধরে নেই। তার জন্য ভারত অবশ্য কিঞ্চিৎ খুশি। সুতরাং ভারতকে তার নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি বজায় রাখতে গেলে, ভারত কী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে বাংলাদেশকে তা জানাতে হবে এবং ভারত তা জানাচ্ছেও। অর্থাৎ এভাবেই ভারত এগোতে চাইছে। ভারতের এই পররাষ্ট্রনীতিটা দেখে আমার অন্তত মনে হচ্ছে, ভারত তার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে চাইছে; যদিও ভারতের জন্য এটা একটা কঠিন পরীক্ষা। কেননা ভারতের জন্য এখন ওই শ্যাম রাখি না কুল রাখি পরিস্থিতি। এই মুহূর্তে এটা ভারতের কাছে একটা মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ।</p> <p>আসলে পৃথিবীজুড়েই মানবতাবাদ লুণ্ঠিত। সভ্যতার আলোক প্রায় নির্বাপিত হতে চলেছে। ইংরেজিতে বলা হচ্ছে  Dehumanization-এর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এটা একটা  Decivilization। এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত দুঃখের। সভ্যতার আলোকবর্তিকাকে আমাদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আর সেই বাঁচিয়ে রাখার জন্য এই উপমহাদেশে শান্তি ও পারস্পরিক বিশ্বাস বজায় রাখতে হবে। সেই পথ ধরেই ভারত এগোতে চাইছে।</p> <p>লেখক : নয়াদিল্লিতে কালের কণ্ঠের বিশেষ প্রতিনিধি</p> <p> </p>