<p>ধনতন্ত্র শুধু ধনীদের কিংবা পুঁজিপতিদের ব্যাপার নয়, সাধারণ মানুষেরও ব্যাপার। সাধারণ মানুষের মধ্যেও ধনী হওয়ার বাসনা প্রবল। সুস্থ-স্বাভাবিক প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই ধনতান্ত্রিক মানসিকতা আছে। এই মানসিকতার বাইরেও মানুষ পাওয়া যায়, তবে তাদের সন্ধান দুর্লভ, সুলভ নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর যাঁরা উগ্রতার সঙ্গে পুঁজিবাদের বিরোধিতা করছেন, তাঁরা সাধারণ মানুষের মন-মানসিকতার দিকে দৃষ্টি দিচ্ছেন না। এর মধ্যে বাস্তবতা যে বদলে গেছে, তার প্রতিও তাঁরা দৃষ্টি দিচ্ছেন না।</p> <p>বহুত্ববাদ— pluralism কথাটি নতুন নয়, গ্রেকো-রোমান-ইউরো-আমেরিকান সভ্যতায় কথাটি পুরনো। রাষ্ট্রচিন্তায়, সভ্যতা বিচারে, সংস্কৃতির বিবেচনায় পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁসের সূচনা পর্বের পর থেকেই নানা বিষয়ের সঙ্গে  totalitarism ও pluralism ইত্যাদি নিয়েও চিন্তা-ভাবনা ও বিচার-বিবেচনা লক্ষ করা যায়। ধর্ম কিংবা আদর্শ অবলম্বনের বিপরীতে উদারবাদ আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির (১৯৯১) বছর দশেক আগে থেকেই নব্য-উদারবাদ প্রচারিত হচ্ছে। এতে মুক্তবাজার অর্থনীতি, অবাধ প্রতিযোগিতাবাদ, সংস্কৃতির বহুত্ববাদ, মানবাধিকারবাদ (পুঁজিবাদী) ইত্যাদি প্রচার করা হচ্ছে। বিশ্বায়নবাদীরা (সাম্রাজ্যবাদী, নয়া উপনিবেশবাদী, ফ্যাসিবাদী), জি-সেভেনের রাজনীতিকরা, কূটনীতিকরা, পশ্চিমের প্রভাবশালী প্রচারমাধ্যমগুলো এসব করছে এবং এগুলোর বাস্তবায়নের জন্য কাজ করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, চীন, ভারত কী করছে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনকে যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অস্ত্রের উৎপাদনে ব্যস্ত দেখা যাচ্ছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যেও চলছে আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা। যুদ্ধবাদী মনোভাবের দিক দিয়ে পৃথিবী এখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পূর্ববর্তী অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে—এমন ধারণাও পশ্চিমের ও পূর্বের কোনো কোনো চিন্তক ব্যক্ত করছেন।</p> <p>বাংলাদেশে বিবিসি (রেডিও), ভয়েস অব আমেরিকা, সিএনএন ইত্যাদির অনুসরণে ১৯৮০-র দশকের শেষ দিক থেকেই বহুত্ববাদ কথাটা নতুনভাবে বলা হচ্ছে। বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য কিছু বলা হলেই কিছু ভাবুক ও কর্মী বলে ওঠেন, বাংলাদেশ শুধু বাংলা ভাষার দেশ নয়, এখানে বাংলা ভাষার পাশাপাশি আদিবাসীদের ৫০টি ভাষা আছে। সেসব ভাষার উন্নতির জন্যও কর্মসূচি ও কার্যক্রম চালাতে হবে। আদিবাসীদের বিলীয়মান ভাষাগুলোকে রক্ষা করার জন্য ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। বাংলা ভাষার উন্নতির জন্য আমাদের দাবি ও আন্দোলনের কারণে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করেছিল বাংলা উন্নয়ন বোর্ড। ১৯৭২ সালে সেটি বিলুপ্ত করা হয়েছে এবং বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাংলা একাডেমিতে যুক্ত করে দেওয়া হয়। বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের কাজ বাংলা একাডেমি দিয়ে হচ্ছে? বাংলা একাডেমির কার্যক্রমের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, এই প্রতিষ্ঠান যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে সেই সরকারের স্তবস্তুতির কাজেই ব্যস্ত থাকে। পাকিস্তানকালের আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে যে স্পিরিট নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী আবু হুসেন সরকার বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করেছিলেন, তার যৌক্তিক ধারাবাহিকতা অবলম্বন করে বাংলা একাডেমি চলছে না। আমার মনে হয়, পাকিস্তানকালের বাংলা উন্নয়ন বোর্ড স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন পরিস্থিতিতে অভিজ্ঞতার আলোকে লক্ষ্য নির্ধারণ করে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা দরকার। বাংলা উন্নয়ন বোর্ড নাম না নিয়ে নতুন নাম নির্ধারণ করা উচিত। ১৯৭২ সালের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু যে জাতীয় লক্ষ্য নিয়ে রাষ্ট্রের উঁচু-নিচু সব পর্যায়ে বাংলা ভাষা প্রবর্তনের কার্যক্রম ঘোষণা করেছিলেন তার ধারাবাহিকতায় বাংলা একাডেমি চলছে না।</p> <p>আমি রাষ্ট্রভাষা বাংলার উন্নতির জন্য যে কথা বলতে চাইছি তার প্রতিবাদ কি আদিবাসীদের বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রক্ষা করার জন্য ও উন্নত করার জন্য যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা কিছু বলবেন? আদিবাসী কথাটা স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো সরকারই গ্রহণ করেনি, বর্তমান সরকারও গ্রহণ করেনি। এই গ্রহণ না করাটাই যুক্তিসংগত। বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোকে বাঙালি জাতির অন্তর্ভুক্ত করে বক্তব্য দিয়েছিলেন তাতে বঙ্গবন্ধু জাতি বলতে  nation বুঝিয়েছিলেন। যাঁরা সেদিন তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন, তাঁরা  nation কথাটার অর্থ বুঝতে চাননি।</p> <p> nation সম্পূর্ণই একটি রাজনৈতিক টার্ম। কোনো জনগোষ্ঠীকে নিজেদের রাষ্ট্র গঠন করতে হলে সেই জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয়তাবোধ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের জন্য জাতীয়তাবাদ  (nationalism) দরকার। চাকমা, রাখাইন, ত্রিপুরা, খাসি, গারো, সাঁওতাল—এগুলো কি এক একটি জাতি  (nation)? নিজেদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের জন্য এরা কী করতে পারবে?</p> <p><img alt="" src="http://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/ckfinder/innerfiles/images/Print Version Online/print /2022/04.April/13-04-2022/121/0.gif" style="float:left; height:349px; margin:12px; width:334px" />আদিবাসী আছে যুক্তরাষ্ট্রে, কানাডায়। তাদের যুক্তরাষ্ট্র সরকার কিভাবে রেখেছে? শ্বেতাঙ্গবাদীরা গত চার-পাঁচ শ বছর ধরে কিভাবে রেখেছে? আদিবাসী আছে অস্ট্রেলিয়ায়। গত তিন-চার শ বছর ধরে শ্বেতাঙ্গ ইংরেজরা অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের কী অবস্থায় রেখেছে? বাংলাদেশে এবং পৃথিবীর বেশির ভাগ রাষ্ট্রে সে রকম আদিবাসী নেই। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য, তাদের সার্বিক উন্নতির জন্য উন্নত নতুন চিন্তা-ভাবনা ও কার্যক্রম দরকার। তাদের ভাষা রক্ষার, তাদের জাতির মূলধারার বাইরে রাখার, মানবজাতির মূলধারায় আসতে না দেওয়ার নীতি সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীগুলোর কোনো ভাষাকে কি বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা করার উপযোগী করে তোলা যাবে?</p> <p>বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশ কোনো এক জাতির দেশ নয়, এখানে বাঙালি ছাড়াও আরো কয়েকটি জাতি আছে। এ ছাড়া এই ঢাকা শহরেই গুলশান-বারিধারা এলাকার সংস্কৃতি আর পুরান ঢাকার সংস্কৃতি এক নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বুয়েট এলাকা ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ এলাকার সংস্কৃতি এক নয়। শ্রমজীবীদের সংস্কৃতি আর শিল্পপতিদের সংস্কৃতি, শহরের সংস্কৃতি আর গ্রামের সংস্কৃতি এক নয়। এই ধরনের কথায় কিছু সত্য অবশ্যই আছে। কিন্তু পূর্ণ সত্য যতটা আমরা বুঝি তা এঁদের বিবেচনায় নেই। জাতীয় সংস্কৃতি বলে তাঁরা কোনো কিছু স্বীকার করেন না। তাঁরা বহুত্ববাদী। কেবল সংস্কৃতির প্রশ্নে নয়—অর্থনীতি ও রাজনীতির প্রশ্নেও তাঁদের চিন্তা সর্বজনীন কল্যাণপরিপন্থী। রাষ্ট্রব্যবস্থায় সর্বজনীন কল্যাণের নীতিতে অবশ্যই অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার নীতি ও আইন থাকবে। উন্নততর নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জীবনপদ্ধতির জন্য নতুন চিন্তা-ভাবনা ও কার্যক্রম দরকার।</p> <p>বহুত্ববাদের কথা বলে বাংলাদেশের সব কিছুকে শুধু বিভক্ত করতে করতে দুর্বল করে চললে বাংলাদেশের ওপর বৃহৎ শক্তিবর্গের কর্তৃত্ব ও শোষণ বজায় রাখার সুবিধা হয়। সে জন্য এনজিও সিএসওকে তারা অর্থায়ন করে। এই অর্থের জোগান না থাকলে তারা কি এসব করত? এসব করার জন্য তাদের নিজেদের মত ও স্বাধীন চিন্তাশীলতা পরিহার করতে হয়।</p> <p>বাংলাদেশে বহুত্ববাদ কথাটির প্রয়োগ নানা দিক থেকে বিচার করে দেখা জাতীয় স্বাধীনতাকামী প্রত্যেক নাগরিকেরই একান্ত কর্তব্য। প্রত্যেক নাগরিকেরই নিজ নিজ জাতীয় কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন থেকে কিছু না কিছু কাজ করা দরকার। রাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা যদি ঘুমিয়ে থাকি, জাগ্রত না হই, কিছু না করি, তাহলে আমাদের কল্যাণ কে বা কারা করে দেবে?</p> <p>লেখক : রাষ্ট্রচিন্তক, আহমদ শরীফ চেয়ার অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়</p>