<p>যেকোনো দেশে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই আর্থিক ব্যবস্থাপনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থের উৎস, কিভাবে তা আহরণ ও ব্যয় করা হবে, কোথায় কোথায় ব্যয় করা হবে, অর্থ ব্যয়ের ফলাফল কী হবে, সর্বোপরি সরকারি অর্থ সংগ্রহ ও ব্যয়ে জনকল্যাণ কিভাবে নিশ্চিত হবে—এ সবই আর্থিক ব্যবস্থাপনার অংশ। সরকারি খাতের আর্থিক ব্যবস্থাপনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটা সরকারি-বেসরকারি সব খাতকে প্রভাবিত করে। সরকার সাধারণত করসহ বিভিন্ন উৎস থেকে অর্থ আহরণ করে তার ব্যয় মেটায়। তাই সার্বিকভাবে দেশের সরকার চালানোর জন্য, প্রশাসনের ব্যয়ের জন্য, উন্নয়নের জন্য, সামাজিক নিরাপত্তাসহ সব প্রয়োজনীয় কাজের জন্যই আর্থিক ব্যবস্থাপনা একটি জরুরি বিষয়। বাংলাদেশ সরকারও অন্যান্য দেশের সরকারের মতোই আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে।</p> <p>বাংলাদেশ সরকার ২০১৬-২১ সাল মেয়াদে সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংস্কার কৌশল প্রণয়ন করেছিল। কিন্তু এর অনেক বিষয় বাস্তবায়ন করা যায়নি। পরবর্তীকালে আবার একটি অ্যাকশন প্ল্যান করা হয় ২০১৮-২৩ মেয়াদে। সরকারের অর্থ বিভাগ এ কৌশল প্রণয়ন করেছিল। এর আলোকে আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো বিবেচনা করা দরকার। এই কৌশলের মূল বিষয় হচ্ছে সুশাসন ও জবাবদিহি। এ জন্য আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও অর্থের যথাযথ ব্যবহার—এই দুটি বিষয়ের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়।</p> <p>এ ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় মনে রাখা দরকার। একটা হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা। বিশেষ করে যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, তাদের রাজনৈতিক সংকল্প ও প্রতিশ্রুতি থাকা অপরিহার্য। বিশেষ করে সরকারে থাকা শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা ও প্রতিশ্রুতি থাকতে হয়। দ্বিতীয়ত, সরকারি কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতা। সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নের কাজটি সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধাসরকারি কর্মকর্তারা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেন। এ জন্য তাঁদের কর্মদক্ষতা খুব দরকার। তৃতীয়ত, সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনা স্বচ্ছ হচ্ছে কি না এবং এর প্রভাব জনগণের জন্য কল্যাণকর হচ্ছে কি না সেটা দেখা। এই তিনটা বিষয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখতে হয়।</p> <p><img alt="" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/ckfinder/innerfiles/images/Print Version Online/print /2022/04.April/16-04-2022/121/Untitled-1.gif" style="float:left; height:260px; margin:12px; width:329px" />বাংলাদেশে আর্থিক ব্যবস্থাপনায় জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর। এ ক্ষেত্রে এরপরই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন। সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার জন্য এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্রিয় ভূমিকা অপরিহার্য। এর বাইরের আরেকটি প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ ব্যাংক, যা দেশের সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ করে। আর্থিক খাতের অপরিহার্য মুদ্রানীতি বাংলাদেশ ব্যাংকই প্রণয়ন করে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যকলাপ সরকারের ব্যয় এবং কর আহরণের ওপর প্রভাব ফেলে। একইভাবে সরকারি সিদ্ধান্তসমূহও বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে সরকারি ঋণ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা অত্যন্ত বেশি। সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে, নাকি সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেবে তা দেখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ বিভাগ আছে। সেটি হচ্ছে পাবলিক ডেট ম্যানেজমেন্ট বিভাগ। সুতরাং সরকারের ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ ভূমিকা আছে।</p> <p>বাংলাদেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত আলোচনায় প্রথমেই আসে সরকারি ব্যয় প্রসঙ্গ। আমরা দেখছি, জাতীয় বাজেটে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু এ ব্যয় বৃদ্ধি কর্মসম্পাদনের ভিত্তিতে হয় না। সরকারি অফিস চলছে চলুক, বেতন দিতে হচ্ছে, দিয়ে যাও—এমন একটা অবস্থা। অন্যান্য দেশে যেভাবে পারফরম্যান্সভিত্তিক ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়, আমাদের এখানে সেটা দেখা যায় না। ফলে এখানে সবাই গত্বাঁধাভাবে চলছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে আরো বরাদ্দ কিসের ভিত্তিতে করা হবে সেটা সুস্পষ্ট করতে না পারলে আর্থিক ব্যবস্থাপনা যথাযথ হয় না।</p> <p>সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করে, সেটা কর হোক বা করবহির্ভূত। এটা জনগণের টাকা। প্রশাসনে হোক, উন্নয়নকাজেই হোক—এই টাকা ঠিকভাবে ব্যবহার করা হলো কি না সেটা অবশ্যই দেখা দরকার। না হলে কী হয়—এই মুহূর্তে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো শ্রীলঙ্কা। দেশটি বেশ কিছু দিন ধরে প্রচুর ঋণ নিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও প্রতিষ্ঠান থেকে। এসব ঋণ নিয়ে তারা বিরাট বিরাট প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে হাম্বানটোটা বন্দর, বিমানবন্দরসহ কয়েকটি মেগাপ্রকল্প রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর সবই চাহিদাভিত্তিক কি না, যৌক্তিকতা আছে কি না—সেই প্রশ্ন এখন উঠেছে। তার মানে যথাযথভাবে সম্ভাব্যতা যাচাই অর্থায়নের পূর্বশত—এই বিষয়টি সেখানে মান্য হয়নি। দ্বিতীয়ত, প্রকল্প যৌক্তিক হলেও তাতে যে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে সেটার সদ্ব্যবহার হয়েছে কি না সেটা দেখতে হয়। লক্ষ রাখতে হয় যে এখানে দুর্নীতি হতে পারে, অতিরিক্ত ব্যয় করা হতে পারে, সময় বৃদ্ধি করা হতে পারে, যা প্রকল্পের ন্যায্যতা ও ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠবে এবং ঋণের অর্থ বোঝায় পরিণত হতে পারে।</p> <p>এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। এখানে সরকার বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে যেসব প্রকল্প নিয়েছে সেগুলো নিয়ে নতুন করে ভেবে দেখতে হবে। কারণ এটাও আর্থিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পর্কিত। এখন পর্যন্ত আমাদের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ জিডিপির ৪২ শতাংশের মতো। অনেক দেশের তা ৮০ শতাংশ বা ১০০ শতাংশও আছে। ভারতের ঋণ জিডিপির তুলনায় প্রায় ৫০ শতাংশ। তবে আমাদের এই মুহূর্তের চিত্র হচ্ছে বৈদেশিক ঋণের বোঝা দিন দিন বাড়ছে। গত অর্থবছরের বাজেটে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের জন্য ৬ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে সেটা বাড়িয়ে ১১ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ ঋণের কিস্তি পরিশোধ ও সুদ বাবদ বাজেটের বিশাল একটা অংশ ব্যয় হচ্ছে। সুতরাং এসব ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থের সুষ্ঠু ব্যবহার অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এটা না হলে ঋণ বোঝায় পরিণত হবে, যেটা এখন শ্রীলঙ্কায় হচ্ছে।</p> <p>এ ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা দরকার। প্রথমত, দেখা দরকার যে কর, ভ্যাটসহ সরকারি আয় বা রাজস্ব সংগ্রহের পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াটির প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর কতটা পড়ছে। দ্বিতীয়ত, রাজস্ব ব্যয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসন এবং উন্নয়নকাজে আমরা ব্যয় করছি। কয়েক বছর আগে সরকার ব্যয় কমিশন নামে একটি কমিশন করেছিল। এই কমিশন করা হয়েছিল সরকারের ব্যয়টা ঠিকমতো হচ্ছে কি না তা দেখা। এই কমিশন বহু সুপারিশ করেছিল। কিন্তু এসব সুপারিশ আদতে আমলে নেওয়া হয়েছে কি না সে সন্দেহ জনমনে রয়েছে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশ সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনা বড় বিবেচনার দাবি রাখে, সেটা অভ্যন্তরীণ হোক বা বৈদেশিক হোক। আমরা যদি দিন দিন ঋণের ওপর নির্ভর করে চলতে থাকি, নিঃসন্দেহে তা দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।</p> <p>সরকারের অর্থ ব্যয় প্রসঙ্গে প্রকল্পগুলোর দিকেও নিবিড় নজর দেওয়া উচিত, যা নিয়ে প্রায়ই প্রশ্ন ওঠে। আমাদের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিবি) এমন বহু প্রকল্প আছে, যেগুলোর সামাজিক ও অর্থনৈতিক রিটার্ন বা অবদান খুবই কম। আমি মনে করি, এগুলো একেবারেই অর্থের অপচয়। এগুলো বাদ দিয়ে বরং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ভৌত অবকাঠামো, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রকল্প বাড়ানো হলে তা সরাসরি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়ন দুটিই নিশ্চিত করবে। বছরে বারো শ-তেরো শ প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, পাঁচ বছরের প্রকল্প ১০ বছর হয়ে যাচ্ছে, এক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পাঁচ হাজার কোটি টাকা হয়ে যাচ্ছে—এগুলো নিয়ে ভাবা দরকার। না হলে আর্থিক বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে।</p> <p>প্রকল্প প্রণয়ন নিয়েও প্রশ্ন আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় চাহিদাভিত্তিক নয়। সংশ্লিষ্ট এলাকার একটি প্রকল্পের দরকার আছে কি না, অর্থাৎ সেতু, কালভার্ট, রাস্তা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, স্কুল-কলেজ বা হাসপাতালের দরকার আছে কি না—সে চাহিদা যথাযথভাবে নিরূপিত হচ্ছে না, দেখতে হবে। ঢাকায় এক হাজার শয্যার হাসপাতাল হবে, নাকি তা ভেঙে চারটি জেলায় আড়াই শ করে চারটি হাসপাতাল করা কল্যাণকর হবে সেটা বিবেচনা করতে হবে। যেমন—আমাদের নিউরোলজি, কিডনি হাসপাতালসহ বিশেষায়িত চিকিৎসা সুবিধা সবই ঢাকায় করা হচ্ছে। একেকটি বড় বড় হাসপাতাল। কিন্তু ঢাকার বাইরে এ ধরনের বড় ও মানসম্মত হাসপাতাল নেই। ফলে চিকিৎসা বলতে সবাই ঢাকায় ছুটে আসে। সুতরাং ভেবেচিন্তে প্রকল্প প্রণয়ন করা হলে তা জনকল্যাণে অনেক বেশি কাজে লাগে।</p> <p>আমাদের বড় দুর্বলতা হচ্ছে বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন। সরকারের কাজের বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের জন্য আইএমইডি নামে একটি সংস্থা আছে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এটিও রুটিনকাজ করে। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ তথা সোশ্যাল অডিটিং বলে একটি ব্যাপার আছে। কিন্তু সেটা বাস্তবে দেখা যায় না। এর মধ্যে ই-অডিটিং চালু করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু তাতে মানুষের অংশগ্রহণ কিভাবে থাকবে সেটা এখনো বোঝা যাবে না। আমাদের এখানে ফিন্যানশিয়াল রিপোর্ট প্রণয়ন করা হয়, কিন্তু স্বচ্ছভাবে করা হয় না। সব শেষে আমি বলব, সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি বাজার, সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ—সব অংশীজনের ভূমিকা আছে। এ ক্ষেত্রে সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে এবং সরকারি অর্থের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।</p> <p>লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p> </p>