<p>আমাদের প্রাচীন সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম পরিবার। পরিবারে আমাদের জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং পরিবারেই আমাদের মৃত্যু। সামাজিকীকরণের প্রধান মাধ্যম পরিবার। পরিবারের বাইরে আমরা কোনো কিছু চিন্তা করতে পারি না। এক কথায় আমাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু আমাদের পরিবার। কিন্তু সেই পরিবারে যখন সহিংস আচরণ ঘটে তখন শুধু পরিবারই নয়, সমাজও অস্থির হয়ে ওঠে। রাষ্ট্রও কোনোভাবে বাদ যায় না। সবাইকে কমবেশি প্রভাবিত করে এবং ভাবিয়ে তোলে। কেননা এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী। যখন সহিংস আচরণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ইতি টানে এবং তিনি যদি কোনো পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হন, তখন কষ্টকে আরো বাড়িয়ে দেয়। নির্ভরশীলতার জন্ম দেয়। সহিংস আচরণের রেশ অন্য সদস্যদের ওপর ছড়িয়ে পড়ে। জন্ম নিতে পারে আরো একটি সহিংস আচরণের। পরিবারে আর্থিক অনটন, মান-অভিমান, রাগ, ক্ষোভ ইত্যাদি অনেক কিছু থাকবে। কিন্তু সেগুলোকে মোকাবেলা ও মিটমাট করার মধ্য দিয়েই পরিবারে শান্তি বজায় রাখতে হবে।</p> <p>সহিংস আচরণের মধ্য দিয়ে যদি উপরোক্ত অসংগতিগুলো দূর করতে চাই তার ফলাফল কোনো ভালো লক্ষণ নয়। বরং সমযোজন ও সামঞ্জস্য বিধানের মাধ্যমে পরিবারের যাবতীয় সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা উচিত। পরিবারের সব সদস্য নিজেরা বসে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে পারে। অন্যথায় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের কিংবা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে সাহায্য-সহযোগিতা চাইতে পারে। বিকল্প হিসেবে যখন কোনো কাজই না হয় তখন আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু সব কিছু নিজের হাতে তুলে নিয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার বশে কিংবা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে যদি হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ করা হয়, তবে তা সবার জন্য ভয়াবহ পরিণতি। কেন আমরা অসহিষ্ণু আচরণ করছি। নিজের কাছে নিজে প্রশ্ন করতে হবে এবং উত্তর নিজের থেকেই বের করতে হবে। আমাদের সহিংসতা পরিহার করে সহযোগিতা ও সমঝোতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে এবং মিলেমিশে থাকার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। তবেই একেকটি পরিবার হয়ে উঠবে আনন্দের চারণভূমি।</p> <p>পারিবারিক সহিংসতার মাত্রা আমাদের সমাজে ক্রমান্বয়ে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। গত তিন মাসে পারিবারিক কলহের জেরে ৬৬ জন নারী ও ৩১টি শিশু খুন হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮ জন নারী স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন বলে অভিযোগ এসেছে। হয়েছে মামলাও। নিহতদের ১৪ জনের বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এ সময়ে ২৪ জন নারী আত্মহত্যাও করেছেন। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনটি কালের কণ্ঠ প্রকাশ করেছে। সহিংস আচরণ এমন পর্যায়ে পৌঁঁছে গেছে যেখানে আপন দুই ভাইয়ের অন্য ভাইকে গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। গত রবিবার রাতে নরসিংদীর রায়পুরায় বাড়ির আঙিনায় গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে এক ভাইকে হত্যা করে অন্য দুই ভাই। তাদের মধ্যে কোনো একটি বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল।</p> <p>মনোমালিন্য ও দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে। এগুলো না থাকলে পরিবার ও সমাজ পরিশীলিত হয় না। কিন্তু তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যেত। তা না করে জীবন শেষ করে দেওয়া যে কতটা হিংস্র আচরণ তা বলা বাহুল্য। এদের মধ্যে কি এমন মানসিকতা কাজ করেছিল যে আপন ভাইকে মেরে ফেলতে হবে। তারা কি এর পরিণতি সম্পর্কে অবগত নয়। অবশ্যই জানে, কিন্তু এর পরও তাদের মনোজগৎ, মানসিক অস্থিরতা ও মানসিক স্বাস্থ্য তাদের এমন এক পর্যায় নিয়ে গেছে, যার করুণ পরিণতি আপন ভাইয়ের মৃত্যু। আমাদের এই জায়গাগুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু আইন দিয়ে এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী দিয়ে আমরা সহিংস আচরণ প্রতিরোধ করতে পারব না।</p> <p>দৈনন্দিন জীবনে আমাদের প্রতিনিয়ত বিভিন্ন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়। আমাদের সমস্যার ধরনও সাধারণ, আবার ভিন্নও বটে। সমস্যা মোকাবেলার ধরনও একেকজনের একেক রকম। এমন পরিস্থিতিতে আমরা প্রতিনিয়ত চাপ অনুভব করি। চাপকে মোকাবেলা করতে কেউ কেউ ধৈর্যের পরিচয় দেয়। কিন্তু অনেকের মোকাবেলার ধরন ভিন্ন হয়। তখন অসহিষ্ণু আচরণ করে বসে। আমরা যদি আচরণ করার আগে একটু ভাবি, তাহলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ থেকে আমরা নিজেকে দূরে রাখতে পারি। আমাদের মধ্যে অনেক সময় মানসিক অস্থিরতা কাজ করে। কিন্তু সেই অস্থিরতাকে মোকাবেলা করার জন্য নিজেকে আগে থেকেই তৈরি করা এবং সে অনুযায়ী কাজ করলে মোকাবেলা করা সহজ হয়।</p> <p>মানসিক স্বাস্থ্য একটি বড় বিষয়। আমরা অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টিকে গুরুত্ব দিই না। ব্যক্তি নিজে অনেক সময় তার মানসিক অসুস্থতা সম্পর্কে ভালোভাবে না-ও বুঝতে পারে। তার চলন-বলন ও কথাবার্তায় অসুস্থতা প্রকাশ পায় । কিন্তু সে নিজে হয়তো বুঝতে পারে না এবং বুঝলেও অনেক সময় স্বীকারও করতে চায় না। কিন্তু পরিবার ও অন্য সদস্যরা বুঝতে পারে। ব্যক্তির মানসিক সমস্যা অন্যের জন্য স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরিবারে এমন কোনো সদস্যের মধ্যে মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ পরিলক্ষিত হলে তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। তাকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করা জরুরি। সাধারণত অসুস্থতার মাত্রা কম হলে পরিবার ও সমাজ প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় তাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা বড় হলে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা দরকার। কেননা মানসিক অসুস্থ ব্যক্তি যেকোনো সময় সহিংস আচরণ করতে পারে।</p> <p>আমরা বর্তমানে এমন একসময় অতিক্রম করছি, যেখানে প্রতিযোগিতা, ভোগবাদিতা, ওপরে ওঠা, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন ও প্রমাণ করা ইত্যাদির মধ্যে নিজেকে দেখতে চাই। বিপরীতে সহযোগিতা, সহমর্মিতা নিজেকে ছোট মনে করার মানসিকতার বড় অভাব। অসুস্থ প্রতিযোগিতায় আমরা মত্ত। আমরা সন্তানকে লেখাপড়ায় শ্রেষ্ঠ বানাতে চাই; কিন্তু শ্রেষ্ঠ মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ বানাতে চাই কি। যদি চাই তাহলে ফিরে আসতে হবে পরিবারের দিকে। পরিবারকে সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু ভেবে সব সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। তবেই আমরা পারিবারিক সহিংসতার মাত্রা কমাতে পারব।</p> <p>একটি উক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। প্রযুক্তি উদ্ভাবক ও উদ্যোক্তা, পার্সোনাল কম্পিউটার বিপ্লবের পথিকৃৎ, আইফোনের সহউদ্ভাবক স্টিভ জবসই কর্কট রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুশয্যায় বলেছিলেন, ‘যদিও আজ আমি হাজার কোটি টাকার মালিক, অথচ আমার সব সম্পদ মৃত্যুদেবতার হাতে অর্পণ করেও আরেকটি রাত বেশি বাঁচার কোনো উপায় নেই।’ কাজেই আমরা কেউই এই পৃথিবীতে বাঁচব না; কিন্তু তারপর কেনই বা আমরা সহিংস হচ্ছি একে অপরকে মেরে ফেলতে একটুও কার্পণ্য করছি না।</p> <p> </p> <p> লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ</p> <p>শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়</p> <p>neazahmed_2002@yahoo.com</p> <p> </p>