<p>প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্টই হোক, স্মরণকালের ইতিহাসে এমন ভয়াবহ দুর্যোগের সম্মুখীন হয়নি সিলেট বিভাগ (যা শুধু সিলেট বিভাগেই সীমাবদ্ধ নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকা আজ ভয়াবহ বন্যার কবলে)। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ফেলে জীবন বাঁচাতে যেভাবে মানুষ ছুটছিল নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, আজ বন্যাকবলিত লোকজনও তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাচ্ছে। আরাম-আয়েশ ও জীবনকে সাজাতে বা জীবনের প্রয়োজনে কেনা প্রয়োজনীয় বা বিলাসসামগ্রী আসবাবপত্র সব কিছুর মায়া ছেড়ে পরিবারের বয়োবৃদ্ধ ও কোমলমতি শিশুদের নিয়ে কেউ উঠছে বহুতল ভবনের দোতলা বা এর ওপরে, কেউ যাচ্ছে বন্যামুক্ত এলাকার আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। আবার যাদের এ ধরনের অবলম্বন নেই তারা ছুটছে সরকার ঘোষিত আশ্রয়কেন্দ্রে।</p> <p>আমি যখন লেখাটি লিখছি তখন আমার বাসায় কোমর পর্যন্ত পানি। আমার স্ত্রী ও বন্ধু-বান্ধবের সহায়তায় কিছু আসবাবপত্র রক্ষা করতে পারলেও অনেক কিছুই পানিতে তলিয়ে গেছে। আমার নিকটাত্মীয়ের বাড়িতে স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ আশ্রয় নিয়েছি। সিলেট, বিশেষত উপশহর এলাকা সবচেয়ে বন্যাকবলিত হওয়ায় দেশ-বিদেশ থেকে অনেক বন্ধু-বান্ধব শুভাকাঙ্ক্ষী খোঁজখবর নিচ্ছে। আমার পরিচিত অনেক অবস্থাসম্পন্ন মানুষকে ত্রাণের খিচুড়ি খেতে দেখেছি। এ এক অবর্ণনীয় অবস্থা।</p> <p>সিলেট বিভাগের বন্যার পানি সুরমা-কুশিয়ারা হয়ে মেঘনায় দিয়ে ভৈরবের দিকে ধীরে ধীরে নেমে গেলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগ শেষ হতে সময় লাগবে। বসতবাড়ি থেকে পানি নামতে অনেক সময় লেগে যেতে পারে। আর পানি নামলেই অনেকের বসতঘর বসবাস উপযোগী হবে না। কর্মহীন মানুষজনের অন্নসংস্থানে খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। পানিবাহিত রোগ বন্যার মতোই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে। স্বাস্থ্য বিভাগকে প্রয়োজনে ফিল্ড হাসপাতাল চালু করার মতো পরিস্থিতি হতে পারে। সিটি করপোরেশন ও পৌর কর্তৃপক্ষ রাস্তায় পড়ে থাকা ময়লা-আবর্জনা, মৃত পশুর দেহাবশেষ যত দ্রুত অপসারণ করতে পারে ততই মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। বন্যার পানিতে ঘরে থাকা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের খাদ্যসামগ্রী ভেসে গেছে। খাদ্যসংকট মোকাবেলায় ঢাকা ও অন্যান্য এলাকা থেকে এর সরবরাহ ত্বরিত ও গতিশীল করতে হবে। এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানবিক বিপর্যয় যাতে ভয়াবহ ও অনিয়ন্ত্রিত না হতে পারে তার ব্যবস্থা এখন থেকেই শুরু করতে হবে।</p> <p>উদ্ধারকাজে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিজিবি নামানো সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। দুর্যোগ শেষ হওয়া পর্যন্ত পেশাদার বাহিনীগুলোকে দুর্গত এলাকায় রাখা প্রয়োজন। সরকারি সাহায্য যাতে দুর্ভোগের শিকার সঠিক লোকজনের কাছে সঠিকভাবে, সঠিক সময়ে পৌঁছে তা নিশ্চিত করতে হবে। এসব সহায়তা বণ্টনে যাতে দুর্নীতি না হয় সে ব্যাপারে সরকারকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। বন্যার তীব্রতা অনুযায়ী মানুষের সহায়-সম্বলের বেশি ক্ষতি হলেও প্রাণহানি অনেকটাই কম হয়েছে। তবে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে খাদ্যাভাব ও রোগাক্রান্ত হয়ে প্রাণহানি যাতে না বাড়ে সেটা নিয়ে এখনই কাজ শুরু করতে হবে। </p> <p>এবার আসা যাক কেন এই দুর্যোগ? দুর্ভোগ ও বন্যাকবলিত এলাকার হিসেবে এবারের দুর্যোগ অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এশিয়ার উজানের পানি বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়, এটি কি এবারই ঘটছে? বাংলাদেশে মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে অতিবৃষ্টি হবে, এটাও স্বাভাবিক। অতীতে হাওর ও নদীতীরবর্তী এলাকাগুলোতে মূলত বন্যা সীমিত ছিল। এবার কেন শহর ডুবল? সিলেট বিভাগের ৮০ শতাংশের বেশি এলাকা আজ বন্যার কবলে পড়ল।</p> <p>অপরিণামদর্শী ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে প্রকল্পবাজিতে দেশের নদী, খাল-বিল, জলাশয়, হাওরকে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। এসব জলাধার বুক চিতিয়ে অতিবৃষ্টির পানি বয়ে নিয়ে যেত সাগরে। নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে খালে পরিণত হয়েছে, খালগুলো হয়েছে নিশ্চিহ্ন। পুকুরগুলো ভরাট করা হচ্ছে। বিশ্বের একমাত্র প্রাকৃতিক বিস্ময় ও সুবিশাল জলরাশি হলো বাংলাদেশের হাওর। সেই হাওরে আড়াআড়ি সড়ক নির্মাণে আজ পানিপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার ঘোষণা দিয়েছে, যেসব রাস্তা বা সড়ক পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে, তা যেন কেটে ফেলা হয়। তাহলে বন্যা শেষ হলে কি এসব রাস্তা আবার মেরামত করা হবে? অবশ্যই সেটা যৌক্তিক হবে না। সেই সব কাটা রাস্তায় সেতু নির্মাণ করতে হবে। কারণ আমাদের উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা না বুঝলেও প্রকৃতি বুঝিয়ে দিয়েছে এখানে সেতু দরকার। দেশের নদী ও খাল ধ্বংসের জন্য দায়ী বক্স কালভার্টগুলো ধীরে ধীরে অপসারণ করে পুরো প্রশস্ততা অনুযায়ী নৌচলাচল উপযোগী সেতু নির্মাণ করতে হবে। সিলেটের প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারার দুই পার দখলমুক্ত করে খননের মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। হাওর নিয়ে প্রকল্পবাজি বন্ধ করতে হবে। হাওরকে হাওরের মতো না রাখলে প্রতিবছর এ ধরনের বন্যা দেখা দেবে। ফসল রক্ষার জন্য হাওরে যেসব বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলোতে পর্যায়ক্রমে পর্যাপ্ত স্লুইস গেট নির্মাণ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারবে।</p> <p>আমরা প্রায়ই বলি, বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় চ্যাম্পিয়ন। সেটা না বলে দুর্যোগ যাতে না ঘটে তার ব্যবস্থা গ্রহণে মনোযোগী হওয়া ছাড়া বাংলাদেশের বিকল্প নেই। জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের রেকর্ডের পেছনে দৌড়ানোর চেয়ে আজ বেশি প্রয়োজন জননিরাপত্তা নিশ্চিত। আর একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম উন্নয়ন প্রপঞ্চ হলো, জননিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পরিবেশগত নিরাপত্তা। আর পরিবেশগত নিরাপত্তা বাংলাদেশে পুরোপুরি থাকলে আজকে অতিবৃষ্টি ও উজানের পানি নেমে এসে বন্যার মাধ্যমে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটত না।    </p> <p> লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট ও জাতীয় পরিষদ সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)</p> <p>jahirul-psa@sust.edu</p>