<p>দেশে দেশে রাজনীতিতে নায়ক যেমন আছে, ঠিক আবার খলনায়কের কমতি নেই। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতিতে প্রথম খলনায়কের আবির্ভাব ঘটে ১৯৭৫ সালে খোদ বাংলাদেশের স্বাধীনতায় নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে যখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী, দলের শীর্ষ নেতাদের একজন আর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুকে ১৫ই আগস্ট সপরিবারে হত্যা করার শতাব্দীর সবচেয়ে ঘৃণ্য কাজটি করার দায়িত্বে থাকা ঘাতকদের নেতৃত্ব দেন। এই ঘাতক দলের পরিকল্পনায় যেমন ছিলেন বেশ কিছু সেনাবাহিনীর মধ্য পর্যায়ের সদস্য, ঠিক তেমনি জড়িত ছিলেন আওয়ামী লীগের কিছু মাঝারি পর্যায়ের নেতা। আর পুরো বিষয়টা সম্পর্কে আগে থেকেই অবহিত ছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপপ্রধান জেনারেল (তখন ব্রিগেডিয়ার) জিয়াউর রহমান, যিনি পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন আর বাংলাদেশের রাজনীতিকে এক অন্ধকার যুগে নিয়ে গিয়েছিলেন।</p> <p>বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর উপপ্রধানের পদটি জিয়ার জন্যই সৃষ্টি করেছিলেন। জিয়াকে খুনি ফারুক-রশিদ গং বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রের কথা মার্চ মাসেই জানিয়েছিল। প্রজাতন্ত্রের একজন দায়িত্বশীল সেনা কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ছিল খবরটি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানানো। তা না করে তিনি খুনিদের এই কাজে উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে খুন করার পর খুনিরা প্রথমে খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদে বসায়। মোশতাক এরপর যে অপকর্মটি করেন তা হলো তাঁর হাত ধরে বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃৃতির দ্বার উন্মুক্ত হয়। বঙ্গবন্ধুকে খুন করার পর কিন্তু সংসদ বাতিল করা হয়নি। খন্দকার মোশতাক সংসদের অধিবেশন না ডেকে ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এক অধ্যাদেশ জারি করে ঘোষণা করেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুসহ যাঁদের হত্যা করা হয়েছে সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার বাংলাদেশের কোনো আদালতে করা যাবে না। এই অধ্যাদেশকে বলা হয় দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশ। তিনি পঁচাত্তরের ঘাতকদের দেশের সূর্যসন্তান হিসেবে উল্লেখ করেন। এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল। দেশে দেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হয়েছে; কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার করা যাবে না এমন কোনো আইন কখনো কোথাও হয়নি। যদিও অধ্যাদেশটি খন্দকার মোশতাকের হাত দিয়ে করানো হলেও এটি বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এর পেছনে কালো হাতটি ছিল জিয়ার। কারণ যদিও তিনি তখন উপপ্রধান-সামারিক আইন প্রশাসক ছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার আসল ক্ষমতা ছিল তাঁর হাতে। এরই মধ্যে সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকে প্রেষণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পরে তাঁর জায়গায় জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান পদটি দখল করেন। ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করার পর জিয়াউর রহমান খন্দকার মোশতাককে উত্খাত করে বঙ্গবন্ধুর নিয়োগ করা বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি এ এস এম সায়েমকে সাক্ষীগোপাল রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে পদায়ন করেন। একই সঙ্গে ঘোষণা করা হয় জিয়াসহ তিন বাহিনীপ্রধান উপপ্রধান-সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন।</p> <p><img alt="" src="http://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/ckfinder/innerfiles/images/Print Version Online/print /2022/07.July/09-07-2022/121/1.jpg" style="float:left; height:260px; margin:12px; width:332px" />জিয়াউর রহমান শুধু যে ক্ষমতালোভী ছিলেন তা-ই নয়, তিনি প্রচণ্ড ধূর্তও ছিলেন। কিছুদিন না যেতেই তিনি বিচারপতি সায়েমের ওপর চাপ সৃষ্টি করেন, তিনি যেন রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। বিচারপতি এ এস এম সায়েম ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত বইয়ে সব লিখেছেন। ‘অ্যাট বঙ্গভবন : লাস্ট ফেইজ’ (বঙ্গভবনে শেষ দিনগুলো) বইয়ে তিনি লিখেছেন, জিয়া শেষের দিকে প্রায় প্রতি রাতে আরো কিছু সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে বঙ্গভবনে আসতেন এবং তাঁকে পদত্যাগ করতে চাপ দিতেন। প্রথম দিকে তিনি তা করতে অস্বীকার করলেও শেষের দিকে পরিস্থিতি এমন হলো যে জিয়া বিচারপতি সায়েমের খাটে বুটসহ পা তুলে দিয়ে তাঁর কাছ থেকে জোরপূর্বক স্বাক্ষর আদায় করার চেষ্টা করতে থাকেন। একদিন তাঁকে পিস্তলের ভয় দেখালে তিনি তাঁর পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। ঘোষণা করা হয়, তিনি শারীরিক কারণে পদত্যাগ করছেন এবং তাঁর জায়গায় উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করবেন। রাত্রিকালীন কারফিউ দিয়ে জিয়া তাঁর ‘দায়িত্ব’ পালন শুরু করেন। জিয়া নিজের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার পর ১৯৭৯ সালে এক সাধারণ নির্বাচনের তামাশা অনুষ্ঠিত করেন।</p> <p>জিয়া এর আগে এক ফরমানবলে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনে অংশ নিলেও কোথাও ‘বঙ্গবন্ধুু’ নাম তেমন একটা ব্যবহার করতে পারেনি। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে কোনো মতে ৩৯টি আসন দেওয়া হয় আর জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপিকে দেওয়া হয় ২০৭টি আসন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদে জিয়া সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনী বিল উত্থাপন করেন এবং সেই সংশোধনীতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের জুলাই পর্যন্ত যতগুলো অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল তার সবই ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে তা সংবিধানের অংশ করে ফেলা হয়। এই দিনটি ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি ঘোর তমসাচ্ছন্ন দিন। এমন একটি কর্ম শুধু মানবতাবিরোধই নয়, বরং সভ্যতার মুখে চরম চপেটাঘাত। জিয়ার পক্ষে সবই সম্ভব ছিল। অথচ যেহেতু সংসদে বিএনপির দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল, তিনি চাইলে এই অধ্যাদেশ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত না করে তা বাতিল করতে পারতেন। ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। তিনি বঙ্গবন্ধুর সব খুনিকে বিদেশে পালিয়ে যেতে সুযোগ করে দেন এবং বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পুরস্কার হিসেবে সব খুনিকে বিভিন্ন দূতাবাসে কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে পদায়ন করেন।</p> <p>জিয়ার মৃত্যুর পর কিছুদিন তাঁর উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি রাষ্ট্রপতিও নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর ক্ষমতাও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তাঁকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ। তিনিও জিয়ার পথে হেঁটেছেন। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে হাত দেননি।</p> <p>১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের মুখে এরশাদের পতন হলে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জিয়ার স্ত্রী খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসেন। তিনি সংবিধান থেকে এই আইনটি বাতিল করলে হয়তো ইতিহাস তাঁকে অন্যভাবে মূল্যায়ন করত। কিন্তু তিনি স্বামীর রেখে যাওয়া লিগ্যাসির ওপর কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এই আইন বাতিল করার জন্য একটি বিল সংসদে উত্থাপন করে এবং নভেম্বর মাসে এই মানবতাবিরোধী আইন সর্বসম্মতিক্রমে বাতিল ঘোষণা করা হয়। যার ফলে ১৯৭৫ সালের ঘাতকদের বিচারের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়। যেদিন এই আইন সংসদে বাতিল ঘোষিত হয়, সেদিন বিএনপি সংসদে অনুপস্থিত থাকে।</p> <p>২০০৫ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সামরিক আইনের মাধ্যমে জিয়ার দেশ শাসনকে বেআইনি ঘোষণা করেন। যে জিয়ার শাসনামল নিয়ে বিএনপির নিত্যদিন বাগাড়ম্বর, সেই জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের আইনের বিচারে একজন খলনায়ক ছাড়া আর কিছুই নন। তিনি চেষ্টা করেছিলেন বাংলাদেশকে একটি মিনি পাকিস্তান বানাতে। ভাগ্য তাঁর পক্ষে ছিল না। তবে তাঁর স্ত্রীও কম চেষ্টা করেননি। তিনিও ব্যর্থ হয়েছেন। হাজার হলেও এই দেশ ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ।</p> <p> </p> <p> লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক</p>