<p>ব্রিটিশ-বাংলায় লেখাপড়ার চর্চা সীমিত থাকলেও সাগ্রহে শিক্ষার্থীরা যা অর্জন করতেন, তা ছিল নিখাদ। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ সনদ সংগ্রহ করেও মর্যাদাকর সরকারি কর্মসংস্থান সীমিত ছিল। ফলে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে আত্মসম্মান অক্ষুণ্ন রেখে শিক্ষাদান ব্রত গ্রহণ করতেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সামন্ত-আধাসামন্তরা ব্যক্তিগত বা পিতৃপুরুষের নাম স্মরণীয় রাখার অভিপ্রায়ে সেই নামে নামকরণ করতেন। ব্রিটিশ-বাংলায় ব্রিটিশ রাজপুরুষের নামে প্রতিষ্ঠান গড়া হতো কৃপাপ্রাপ্তির জন্য। দেশভাগের পর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ আর লিয়াকত আলী, ফজলুল হকের নামে অনেক প্রতিষ্ঠান একই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে নেতাদের নাম ভজিয়ে স্বার্থসিদ্ধির পাঁয়তারা কম হয়নি। লেখা বাহুল্য, প্রতিষ্ঠানটিকে সরকারের আওতায় পৌঁছে দেওয়া হতো একটা আপাত সম্মানজনক জীবিকার পথ তৈরি করার জন্য, অবশ্যই শিক্ষার জন্য নয়। সত্যি কথা বলতে কী, সুলভ সনদপ্রাপ্তির বাজারে এখন ভারবাহী ডিগ্রির অভাব নেই। ফলে যত্রতত্র উচ্চশিক্ষার নামে সনদ কারখানা গড়ে উঠছে। এখান থেকে কী সুফল মিলবে, তা জানার জন্য গবেষণার প্রয়োজন নেই।</p> <p>আমাদের দেশের শিক্ষা পরিবেশনের কাঠামো ভাঙা-গড়ার ধারা বহুবিস্তৃত। তার ভেতর দিয়ে আমরা কম এগোইনি! অথচ স্থায়ী পদ্ধতি আজও স্বীকৃত হয়নি কোনোটি। হলে নিত্যনতুন চিন্তাচেতনা ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গে নাজিল হতো না। তবে শিক্ষা বিভাগ দেখভালের জন্য যাঁরা দায়িত্ব পান, তাঁরা নতুন একটা কিছু করে চমক লাগাতে চান। আমরা দল বেঁধে সে হুজুগে গা ভাসাই। এতে পত্রিকায় ছবি ছাপা হলে আত্মশ্লাঘায় আপাত আনন্দে মশগুল থাকি। অবশ্য জীবনের মতো শিক্ষাও গতিশীল। এখানে পরিবর্তন আসতে পারে। তাই বলে দেশ-কাল-পাত্র-পরিবেশ বিস্মৃত হলে চলবে কেন!</p> <p>ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে এবং সমাজজীবনকে বিতর্কের ফাঁদে না ফেলে বঙ্গবন্ধু একটা জীবনভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেছিলেন। উচ্চশিক্ষায় ‘যারে খুশি তারে দাও’ নীতি অবলম্বন করেননি। যাচাই না করে ‘যারে তারে’ শিক্ষকের মর্যাদা না দেওয়ার জন্য চিন্তা-ভাবনা করেছেন। দীর্ঘদিন ধর্মঘট করেও ফল পায়নি কেউ। আমরা পরদেশি প্রভু আজ্ঞায় পিতৃহন্তক হলাম এবং শিক্ষাকে বিতর্কের জালে আবদ্ধ করলাম। আমাদের ভাবিত করল না—মরু কিংবা তুষার সংস্কৃতি আমাদের শ্যামল শোভায় বেমানান। শিক্ষায় মতবাদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে তাকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দিলাম। আর ষোলোকলা পূর্ণ করলাম, যাঁরা কোনোক্রমে শিক্ষকতার ধারেকাছে আসার যোগ্যতা রাখেন না তাঁদের শিক্ষক বানিয়ে শিক্ষার ঘরে সর্বনাশ ডেকে আনলাম।</p> <p>আমাদের বড় সমস্যা, আমরা কারা, কী শেখাচ্ছি তা নির্ধারণ করা যায়নি। অর্থাৎ কাঠামো ঠিক না করে উপরি কাঠামো নিয়ে গলদঘর্ম। এ কারণে নানা নৈরাজ্য।</p> <p>উনিশ শতকে দেখা গেছে, বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্ত প্রমুখ মিলে শিক্ষার মাধ্যম এবং বিষয়ের একটা তালিকা তৈরি করেছিলেন। বিষয়গুলোতে বেশির ভাগ শিক্ষানুরাগী একমত না হলেও সহমত পোষণ করেছিলেন, তবে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এঁদের ভাবনা অভিন্ন ছিল। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, নিখাদ শিক্ষার জন্য শক্ত মেরুদণ্ডের শিক্ষক অপরিহার্য। যাঁরা সংকল্পে হেমিংওয়ের মতো ভাঙবেন; কিন্তু মচকাবেন না। দুঃখের বিষয়, আমরা সেই মৌলিক বিষয়টি গুরুত্বহীন করে ফেলেছি। প্রসঙ্গত একটা অনুচ্ছেদ সংযোজন করা যায়। আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মাঝে মাঝে সরস কৌতুকের মাধ্যমে আমাদের সমাজজীবনের কিছু বিষয় তুলে ধরেন, যা আমাদের লক্ষ্যহীন স্বভাবের জন্য প্রযোজ্য। তাঁর বক্তব্য, সমাজের অনেক পেশাজীবীর রাজনীতিক হওয়ার খায়েশ জাগে; বোঝে না রাজনীতিক হতে হলে দীর্ঘ অনুশীলন ও ত্যাগের প্রয়োজন। কয়জন রাজনীতিক পেশাজীবী বৃত্তির ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন! আমরা এর সঙ্গে সংযুক্ত করি শিক্ষক, শিক্ষক হয়েই জন্মায়, খায়েশ হলেই শিক্ষক সাজা বেমানান, তাঁকে সর্বোচ্চ মেধাবী এবং সততার পরাকাষ্ঠা দেখাতে হয়। নতুবা কিছু কর্মসংস্থান জোগাড় করতে না পেরে শিক্ষকতায় এলেই শিক্ষক হওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বড়জোর মুদি দোকানি হওয়া যায়।</p> <p>শোনা যায়, শিক্ষাক্ষেত্রে বিশ্ব র্যাংকিংয়ে আমরা হাজারের কোটায় স্থান পাই না। তবে আমাদের কিছু সন্তান ব্যক্তিগত সাধনায় দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন। এটা অলৌকিক নয়, তাঁদের স্বয়ংজাত পরিণতি। আমরা দলবাজি, মতবাদাশ্রয়ী, অর্থের দাপট আর স্বজনপ্রীতি দেখিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে দুর্বল করে ফেলেছি ভুয়াদের সজ্জন বানিয়ে। একসময় প্রাথমিক শিক্ষার বনিয়াদ গড়া হতো যথার্থ পণ্ডিতের হাতে। বঙ্গবন্ধু তা অধিকতর সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে তা জাতীয়করণ করেন। তাকে পৈশাচিকভাবে সরিয়ে শিক্ষক নিয়োগের দেখভালকারীরা টাকার বিনিময়ে কিছু শিক্ষাহীন সনদধারীদের নিয়োগ দিয়েছে। তারপর এসেছে কোটার যুগ। এখানেও ভুয়ার ভূত। মনে রাখা দরকার, কোটা দিয়ে প্রকৃত হকদারদের বাঁচার পথ করে দেওয়ার জন্য অনেক বিভাগ আছে। শিক্ষা কেন! শিক্ষা যে একটি জাতির শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম নির্ণায়ক। তাকে তো গড্ডলিকায় ভাসিয়ে দেওয়া যায় না। শিক্ষক নিয়োগের এমনতর ধারা উচ্চশিক্ষাকেও কলুষিত করেছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনেকটা অনিয়মের আখড়ায় রূপান্তরিত। সত্যিকার শিক্ষকের চেয়ে শিক্ষক নামধারী কিছু উপার্জক দেখছি। তাঁরা জ্ঞান আহরণ ও বিতরণ অপেক্ষা গাড়ি-বাড়ির স্বপ্নে বিভোর। না, হবে কেন! ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবেন বলে বিজ্ঞান বিষয় বেছে নিয়েছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময়। সেটা হওয়া যায়নি, এমনকি অনেকে বিজ্ঞানের বিষয় পড়ে এসে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ার সুযোগ না পেয়ে অপেক্ষাকৃত সহজ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ নিয়ে সহজলভ্য শিক্ষকতায় নানা পন্থায় জায়গা করে নিয়েছেন। এখান থেকে শিক্ষার্থীরা কাম্য শিক্ষা কেমন করে পাবেন!</p> <p>ইদানীং দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থী শিক্ষকের ওপর চড়াও হচ্ছেন। আগেও হতো। তবে পার্থক্য হলো তখন দুর্বৃত্তরা ছিল ভিনদেশিদের দালাল। দেশ নিয়ে ভাবনা তাদের ছিল না। এক টুকরো মাংসেই তারা তৃপ্ত। এখন দেখছি হত্যা, লাঞ্ছনা ইত্যাদি ঘটনা পত্রপত্রিকায় আসছে। সহসা তার প্রতিকার কিভাবে হবে! সনদসর্বস্ব, দলবাজ, মতবাদী শিক্ষক রোগ বাড়াবে, নিরাময়ের পথ হবে সংকীর্ণ। শিক্ষককে জ্ঞানী-গুণী অবশ্যই হতে হবে, তার চেয়ে অপরিহার্য তিনি একচোখা হবেন না সর্বজনীন স্বীকৃত সত্য ব্যতীত।</p> <p>একজন শিক্ষার্থী যদি মতবাদের ফাঁদে না পড়ে শিক্ষকের জ্ঞানের ভাণ্ডারের প্রতি আকৃষ্ট হয়, তবে সে আকর্ষণ হয় স্থায়ী। আমাদের সন্তানরা বহু একচোখা মতবাদীকে নগদ প্রাপ্তির বিনিময়ে সমীহ করে। কিছু না জানাদের পাস করিয়ে দেওয়া, শিক্ষক নামধারী ব্যক্তির প্রকাশ্য পক্ষপাত শিক্ষার্থীদের বিক্ষুব্ধ করে। এর মূল পরিপ্রেক্ষিত নষ্ট রাজনীতি আর অমূলক মতবাদে। শিক্ষার্থীরা বোঝে কোনো শিক্ষক ন্যায়বিচার না করে অন্যায়ভাবে প্রকৃত মেধাবীকে ডুবিয়ে দেন। হায়, একদা আদর্শ শিক্ষকরা ন্যায়বিচারের প্রতীক হতেন। পাড়ার নাম শিক্ষকের নামে হতো। আজকের কিছু শিক্ষক হালুয়া-রুটির লোভে বিবেক বিসর্জন দিচ্ছেন। কেউ কেউ আবার সাপ্লায়ার সাজছেন, তাঁরাও পুরস্কৃত হন। এতসব ‘দেখিয়া শুনিয়া’ শিক্ষার্থীরা অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। তা ছাড়া প্রতিপত্তিলোভীদের কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি কিছু ছাত্রের নৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিচ্ছে। কেউ কেউ অন্যায় করে পুরস্কৃত হচ্ছে। আমরা দেখেছি বাংলাদেশের জন্মলগ্নে প্রকাশ্যে হত্যাকারীদের ক্ষমতালোভীরা পুরস্কৃত করেছেন। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে দুর্বৃত্তায়ন কমছে না।</p> <p>‘মরিলে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন’—এমন মানবচরিত্র অধুনা দুর্লভ হলেও দুর্লক্ষ্য নয়। এদের সমন্বয়ে সত্যিকার শিক্ষক নির্বাচন করা গেলে অচিরেই দুর্দিনের অবসান ঘটবে। আমরা সেই আশায়ই বসে আছি।</p> <p> লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ</p> <p> </p>