<p>আজকের লেখাটি দুজন প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তির বক্তব্য দিয়ে শুরু করি। প্রথমজন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে বঙ্গবন্ধু গিয়েছিলেন চট্টগ্রামে। স্থানীয় সার্কিট হাউসে তিনি মিলিত হন জেলার বিভিন্ন পেশার মানুষ ও শিক্ষাবিদদের সঙ্গে। উদ্দেশ্য, একটি সদ্যঃস্বাধীন হওয়া দেশ পুনর্গঠনে তাঁদের পরামর্শ চাওয়া। সমাপনী বক্তব্য দিতে গিয়ে শিক্ষা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শুধু আমলা সৃষ্টি করেছে, মানুষ সৃষ্টি করেনি।’ বঙ্গবন্ধু বলে দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পেশাজীবীদের সম্পর্কে এই কঠিন সত্যটা উচ্চারণ করতে সাহস পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় বক্তব্যটি ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের। তখন তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর দায়িত্ব শেষ করেছেন। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে ভারতের আহমেদাবাদের বিখ্যাত আইআইএম-এর এক অনুষ্ঠানে অতিথি বক্তা হিসেবে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘উন্নয়নের সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে আমলাতন্ত্র।’ এটি সত্য, আমলা ছাড়া কোনো দেশের প্রশাসন চলতে পারে না। তবে তাতে যদি তন্ত্র যোগ হয়, তাহলেই দেশের সর্বনাশের শুরু। আমলাদের কাজ হচ্ছে নীতিনির্ধারকদের কাজে সহায়তা ও তা বাস্তবায়ন করা। নীতিনির্ধারক যদি কোনো ভুল করে থাকেন বা কোনো কিছু না জেনে থাকেন, তাঁকে এ ব্যাপারে আইনি সহায়তা দেওয়া। কিন্তু তা না করে কোনো আমলা যদি নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নীতিনির্ধারককে বিপথে চালিত করেন, তখনই হয় সর্বনাশ, যা যেকোনো সরকারকে বিপদে ফেলতে পারে। সরকার পরিবর্তন হলে নানা কারণে অনেক সময় কারাবরণ করেন রাজনীতিবিদরা। কোনো আমলাকে কারাবরণ করতে হয়েছে, তেমনটি খুব একটা দেখা যায়নি।</p> <p>এই মুহূর্তে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র যেকোনো সময়ের চেয়ে ক্ষমতাবান। কখনো কখনো মনে হয় তাঁদের ক্ষমতা সরকারপ্রধানের চেয়েও বেশি। এই ক্ষমতা তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে অবসরের পরও ভোগ করেন। আর একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আমলা কখনো অবসরে যান না। নিজ কর্মক্ষেত্র থেকে অবসর নেওয়ার পর কেউ হন কোনো সরকারি করপোরেশনের প্রধান বা কোনো সরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান অথবা কেউ যান রাষ্ট্রদূত হয়ে। কিংবা বিশ্বব্যাংকে বড় বেতনের চাকরি নিয়ে চলে যান কেউ। একজন কর্তব্যনিষ্ঠ আমলার অন্যতম কাজ হচ্ছে দেশের প্রকৃত অবস্থা বা কোনটা আইনি সিদ্ধান্ত আর কোনটি নয় বা কোনটি নীতিবিরোধী তা সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানকে সঠিক সময়ে অবহিত করা। বর্তমানে তা তেমন দেখা যাচ্ছে বলে মনে হয় না। সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান যা শুনলে খুশি হবেন সেটাই যদি তাঁর চারপাশের আমলারা তাঁকে সব সময় শোনাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তখন তা বিপদ ডেকে আনতে পারে। বঙ্গবন্ধুর আমলে ১৯৭৪ সালে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে তখন তাঁকে খাদ্য মজুদ বা প্রাপ্যতা সম্পর্কে যে আমলাটি অসত্য তথ্য সরবরাহ করতেন তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়ার উপদেষ্টা ও পরে খাদ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাঁর সন্তান এখন বিএনপির বড় নেতা।</p> <p><img alt="" src="http://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/ckfinder/innerfiles/images/Print Version Online/print /2022/10.October/30-10-2022/kalerkantho-6-2022-10-30-01a.jpg" style="float:left; height:302px; width:332px" />তবে আরো একটি কথা সত্য, দেশে নানা ধরনের আমলা থাকলেও তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর হচ্ছেন প্রশাসন ক্যাডারের আমলারা। পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষার সময় দেখা যায় যাঁরা অন্য ক্যাডারে দু-তিন বছর কাজ করেছেন তাঁদের মধ্যে অনেকে চেষ্টা করেন প্রশাসনিক ক্যাডার সার্ভিসে প্রবেশ করতে। তাঁদের মধ্যে অনেকে সফলও হন। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। আমলাতন্ত্র যাকে বলে, তা কিন্তু অন্য সার্ভিসে খুব বেশি তেমন একটা দেখা যায় না, যেমনটি দেখা যায় প্রশাসনিক কাজে আমলাদের ক্ষেত্রে। ১৯৪৭ সালে ভারত কেটে পাকিস্তান নামে একটি দেশ সৃষ্টি হয়েছিল। অনেকে বলে দেশ মানে ভারত ভাগ। বাস্তবে কিন্তু ভাগ হয়েছে বাংলা আর পাঞ্জাব। এই ভাগ ছিল সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কিন্তু ইতিহাসের গতি তো আর এখন পরিবর্তন করা যাবে না। যে পাকিস্তান নিয়ে উপমহাদেশের, বিশেষ করে উত্তর ভারত ও বাংলার মুসলমানদের মধ্যে এত উচ্ছ্বাস ছিল, সেই পাকিস্তান মাত্র ২৩ বছরে কেন ভেঙে গেল? তার অন্যতম কারণ পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে অযাচিত হস্তক্ষেপ।</p> <p>পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর ভারত থেকে বেশ কিছু আইসিএস অফিসার পাকিস্তানে চলে আসেন এবং পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় জেঁকে বসেন। মনে রাখা ভালো, এই আমলাতন্ত্রের সৃষ্টি ঔপনিবেশিক আমলে, তৎকালীন ঔপনিবেশিক শাসকদের সেবা করতে। একটি স্বাধীন দেশকে সেবা করার জন্য নয়। তাঁদের মানসিক চিন্তা-ভাবনাও ঔপনিবেশিক শাসকদের মতো হয়ে পড়েছিল। শরীরের রং ভারতীয়, কিন্তু চিন্তা-চেতনায় ইংরেজ শাসক। স্বাধীন দেশের কাজ করার জন্য তাঁরা ছিলেন সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। কিন্তু শুরুতে পাকিস্তানের রাজনীতিতে যোগ্য রাজনীতিবিদ না থাকায় তাঁরাই হয়ে পড়েন পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্মাতা। কিছু দক্ষ রাজনীতিবিদ ছিলেন, কিন্তু তাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন বাঙালি। আর পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে বাঙালিরা ছিল অনেকটা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। শুরু থেকেই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ চলে গিয়েছিল ভারত থেকে আসা আমলাদের হাতে, তা এখন আরো জোরদার হয়েছে। পাকিস্তানে এই সামরিক-বেসামরিক আমলাদের দৌরাত্ম্যে গত ৭৫ বছরে কোনো সরকার তার পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। ১৯৫৪ সালের ২৪ অক্টোবর পাকিস্তান গণপরিষদ যখন দেশটির সংবিধান রচনায় ব্যস্ত তখন এই সামরিক-বেসামরিক আমলাদের প্ররোচনায় দেশটির গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ নজিরবিহীনভাবে সেই গণপরিষদ ভেঙে দেন। এই আমলাদের শঙ্কা ছিল পাকিস্তানে সংবিধান প্রণীত হলে দেশের শাসনভার রাজনীতিবিদ তথা জনপ্রতিনিধিদের হাতে চলে যাবে, আর তাঁদের কাজ করতে হবে রাজনীতিবিদদের অধীনে। এই গণপরিষদ ভেঙে দেওয়াটা ছিল একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পাকিস্তানের সম্ভাবনার কফিনে প্রথম পেরেক। পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন ও তা কার্যকর করার জন্য ১৯৭২ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। তাও বেশিদিন টেকেনি। গোলাম মোহাম্মদও একজন আমলা ছিলেন।</p> <p>১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে জয়ী হয় এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর মওলানা ভাসানীর যুক্তফ্রন্ট। পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। মুসলিম লীগের পরাজয় ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত। সেই সরকারের পতন ঘটাতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আদমজী আর চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনা কাগজকলে বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা শুরুর ক্ষেত্রে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যসচিব আজিজ আহমেদ, যিনি ১৯৪৭ সালের আগে ছিলেন একজন আইসিএস অফিসার। তিনি করাচিতে খবর পাঠান পূর্ব বাংলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই খারাপ এবং প্রাদেশিক সরকারের পক্ষে তা সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। ছয় সপ্তাহের মাথায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ফজলুল হক মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে এবং সংসদ ভেঙে দেয়। জারি করা হয় গভর্নরের শাসন। কিছুদিন পর পূর্ব বাংলার গভর্নর হয়ে আসেন মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা। আইয়ুব খান পূর্ব বাংলার জিওসি থাকাকালে তাঁর সঙ্গে আজিজ আহমেদের বেশ সখ্য গড়ে ওঠে।</p> <p>শুরু থেকেই বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র নিয়ে বঙ্গবন্ধু চিন্তিত ছিলেন। যদিও তাঁর সময় তিনি বেশ কিছু যোগ্য, দেশের প্রতি অনুগত আমলা জড়ো করতে পেরেছিলেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য অধ্যাপক রেহমান সোবহানের একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘Untranquil Recollections’ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক আনিসুর রহমান ও অধ্যাপক রেহমান সোবহান। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁরা একটি স্বাধীন দেশের জন্য পরিকল্পনা তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। রেহমান সোবহান লিখেছেন, অনেক সময় অনেক প্রতিকূল পরিবেশ সামাল দিতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু সরাসরি হস্তক্ষেপে। কিন্তু এক পর্যায়ে পাকিস্তানফেরত একজন বড় মাপের আমলা এসে সদস্য হিসেবে কমিশনে যোগ দিলে তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য হন। কারণ তাঁদের চিন্তা ও কর্মপন্থার সঙ্গে সেই আমলার প্রায়ই মতভিন্নতা তৈরি হতো। সেই আমলার যোগ্যতার কোনো ঘাটতি ছিল না। তিনি অত্যন্ত মেধাবী ও যোগ্য আমলা ছিলেন। কিন্তু হয়তো পরিকল্পনা কমিশনের জন্য তিনি যথাযথ ছিলেন না।</p> <p>কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের আমলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব, কৃষি, অর্থ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য,  জনপ্রশাসন, পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র উল্লেখযোগ্য। এই মন্ত্রণালয়ের আমলারা যদি রাষ্ট্রের ও জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে যেকোনো সরকারপ্রধানের পক্ষে দেশ পরিচালনা অনেক সহজ হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে তা হতে দেখা যায় না। তাতে সমস্যায় পড়েন সরকারপ্রধান। এইতো কয়েক দিন আগে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা জনসমক্ষে বলে ফেললেন, ‘প্রয়োজনে দিনের বেলায়ও লোড শেডিং হবে।’ তিনি একজন জাঁদরেল আমলা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা অনবদ্য। কিন্তু তাঁর একটা বাক্য সরকারকে কত বেকায়দায় ফেলতে পারে তা কি তিনি চিন্তা করেছেন?</p> <p>কিছু কিছু আমলার চাহিদা অবিশ্বাস্যভাবে বেড়েছে। এখন একজন জেলা প্রশাসকও বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সদস্য হওয়ার বায়না ধরছেন, যা আইন অনুমোদন করে না। এরই মধ্যে কোনো কোনো আমলা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য পর্যন্ত হয়ে গেছেন। পরেরটা হওয়ার জন্যও নাকি চেষ্টা হচ্ছে। তেমনটি যদি হয়, তাহলে এ দেশে বর্তমানে শিক্ষার যে নাজুক হাল, আরো কত নাজুক হতে পারে তা সহজে অনুমেয়।</p> <p>বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের কথা উল্লেখ করেছিলাম। বঙ্গবন্ধু তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে আইন বা অধ্যাদেশ দ্বারা কয়েকটি কমিশন গঠন করেছিলেন। এমন আরেকটি কমিশনে আমার দায়িত্ব পালন করার সৌভাগ্য হয়েছে। সেই কমিশনের আইনের ৪(৩) ধারায় পরিষ্কার উল্লেখ আছে, চেয়ারম্যান ব্যতীত কমিশনের কোনো সদস্য দ্বিতীয় মেয়াদে মনোনীত হতে পারবেন না। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অতীতেও তা ভঙ্গ হয়েছে, এখনো হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর তা হয়তো জানা না-ও থাকতে পারে। এটি সম্পর্কে যথাযথ ধারণা দেওয়ার দায়িত্ব ছিল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলার। তা কিন্তু দেওয়া হয়নি। না হওয়ার কারণ হচ্ছে, এই কমিশনে আমলাদের মাথা ঢোকানোর চেষ্টা অনেক দিনের।</p> <p>সব শেষে বলতে হয়, এত কিছুর পরও দেশে এখনো কিছু দায়িত্বশীল দক্ষ, মেধাবী ও নিষ্ঠাবান আমলা আছেন, কিন্তু তাঁদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আগামী নির্বাচনের আগে এসব বিষয়ে নজর দেওয়া না হলে সর্বপ্রথম সমস্যা হবে সরকারের, কোনো আমলার নয়। বলা হয়, আমলারা পরের সরকারের জন্য কাজ করতে মুখিয়ে থাকেন।</p> <p> লেখক : বিশ্লেষক ও গবেষক</p>