ঢাকা, মঙ্গলবার ০৭ জানুয়ারি ২০২৫
২৩ পৌষ ১৪৩১, ০৬ রজব ১৪৪৬

ঢাকা, মঙ্গলবার ০৭ জানুয়ারি ২০২৫
২৩ পৌষ ১৪৩১, ০৬ রজব ১৪৪৬

জি২০-এর আগে ও পরে কী ঘটেছে

গাজীউল হাসান খান
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
জি২০-এর আগে ও পরে কী ঘটেছে

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এই প্রথম ৮০ বছর বয়সে পদার্পণ করা কোনো প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছেন। তার পরও তিনি আশা করছেন তাঁর প্রেসিডেন্সির দ্বিতীয় টার্মের জন্য তিনি লড়তে প্রস্তুত। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বয়সে প্রবীণ হলেও ডেমোক্রেটিক দলের এই রাষ্ট্রপ্রধান অত্যন্ত সুচতুর, সাহসী এবং স্মার্ট বলে গণমাধ্যমের একটি অংশের ধারণা। বিশ্বব্যাপী বর্তমান উথাল-পাথাল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও বাইডেন আশাবাদী তিনি তাঁর প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করতে সম্পূর্ণভাবে সক্ষম।

তাঁর প্রতিপক্ষের মধ্যে এখনো প্রধান অবস্থানে রয়েছেন তাঁর পূর্ববর্তী রিপাবলিকানদলীয় সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্টদের তালিকায় ট্রাম্প একজন গোঁয়ার্তুমি ও স্বেচ্ছাচারিতাপ্রবণ ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত। তাঁর উগ্র জাতীয়তাবাদী (শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ) এবং ‘একলা চলার নীতি’ যুক্তরাষ্ট্রকে তাঁর শাসনামলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং এমনকি ইউরোপ থেকেও বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগেই ডেমোক্রেটিক দলের সমালোচকরা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন যে ট্রাম্পের কোনো রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক পূর্বাভিজ্ঞতা নেই।

যুক্তরাষ্ট্রে যাকে বলা হয় মুক্ত বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী পরাশক্তি, সেই দেশ পরিচালনার জন্য ট্রাম্পের নেই তেমন উচ্চশিক্ষা কিংবা উন্নত দর্শন। বর্ণবাদী এবং সাম্প্রদায়িক এই ব্যক্তিটি চরিত্রহীন, স্বেচ্ছাচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে এখনো সমালোচিত হচ্ছেন। সেসব কারণে তাঁর দ্বিতীয় টার্মের নির্বাচনে তিনি তাঁর ডেমোক্রেটিকদলীয় প্রতিপক্ষ সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে বিপুল জনপ্রিয় ভোটে হেরে যান। কিন্তু সেই নির্বাচনের রায়কে মেনে নেননি তিনি।
তদুপরি ৬ জানুয়ারি ২০২১ সালে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হস্তান্তরকে কেন্দ্র করে ক্যাপিটল হিলে চলাকালীন এক গুরুত্বপূর্ণ সভায় সশস্ত্র হামলা চালায় ট্রাম্পের দাঙ্গাবাজ সমর্থকরা। ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন কংগ্রেস ভবনের বাইরে এক মঞ্চে অবস্থান করছিলেন। সেই সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পই এখন আবার তৃতীয়বারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য তাঁর প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন আইনি অভিযোগ ও তদন্ত প্রক্রিয়া মাথায় নিয়ে।

উল্লিখিত পরিস্থিতিতে মধ্যবর্তী নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েও রাজনৈতিক অবস্থা তাঁর অনুকূলে রয়েছে বিবেচনা করে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর দ্বিতীয় টার্মে নির্বাচনের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছেন। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক তথ্যাভিজ্ঞ মহল তাঁর বয়স, যুক্তরাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং বিশ্বপরিস্থিতির কথা সামনে রেখে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে বিষয়টি আবার ভেবে দেখার অনুরোধ জানিয়েছে।

কারণ কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদ হারানোর ফলে তাঁর পক্ষে কোনো বিল উত্থাপন কিংবা আইন পাস করা সহজ হবে না। এ ক্ষেত্রে কংগ্রেসের উচ্চ পরিষদ সিনেটে ডেমোক্র্যাটরা সামান্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখতে সক্ষম হলেও আইনি বা সাংবিধানিক ক্ষেত্রে পাল্টাপাল্টি করা ছাড়া বেশি দূর অগ্রসর হওয়ার সুযোগ কমে গেছে। তা ছাড়া ২০২৪ সালে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জো বাইডেনের প্রতিপক্ষ রিপাবলিকানরা যে আগামী দুটি বছর কংগ্রেসের ভেতরে-বাইরে কিংবা নির্বাচনী মাঠে অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও তৎপর থাকবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন-পরবর্তী অবস্থায় ইন্দোনেশিয়ার বালিতে গত ১৫-১৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলোর নেতাদের জি২০ শীর্ষ সম্মেলন। জি২০ শীর্ষ সম্মেলন হলো পরাশক্তিগতভাবে সমৃদ্ধ ও ধনিক-বণিক দেশগুলোর নেতাদের বিশ্বকাপ ফুটবলের মতো। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ভারত ও অন্যরা বিভিন্ন কৌশলে তাদের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করে। বিশ্ববাণিজ্য, প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করে। সদ্যঃসমাপ্ত শীর্ষ সম্মেলনে স্বাগতিক দেশ ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো যখন বিশ্বের বর্তমান অর্থনৈতিক দুরবস্থা, মুদ্রাস্ফীতি ও সম্ভাব্য বিশ্বমন্দা রোধকল্পে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে আকুল আহ্বান জানাচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন তখন তাইওয়ান, ইন্দোপ্যাসিফিক বাণিজ্য পথ, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের নিরাপত্তা বিধান নিয়ে সোচ্চার থেকেছে। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবসান বা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গলদঘর্ম হয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ থামানো নিয়ে দুই দিনের শীর্ষ সম্মেলনে কাঙ্ক্ষিত আলোচনা হলেও তা থামানোর ব্যাপারে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া কিংবা কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়নি। বিশ্ববাণিজ্যের প্রসার কিংবা সম্ভাব্য বিশ্ব মন্দারোধকল্পে সম্মিলিতভাবে তেমন কোনো ব্যবস্থা চালুর নির্দেশ এখনো পাওয়া যায়নি। জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের আগের দিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত তিন ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠক সম্মেলনে যোগদানকারী অন্য সদস্য দেশগুলো কিংবা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিল। সেটিই এবারের শীর্ষ সম্মেলনের একমাত্র সাফল্য বলে বিবেচিত হয়েছে।

‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বলে এক উগ্র জাতীয়তাবাদী স্লোগানের মাধ্যমে দেশের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট (২০১৭-২০২১) হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর শাসনকালের চার বছরে ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের অন্যতম প্রধান পরাশক্তিগতভাবে আন্তর্জাতিক প্রায় সব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিলেন। লোকরঞ্জনবাদী এই নেতা সামরিক, কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে তাঁর ‘একলা চলো’ নীতির কারণে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো কিংবা বৃহত্তরভাবে সামগ্রিক বিশ্বব্যবস্থা থেকেই দূরে সরে আসতে চেয়েছিলেন তাঁর দৃষ্টিতে আমেরিকান স্বার্থের কারণে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের অপরিমিত অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে ইউরোপে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর নিরাপত্তা বিধান করতে অস্বীকৃতি জানান। শুধু তা-ই নয়, অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের বহুপক্ষীয় চুক্তি এবং সম্পর্ককে সংকুচিত করে বহুপক্ষীয় ব্যবস্থার মধ্যে আনার চেষ্টায় অনেকটা হন্যে হয়ে উঠেছিলেন। রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তাঁর এক অঘোষিত সম্পর্ক থাকলেও চীনের বিরুদ্ধে ট্রাম্প শুরু করেছিলেন এক বাণিজ্য লড়াই। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল চীনকে সামরিক এবং বিশেষ করে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বের এক নম্বর অবস্থানে পৌঁছতে না দেওয়া। পরবর্তী সময়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ডেমোক্রেটিকদলীয় প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও বিশেষ করে চীনের বিরুদ্ধে সেই নীতিই অনুসরণ করতে থাকেন। ট্রাম্পের মতো, বিশেষ করে শুধু অর্থনৈতিক কিংবা বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেই নয়, সামরিক দিক থেকেও জো বাইডেন বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি কিংবা আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়ে ওঠেন। তারই ধারাবাহিকতায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে মাঠে নামেন বাইডেন। অকাস কিংবা কোয়াড নামের সামরিক জোট কিংবা সংস্থা গঠন করে তিনি চীনের আর্থ-সামরিক প্রভাব থেকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত এবং এমনকি তাইওয়ানসহ ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর নিরাপত্তা বিধান করতে চেয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃত ‘এক চীন নীতি’কে পাশ কাটিয়ে তাইওয়ানের স্বাধীনতার দাবির প্রতি সমর্থন জোগাতে শুরু করেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। তাতে নতুন প্রেক্ষাপট কিংবা পরিসরে আরেক স্নায়ুযুদ্ধ বা ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সূচনা হয়েছে এ অঞ্চলে। তথ্যাভিজ্ঞ মহল কিংবা আন্তর্জাতিক সংবাদ বিশ্লেষকদের বিভিন্ন অভিযোগ বা সেই সমালোচনার মুখে শুরু হয়েছিল রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ। এ ক্ষেত্রেও ইউরোপের ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর বৃহত্তর নিরাপত্তার প্রশ্নে রাশিয়াকে ভেঙে টুকরা টুকরা করার এক সাম্রাজ্যবাদী প্রয়াসে লিপ্ত হয়েছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। তার ফল ভোগ করছে এখন করোনা-পরবর্তী নাজুক বিশ্ব।

ওপরে উল্লিখিত সার্বিক পরিস্থিতিতে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে অঘোষিত দ্বন্দ্ব বা বিরোধ চলছিল তাকে সামনে রেখেই এগিয়ে আসে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে অনুষ্ঠিত জি২০ নেতাদের শীর্ষ সম্মেলন। আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলনের প্রাক্কালে অনেকটা অপ্রতাশিতভাবেই যুুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং এক বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে। তিন ঘণ্টা স্থায়ী সেই বৈঠকে জো বাইডেন ও শি চিনপিং রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘর্ষ থেকে শুরু করে বর্তমান বিশ্বে বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। এবং সেই পথ ধরে উত্থাপিত হয়েছিল দুই দেশের মধ্যে বিরাজমান সবচেয়ে কঠিন ইস্যু তাইওয়ান প্রসঙ্গ। প্রেসিডেন্ট শি চিনপিংয়ের মতে, তাইওয়ান মূল চীন ভূখণ্ডের একটি অবিচ্ছদ্য অংশ। তাঁর অভিযোগ ছিল, যুক্তরাষ্ট্র ‘এক চীন নীতির’ স্বীকৃতি দিলেও তাইওয়ানের স্বাধীনতার দাবিকে কিভাবে সমর্থন জোগায়। এতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ক্রমে ক্রমে সংকট ও উত্তেজনা আরো ঘনীভূত হচ্ছে। তাইওয়ানকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক মহড়া ও সৈন্য সমাবেশ আরো বৃদ্ধি পাছে। শি চিনপিং সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, তাইওয়ান চীনের কাছে ‘প্রথম লাল লাইন (ফার্স্ট রেড লাইন)’, যা নীতিগতভাবে কোনো প্রকারেই লঙ্ঘন করা যাবে না। বাইডেন প্রত্যুত্তরে জানিয়েছেন, সেটা নিয়ে নতুন পরিসরে আরেকটি শীতল যুদ্ধের সূচনা করার প্রয়োজন নেই। তবে তিনি তাঁর সহযোগী মিত্র দেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাবিষয়ক উপদেষ্টা জেইক সোলিভানের এ অঞ্চলে তাঁদের সেনাবাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করার প্রত্যয়ের মুখেও প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, এ অঞ্চলে বিরাজমান সংকটের নিরসনকল্পে তিনি তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেনকে বেইজিং পাঠাবেন বিস্তারিত আলোচনার জন্য। বাইডেন ও শি চিনপিং উভয়েই এ ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয়ভাবে আলোচনা ও যোগাযোগ বৃদ্ধির ওপর জোর দেন।

এ অবস্থায় আগামী ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, যাতে দ্বিতীয় টার্মে লড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন বৃদ্ধ বাইডেন। ট্রাম্পের ভাগ্যে ভবিষ্যতে যা-ই ঘটুক, প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া তাঁর বিরোধী রিপাবলিকান দল এরই মধ্যে ভেতরে-বাইরে শুরু করেছে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও ডেমোক্র্যাটদের বিরোধিতা। প্রতিনিধি পরিষদের ওভারসাইট কমিটি অভিযোগ করেছে, নিজ পরিবারে প্রেসিডেন্টের অংশগ্রহণের পরিমাণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। বাইডেনের প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় তাঁর পুত্র হান্টার বাইডেন বিদেশে তাঁর পরিচয়ে বিশাল অঙ্কের বাণিজ্য করেছেন এবং কর ফাঁকি দিয়েছেন। তাতে প্রেসিডেন্ট জড়িত। এ বিষয়টি ও অন্যান্য অভিযোগ নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অভিসংশন প্রস্তাব উত্থাপন করা হতে পারে। সুতরাং এসবের প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিরোধী রিপাবলিকানদের কাছ থেকে কতটুকু সহযোগিতা পাবেন তা সহজেই অনুমেয়। এ অবস্থায় রাশিয়া, চীন কিংবা তাঁর বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী বা আধিপত্যবাদী কর্মসূচি নিয়ে কত দূর এগোতে পারবেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন? এ বিষয়গুলো নিয়ে আমেরিকার ঘরে ঘরে এখন নতুন হিসাব-নিকাশ শুরু হয়েছে।

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

gaziulhkhan@gmail.com

 

 

মন্তব্য

মিসাইল কূটনীতি ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা

ড. সুজিত কুমার দত্ত
শেয়ার
মিসাইল কূটনীতি ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা

মিসাইল কূটনীতি আধুনিক আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বিতর্কিত অধ্যায়। এই কৌশল মূলত সামরিক শক্তি প্রদর্শন ও ভৌগোলিক-রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্যবহৃত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে পাকিস্তানে চীনের মিসাইল স্থাপন এবং ফিলিপিন্সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসাইল মোতায়েন এই কূটনীতির উদাহরণ। চীনের লক্ষ্য হলো পাকিস্তানের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের সামরিক এবং কৌশলগত উপস্থিতি শক্তিশালী করা, যা ভারতের জন্য একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।

অন্যদিকে ফিলিপিন্সে মার্কিন মিসাইল স্থাপন চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলার প্রচেষ্টা, বিশেষত দক্ষিণ চীন সাগরে। এ ধরনের মিসাইল কূটনীতি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পায়, যার প্রভাব সরাসরি সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা এবং অর্থনীতিতে পড়ে। বড় শক্তিগুলোর এই প্রতিযোগিতা ছোট রাষ্ট্রগুলোকে নিজেদের ভৌগোলিক অবস্থান এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে আরো সংকটে ফেলে।
মিসাইল কূটনীতি শুধু সামরিক শক্তির প্রদর্শন নয়, বরং এটি রাজনৈতিক এবং কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের একটি অস্ত্র। ফলে এটি শান্তি স্থাপনের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে এবং বৈশ্বিক নিরাপত্তাকে জটিলতর করে তোলে।

গত মাসে মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এই নিষেধাজ্ঞাগুলোর কারণ হিসেবে মিসাইল প্রযুক্তি বিস্তারের আশঙ্কা তুলে ধরা হয়।

নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কমপ্লেক্স (এনডিসি), যা পাকিস্তানের মিসাইল এবং পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচির কেন্দ্রস্থল। এ ছাড়া নিষেধাজ্ঞার তালিকায় এমন কিছু রহস্যজনক প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলো সংবেদনশীল প্রযুক্তি স্থানান্তরের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব নিষেধাজ্ঞা সরাসরি পাকিস্তানকে লক্ষ্যবস্তু করলেও এর প্রভাব চীনের ওপরও পড়বে। কারণ চীন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে জটিল এক ভূ-রাজনৈতিক চিত্র বিদ্যমান।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পাকিস্তানের উন্নত মিসাইল প্রযুক্তি, বিশেষ করে দীর্ঘ পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি নতুন হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এনডিসিসহ চারটি পাকিস্তানি সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, পাকিস্তানের এই প্রযুক্তি উন্নয়ন বৈশ্বিক স্থিতিশীলতায় একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। চীন দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা অবকাঠামোতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। পাকিস্তানের মিসাইল এবং পারমাণবিক কর্মসূচির উন্নয়নে চীনের ভূমিকা অনেক সময় স্পষ্ট আবার অনেক সময় আড়ালে থেকে যায়। চীন এই অঞ্চলে তার প্রভাব বজায় রাখতে পাকিস্তানকে একটি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে ব্যবহার করছে।

২০২৪ সালের শুরুতে মার্কিন সেনাবাহিনী ফিলিপিন্সের উত্তরাঞ্চলে একটি মাঝারি পাল্লার মিসাইল সিস্টেম স্থাপন করে। এটি বার্ষিক যৌথ সামরিক মহড়ার অংশ হিসেবে সেখানে নেওয়া হলেও পরে এটি স্থায়ীভাবে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চীন এই পদক্ষেপের কঠোর সমালোচনা করে এবং এটিকে এশিয়ার স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করে। ফিলিপিন্সের সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল রয় গালিডো এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এই মিসাইল সিস্টেমটি অত্যন্ত কার্যকর এবং আমাদের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপ কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দক্ষিণ চীন সাগরের ওপর চীনের দাবি চ্যালেঞ্জ করার জন্য এটি ব্যবহার করা হতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুধু পাকিস্তান ও ফিলিপিন্সের মতো দেশগুলোকেই প্রভাবিত করছে না, বরং সমগ্র এশিয়া এবং বিশ্বরাজনীতিকে একটি অনিশ্চিত অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এই প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই মিসাইল প্রতিযোগিতা নতুন মেরুকরণ তৈরি করছে। একদিকে চীন-পাকিস্তান জোট এবং অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ফিলিপিন্স জোট বিশ্বরাজনীতিতে একটি বিভাজন তৈরি করছে। এই বিভাজন বৈশ্বিক সহযোগিতার পরিবেশকে বিঘ্নিত করছে এবং নতুন সংঘাতের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। নিরাপত্তার অজুহাতে অস্ত্র প্রতিযোগিতা নতুন মাত্রা পেয়েছে। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিধর দেশগুলো তাদের মিত্র দেশগুলোকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে আরো তীব্র করে তুলবে। এই প্রতিযোগিতা শেষ পর্যন্ত একটি বড় সংঘাতের দিকে ধাবিত হতে পারে।

বিশ্বব্যাপী মিসাইল কূটনীতির নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দেশের মধ্যে সংলাপ বৃদ্ধি করতে হবে। জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এই সংলাপকে এগিয়ে নিতে একটি প্ল্যাটফরম তৈরি করতে পারে। আন্তর্জাতিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির আওতায় নতুন মিসাইল প্রযুক্তির বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। এই চুক্তির মাধ্যমে অস্ত্র প্রতিযোগিতার ঝুঁকি হ্রাস করা সম্ভব। দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আঞ্চলিক শান্তি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এসব উদ্যোগ অস্ত্র প্রতিযোগিতার চেয়ে উন্নয়ন এবং স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করবে।

মিসাইল কূটনীতি একটি জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়, যা বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানে চীনা মিসাইল এবং ফিলিপিন্সে মার্কিন মিসাইল স্থাপনের ফলে এশিয়ার নিরাপত্তা পরিবেশ আরো জটিল হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত এই ঝুঁকি মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।

লেখক : সাবেক সভাপতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

 

মন্তব্য

বাঙালি কী করে বাঙালি হবে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
শেয়ার
বাঙালি কী করে বাঙালি হবে

আমরা আগে বাঙালি, না আগে মুসলমান সে নিয়ে একসময় একটি বিতর্ক ছিল; বিজ্ঞজনরা বলতেন যে বিতর্কটি নিতান্তই অহেতুক। কেননা একই সঙ্গে বাঙালি ও মুসলমান হতে কোনো অসুবিধা নেই। বাঙালিত্ব ও মুসলমানত্বের ভেতর বিরোধ যে নেই সেটি সত্য, কিন্তু তবু বিরোধ তো একটি তৈরি করা হয়েছিল এবং সেই বিরোধটি যখন তুঙ্গে উঠল, তখন অখণ্ড বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করা ছাড়া উপায় রইল না। এতে বাঙালির যে কত বড় সর্বনাশ ঘটেছে, সেটির পরিমাপ করা অসম্ভব।

কিন্তু ঘটনার অল্প পরেই বেশির ভাগ বাঙালি বাস করে যেখানে, সেই পূর্ববঙ্গে আওয়াজ উঠল যে ভুল হয়ে গেছে, আমরা আগে বাঙালি, তার পরে মুসলমান। দাবি উঠল ওই সত্য বাস্তবায়নের। ফলে পূর্ববঙ্গ স্বাধীন হয়ে গেল, প্রতিষ্ঠা হলো বাংলাদেশের। বাংলাদেশে আমরা আগে বাঙালি, পরে অন্য কিছুমুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান ইত্যাদি।

ব্যাপারটি আত্মপরিচয়ের। বাঙালি নিজেকে বাঙালি বলেই পরিচয় দেবেএটিই স্বাভাবিক, ঠিক যেভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকে, আমরা সেভাবেই বলব আমরা বাঙালি বটে। কিন্তু কাকে আমরা বাঙালি বলব? নিরিখটি কী? প্রথম নিরিখটি পরিষ্কার। সেটি হলো বাংলা ভাষার চর্চা।

তাকেই বাঙালি বলা যাবে, যে বাংলায় কথা বলে, এই সংজ্ঞাটি সহজ। কিন্তু বাঙালি ছাড়াও অনেকে বাংলা বলতে পারে। তাই কেবল বাংলা বললেই বাঙালি হবে, এটি বলা যাবে না। একটু এগিয়ে গিয়ে বলতে হবে যে সে-ই হচ্ছে বাঙালি, যে বাংলা ভাষার চর্চা করে এবং অন্য বাঙালির সঙ্গে সহমর্মিতা অনুভব করেতাদের দুঃখে কাতর হয়, তাদের আনন্দে উত্ফুল্ল এবং সবার উন্নতি চায়। এই যে সহমর্মিতা, এর একটি নাম সামাজিকতা, আরেকটি নাম দেশপ্রেম।

বাঙালি কী করে বাঙালি হবেসামাজিক হওয়া চাই, দেশপ্রেমিকও হওয়া চাই, নইলে নয়। অর্থাৎ এককথায় বাঙালি হতে হলে মানুষ হতে হবে। সামাজিকতা ও দেশপ্রেম মনুষ্যত্বেরই অংশ বটে, অপরিহার্য অংশ। যে মানুষ সামাজিক নয়, যে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে, সমাজে থেকেও দূর দ্বীপে কিংবা গহিন অরণ্যে বসবাস করে, এক দিন নয়, দীর্ঘদিন, সব সময়, সে লোকটি মানুষের মতো হলেও ঠিক মানুষ নয়। কেননা মানুষ প্রকৃত অর্থেই হচ্ছে একটি সামাজিক প্রাণী; তার বুদ্ধি, বিবেক, হৃদয়ানুভূতি, জ্ঞান, রুচি যা কিছুকে মানবিক গুণ বলে আমরা জানি, সব কিছু সামাজিকভাবেই বিকশিত হয়।

আসলে বাঙালি হওয়া মানেই মানুষ হওয়া। পরিপূর্ণ অর্থে মানুষ হওয়া। আর সেটি হওয়া ক্রমেই যে কঠিন হয়ে পড়ছে, তা একটি বাস্তবিক সত্য বৈকি। এই যে পহেলা বৈশাখ আসে, আবির্ভাব ঘটে বাঙালির নববর্ষের, তখন অন্তত এক দিনের জন্য বাঙালি হয়ে উঠলাম বলে আমরা মনে করি। সবাই নয়, এমনকি নববর্ষের অনুষ্ঠানে যারা যোগ দেয়, তাদের ভেতরেও সবাই নয়।

বৈশাখ মানুষে-মানুষে যে বৈষম্য, সেটিকেই উন্মোচিত করে দেয়। এমনকি অল্প সংখ্যায় যারা উৎসবে অনুষ্ঠানে যোগ দেয়, তারাও কাছাকাছি হয় বটে, কিন্তু ঐক্যবদ্ধ হয় না, সামাজিক হয়ে ওঠে না। সমাজে সামাজিকতা কি নেই? আছে, অবশ্যই আছে। কিন্তু সেটি এখন পারিবারিক হয়ে পড়েছে। এমনকি পরিবারের সবাই যে একত্র হবে, তা-ও হয় না। পরিবার আয়তনে বড় হয়েছে, এটি যেমন সত্য, পরিবারের ভেতরও বৈষম্য দেখা দিয়েছে, এটিও মিথ্যা নয়। কোথাও কোথাও বৃদ্ধি পেয়েছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, ভাগ-বাটোয়ারার লড়াই, উত্তরাধিকার নিয়ে সংঘর্ষ। ফলে সামাজিকতা অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। পারিবারিক এবং বন্ধুবান্ধবের মিলনের বাইরে বড় জায়গায় গিয়ে যে মিলব এমনটি দেখা যায় না। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের অভাব, খেলাধুলার জন্য মাঠ নেই, এমনকি জনসভাও এখন আর আগের মতো হয় না। আমরা সংকীর্ণ হচ্ছি, ক্ষুদ্র হচ্ছি। ফলে মনুষ্যত্ব খর্ব হয়ে পড়ছে। আর মনুষ্যত্ব যদি না থাকে, তাহলে তো আমরা মানুষই থাকব না, বাঙালি হব কী করে? পারছি না, হতে পারছি না।

মাতৃভাষার চর্চাটা দরকার। খুবই দরকার, অত্যাবশ্যক বলা যায়। সবাই মিলে বাংলা ভাষার চর্চা করব, তাতে আমাদের আত্মসম্মান বাড়বে, আমরা পরস্পরের কাছাকাছি চলে আসব, একে অপরকে বুঝব, আমাদের শিক্ষাদীক্ষা একই রকম হবে। বৃদ্ধি পাবে সামাজিকতা তথা মনুষ্যত্ব।

আমাদের জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হচ্ছে ভাষা, বাংলা ভাষা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষার যে স্থান আগে ছিলআগেও অবশ্য দুর্বল ছিল, কিন্তু এখন সে স্থানটি আরো দুর্বল হয়েছে। এখন শিক্ষাব্যবস্থা তিনটি ধারায় বিভক্ত হয়ে গেছে। এবং এই তিনটি ধারা জাতিকে বিভক্ত করছে। এই বিভাজনটি আসলে শ্রেণি বিভাজন; এবং শ্রেণি বিভাজনই জাতি গঠনের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। ফলে জাতি গঠন এবং বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা পরস্পরবিরোধী অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। এই দ্বন্দ্বটি নিরসন করা যাচ্ছে না। অনেক ধরনের সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু তিনটি মাধ্যমকে অভিন্ন করে কিছু করা যাচ্ছে না। এটি একটি শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টেই ছিল, তা হলো কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন। কিন্তু ওই কমিশনের রিপোর্টটি যে বাতিল করা হয়েছে, তা যে শুধু রাজনৈতিকভাবে করা হয়েছে তা নয়, সেই বাতিলটি সামাজিকভাবেও করা হয়েছে। এই অর্থে সামাজিকভাবে বলা হচ্ছে যে সমাজ ওই বিভাজনটি মেনে নিয়েছে। সমাজই ওই বিভাজনকে নানাভাবে আরো গভীর ও শক্ত করছে।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা এটি দূর করতে পারব কিভাবে। আমাদের তাহলে ওই জায়গায় ফিরে যেতে হবে। আমাদের জাতীয়তার ভিত্তি যে ভাষা, ওই মাতৃভাষার মাধ্যমে একটি অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। এবং আমি মনে করি, এটি আমাদের জন্য খুব বড় একটি চ্যালেঞ্জ। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের চেয়ে এই মাতৃভাষার মাধ্যমে অভিন্ন শিক্ষাব্যবস্থার চ্যালেঞ্জটি কম নয়। এটিকে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাই সবচেয়ে স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য। ব্রিটিশ আমলে দ্বিভাষিকতা অনিবার্য ছিল। কিন্তু এখন এই স্বাধীন বাংলাদেশে এ রকম দ্বিভাষিকতা থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। সবাই মাতৃভাষায় পড়ালেখা করবে। ইংরেজি শিখবে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে।

তাই শিক্ষার মাধ্যমে জাতি গঠনের কাজ আমরা করতে পারছি না। কেননা মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা এখনো আমরা চালু করতে পারিনি, যদিও রাষ্ট্রভাষাকে আমরা বাংলা করেছি। কারণটি হলো সমাজ এটিকে গ্রহণ করেনি; সমাজ শ্রেণি বিভাজনকে গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্র শ্রেণি বিভাজনকে উৎসাহিত করেছে। এ ছাড়া আমরা এমন একটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভেতরে আছি, যার মূল ভাষা হলো ইংরেজি। এ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে আমাদের ইংরেজি শিখতে হচ্ছে। এবং ইংরেজি না জানাটা এখন অজ্ঞতার পরিচায়ক বলা হচ্ছে। আর ইংরেজি যারা জানে, তারা সব জায়গায়ই সুবিধা পাচ্ছে। এই যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভেতরে আমাদের রাষ্ট্রের অবস্থান, আমরা সেই ব্যবস্থার বিপরীতে কিছুই করতে পারছি না। শিক্ষার মাধ্যমটিকে যদি আমরা মাতৃভাষায় নিয়ে আসতে না পারি, সেটি আমাদের জন্য বিশাল ব্যর্থতা।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা দুটি প্রবণতা দেখলাম। তখন আমরা দেখলাম, নানা জায়গায় কলেজ তৈরি হচ্ছে। কলেজের সংখ্যা খুব বাড়ল। শিক্ষানুরাগী লোকেরা কলেজ করতে চাইল, রাজনীতির লোকেরা কলেজ করতে চাইল। সমাজে যারা প্রতিষ্ঠা অর্জন করতে চায়, তারা কলেজ করতে চাইল। কলেজ করা খুব সোজা এবং এতে অল্প টাকা খরচ করতে হয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ল না, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ল না, কলেজের সংখ্যা বাড়ল। তারপর যে প্রবণতা হলো, সেটি হচ্ছে মাদরাসা তৈরি করা। মাদরাসা করা কলেজ করার চেয়েও সোজা। মাদরাসায় যারা যায়, তারা হচ্ছে গরিব মানুষ। এখানে সহজে অল্প পয়সায় শিক্ষালাভ করা সম্ভব, অনেক সময় বিনা মূল্যেই পাওয়া যায়। কলেজ করার ওই ঝোঁকটি মাদরাসার দিকে চলে গেল। কেননা এটি অল্প পয়সায় করা যায় এবং এর দ্বারা পুণ্য সঞ্চয় করা যায়। এ ছাড়া ইহকালেও খুব সুনাম হয়, লোকটি খুব ধার্মিক। ফলে শ্রেণি বিভাজনটি থেকেই যায়। দেখা যায় যে মাদরাসায় পড়ে গরিব মানুষের ছেলেমেয়েরা এবং তারা গরিবই থাকে। তারা আর ওই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। এটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে যারা জিহাদ ঘোষণা করে, তারা নিজেদের ছেলেমেয়েকে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে পড়াচ্ছে এবং গরিব মানুষের জন্য মাদরাসা শিক্ষার ব্যবস্থা করছে। এটি যে কত বড় অন্যায় কাজ এবং ধর্মের দিক থেকে দেখলে কত বড় একটি অধার্মিক কাজ, তা তারা বোঝে না। তারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে। এই ব্যবসাটি চলছে এখন তীব্র গতিতে।

 

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

দ্রুত ভোটে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে

শরিফুল ইসলাম খান
শেয়ার
দ্রুত ভোটে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে

বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশে নতুন করে ভয়ের সংস্কৃতি চালু হচ্ছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে মুক্তমত-মুক্তচিন্তা। মানুষের এমন ধারণাকে মিথ্যা প্রমাণ করুন। দয়া করে অনুধাবন করুন দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি।

কান পেতে শুনুন সাধারণ মানুষ কী বলে। যেসব কথা তারা বলতে চায় না কিংবা ভয়-শঙ্কায় বলতে পারে না, বাড়তি গুরুত্ব দিন তাদের সেসব ভাবনায়। কারণ গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে গণমানুষের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে এই সরকারের কাছে প্রত্যাশা বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু কখনো কি প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসাব মিলিয়েছেন? আপনাদের প্রতি সাধারণ মানুষের মনোভাব কেন বদলে যাচ্ছে, ভীষণ ইতিবাচক ধারণা থেকে কেন নেতিবাচক হচ্ছে দিন দিনঅনুসন্ধান করেছেন সেসব কারণ, নাকি গণবিপ্লবের চেতনাকে নিজেদের নিজস্ব সম্পত্তি বানানোর অপচেষ্টায় মগ্ন আছেন অবিরত? তাহলে চরম ভুল হবে, যে ভুল করেছিল পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিজেদের দলীয় সম্পদ বানিয়েছিল তারা। ১৭ বছর ধরে করা অপকর্মের প্রায় সবই হয়েছে রাষ্ট্রীয় মদদে। ফল যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে পরম পরাক্রমশালী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দলীয় নেতাকর্মীদের অরক্ষিত রেখে দেশ ছেড়েছেন।

কেবল অন্তর্বর্তী সরকারই নয়, ক্ষমতার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, চেয়ারে বসলে সামনের অংশটাই ভালো দেখা যায়। পেছনে কী ঘটছে, তা খুব একটা দেখা যায় না অথবা দেখতেও চান না ক্ষমতাসীনরা। আবার ক্ষমতাবানদের সঙ্গে যাঁরা থাকেন, তাঁদের ধরনটাও বেশ আজব-অদ্ভুত। কারণ চেয়ারে বসা ব্যক্তিরা যা শুনতে চান, তাঁরা কেবল তা-ই বলেন।

তার বাইরে একটি শব্দও না। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তব চিত্র জানতে পারেন না দায়িত্বশীলরা।  

এ জন্যই ভীষণ সতর্ক থাকতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। সংস্কার শেষে দ্রুত হাঁটতে হবে নির্বাচনের পথে। কারণ স্বৈরাচারের থাবায় ক্ষতবিক্ষত সারা দেশ। দুর্নীতি-লুটপাটে বিধ্বস্ত অর্থনীতি। শিক্ষাঙ্গনে ফেরেনি সুষ্ঠু পরিবেশ। আগের মতোই করুণ দশা স্বাস্থ্য খাতে। দিন দিন বাড়ছে চুরি-ছিনতাই। চরম অস্থির পোশাক খাত। স্বাভাবিক হয়নি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও। আরো অনেক কারণে শঙ্কা বাড়ছে জনমনে। নতুন নির্বাচনই হতে পারে এই পরিস্থিতি উত্তরণের নতুন নিয়ামক।

নির্বাচন হলেই কি সব সংকট সমাধান হয়ে যাবে? উঠতে পারে এমন প্রশ্ন। কিংবা রাজনৈতিক নেতৃত্বে আসলেই কী নির্ঝঞ্ঝাট হবে রাষ্ট্র পরিচালনা? সরাসরি উত্তর দেওয়া কঠিন। কিন্তু এটি তো সত্য, যার যা কাজ, তাকেই সেটি করতে দেওয়া উচিত। না হলে বাড়তি ঝুঁকি তৈরি হবে। 

পাল্টা যুক্তি হলো, দেশে তেমন কোনো সংঘাত-সহিংসতা নেই। রাজনৈতিক দলগুলোও ভোটের দাবিতে ততটা সরব নয়, যতটা দেখা গেছে বিগত বছরে। সব মিলিয়ে দেশ তো ভালোই চলছে। তাহলে কেন আসছে দ্রুত নির্বাচন প্রসঙ্গ? উত্তর হলো, যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা ভোটের কথা বলবেন, এটাই স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, গণতান্ত্রিক ধারা বাঁচিয়ে রাখতে হলে ভোটে ফিরতেই হবে। তৃতীয়ত, দ্রুত সংস্কার করে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়াই অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ।

ইদানীং প্রায়ই শোনা যায়, দেশে কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের যুক্তি, দিনদুপুরে ব্যাংকে ডাকাতি হচ্ছে। সন্ধ্যা নামতেই গণপরবিহনে লুটপাট। জনপ্রশাসনে বিরাজ করছে চরম অস্থিরতা। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে রাজনৈতিক দলগুলো। কায়দা-কৌশল করে দখল বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন অনেক রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা। খুব কম দিন আছে, হচ্ছে না বিক্ষোভ-অবরোধ। সব মিলিয়ে এক ধরনের অরাজকতা চলছে দেশের প্রায় সব খাতে। মামলা নিয়ে চলছে তুঘলকি কাণ্ড। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে মামলায় নাম দেওয়া হচ্ছে, প্রত্যাহার নিয়ে চলছে রমরমা বাণিজ্য।

ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা তো খুবই খারাপ। টালমাটাল শেয়ারবাজার। নানা শঙ্কায় বিনিয়োগকারীরা। দেশি বিনিয়োগকারীরা মোটেও স্বস্তিতে নেই। তাহলে কিভাবে আগ্রহী হবেন বিদেশিরা? ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বাংলাদেশের বৃহৎ শিল্প মালিকদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন, কেউ ভালো নেই। অজানা আতঙ্ক গ্রাস করে রেখেছে চারপাশ। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব আছে অর্থনীতিজুড়ে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়। দ্রুত এই অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি। আর এসব কারণেই দ্রুত সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলছি আমি। নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরুর পাশাপাশি সংস্কারেও গুরুত্ব দিন। সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে মৌলিক সংস্কারগুলো আগে শেষ করুন। অন্যগুলো রেখে দিন নির্বাচিত সরকারের জন্য।

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৈরি হওয়া দূরত্ব কমিয়ে আনুন। না হলে পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হবে। এমনও হতে পারে, দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে দেশে নতুন করে আন্দোলন হতে পারে। আবার ভোটের দাবিতে বিএনপি কিংবা সমমনা জোট যদি রাজপথে নামে, সেটি অযৌক্তিক হবে না। কারণ একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বছরের পর বছর দাবি জানিয়ে আসছে তারা। কেবল দাবি নয়, মামলা-হামলা থেকে শুরু করে গুম-খুনের মতো পরিণতি বরণ করতে হয়েছে বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের।

মনে রাখতে হবে, ১৭ বছর ধরে যাঁরা আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী, তাঁদের সবাই কিন্তু বিদেশে পালিয়ে যাননি। কোনো না কোনো কায়দায়, মিলমিশ করে দেশেই অবস্থান করছেন। পুলিশ-প্রশাসন থেকে শুরু করে এখনো সব সেক্টরে পতিত সরকারের দোসররা ঘাপটি মেরে বসে আছেন। বেশির ভাগই কিছুটা কোণঠাসা হয়ে আছে। তারাও অপেক্ষার প্রহর গুনছে। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে তারা আবারও স্বরূপে ফিরবে।

দেশের অভ্যন্তরীণ নানা প্রতিকূলতার মধ্যে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের প্রতিটি পদক্ষেপকে অ্যাড্রেস করতে হবে। বিপরীতে প্রণয়ন করতে হবে যথাযথ কর্মপরিকল্পনা। সব মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। সবার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে বিপ্লবের চেতনাকে সর্বজনীন করতে হবে, গড়ে তুলতে হবে সুন্দর-সম্ভাবনার বাংলাদেশ।

 

লেখক : হেড অব নিউজ, নিউজটোয়েন্টিফোর

 

মন্তব্য

বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষা কমিশন গঠনের আবশ্যকতা

ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী
শেয়ার
বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষা কমিশন গঠনের আবশ্যকতা

১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা একটি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করি। আমাদের এই মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দান করে এবং সম্ভ্রম হারান দুই লাখ মা-বোন। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা এক অত্যন্ত উজ্জ্বল ও ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। মানবেতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে।

১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষ পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে মহান স্বাধীনতাসংগ্রামে। তবে গভীর দুঃখের সঙ্গে আমরা লক্ষ করি, স্বাধীনতার মূল যে চেতনা, তা কোনোভাবেই প্রতিফলিত হয়নি স্বাধীনতা-পরবর্তী সরকারের কার্যক্রমের মধ্যে। যে আশা-আকাঙ্ক্ষা, সাধ ও স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব পণ করেছিল, তাদের সেই স্বপ্ন স্বাধীনতার পরপরই হারিয়ে যায়। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর স্বল্পকালের জন্য হলেও একটি আশার আলো দেখা গিয়েছিল, কিন্তু অচিরেই সে আশা ধূলিসাৎ হয়ে যায় এরশাদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে।
পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক ধারার একটি সূচনা ঘটলেও তা বেশিদিন অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়নি। এভাবে পর্যায়ক্রমে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যতটুকু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল, তা ২০০৯ সালের পর থেকে ক্রমেই হারিয়ে যেতে থাকে। গত ১৫ বছরে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার দেশের গণতান্ত্রিক ধারার সব ধরনের অবলম্বন, প্রথা এবং প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট করে ফেলে।

আওয়ামী ফ্যাসিবাদের এই নির্মম অপশাসনের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার এক মহান গণ-অভ্যুত্থান সূচিত হয়।

এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পতন ঘটে ১৫ বছরের আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকারের। জনগণের দীর্ঘদিনের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান। ছাত্র-জনতার এই ঐতিহাসিক গণসংগ্রামে ছাত্র-জনতার পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

অত্যন্ত আনন্দের কথা যে গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকার ক্ষমতাগ্রহণের পরপরই বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তারা বেশ কয়েকটি কমিশন গঠন করেছে জাতীয় ক্ষেত্রে সংস্কার সাধন করার জন্য।

রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো; যথাঅর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, অনেক কমিশন গঠিত হলেও শিক্ষা কমিশন রূপে কোনো কমিশন গঠন করা হয়নি। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে শিক্ষার সংস্কার একটি সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কর্তব্য। কেননা শিক্ষাই হচ্ছে একটি জাতির মেরুদণ্ড এবং বাংলাদেশে শিক্ষা সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা কোনোভাবেই অস্বীকার বা অগ্রাহ্য করা যায় না।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে শিক্ষা কমিশন গঠনের আবশ্যকতাচব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের একটি মূল চেতনা এবং প্রধান কর্তব্য হচ্ছে জাতিকে একটি আদর্শগত শিক্ষার পরিবেশে পুনরায় ফিরিয়ে আনা। এই প্রেক্ষাপটে আমি মনে করি, শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন হচ্ছে শুধু সময়ের দাবি নয়, এটি জাতীয় প্রয়োজন; যার কোনো বিকল্প হতে পারে না। আমরা সবাই জানি, দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গত দেড় দশকে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠার বদলে দলীয় রাজনীতির আড্ডাখানা হিসেবে গড়ে উঠেছে। মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগের পরিবর্তে দলীয় আনুগত্য বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। এটি করা হয়েছে শিক্ষার সব স্তরে। এমনকি বিস্ময়কর হলেও সত্য যে ছাত্র ভর্তির ক্ষেত্রেও আওয়ামী দলবাজির নিকৃষ্ট উদাহরণ রয়েছে। এর অনিবার্য ফল দাঁড়িয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে এক অসহনীয় সর্বনাশা অবনতি। এই অবনতি এমন স্তরে নেমে গেছে যে বাংলাদেশে আদৌ কোনো সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা আছে কি না, তা এক গভীর অনুসন্ধানের বিষয়। কেবল শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষার বিষয়বস্তু ও প্রকরণ নষ্ট করেই ফ্যাসিবাদ ক্ষান্ত হয়নি, প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও দলবাজির নিকৃষ্ট উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। স্কুল-কলেজের ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডিতে আওয়ামী দলবাজির চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে; এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রেও নগ্ন দলীয়করণের উদাহরণ দেখা যায়।

আধুনিক বিশ্বে উচ্চশিক্ষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে উচ্চশিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। উচ্চশিক্ষার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞানচর্চা বৃদ্ধি পেয়েছে। জ্ঞানের জগতে বহু নতুন জ্ঞানের সংযোজন হয়েছে; সমৃদ্ধ হয়েছে বিশ্ব জ্ঞানভাণ্ডার। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার উত্কর্ষ, উঁচু মান এবং অধুনা সৃষ্ট জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকে আমরা বিচ্ছিন্ন থাকতে পারি না। এ যুগ বিশ্বায়নের যুগ। সমগ্র বিশ্বকে একটি বৃহৎ পল্লীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। অতএব এই বৃহৎ পল্লীর এক অঞ্চলের উন্নয়নের প্রভাব অন্য অঞ্চলে পড়তে বাধ্য। তা ছাড়া জ্ঞানের জগতে কোনো সীমারেখা নেই। আমাদের দেশে সীমিত আকারে উচ্চশিক্ষার প্রচলন বহুকাল আগেই শুরু হয়েছে। ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত ভারতে ইংরেজি শিক্ষার প্রবর্তন হয়। তার পর থেকেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এভাবে পৃথিবীর এ অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে।

তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় হাতে গোনা কয়েকটি কলেজ ছিল, যেখানে উচ্চশিক্ষা প্রদান করা হতো। এই সীমিত সুযোগ গ্রহণ করেছিল এই অঞ্চলের এক উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণি। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান ছিল পশ্চাৎপদ ও অনগ্রসর। এর কারণ ছিল ঐতিহাসিকভাবে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি তাদের অনীহা এবং উচ্চশিক্ষার অত্যন্ত সীমিত সুযোগ। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বঙ্গভঙ্গের কারণে এ অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে নতুন আশা-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়, কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যে প্রভাবশালী হিন্দুদের বাধার মুখে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। এতে এ অঞ্চলের মুসলিম নেতাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং তাঁরা উপলব্ধি করেন যে মুসলমানদের পশ্চাৎপদতার কারণ হলো উচ্চশিক্ষার অভাব। তাই উচ্চশিক্ষার প্রসারকল্পে তাঁরা ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করেন। স্যার নওয়াব সলিমুল্লাহ, নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, এ কে ফজলুল হক প্রমুখ নেতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। এই পটভূমিতে ১৯২১ সালে ঢাকা শহরের রমনার মনোরম পরিবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সেই বছরের জুলাই মাস থেকে এর শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। ফলে এ দেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়।

এরই মধ্যে দেশে আরো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব পর্যন্ত এ দেশের শিক্ষার মান ছিল সন্তোষজনক। কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শিক্ষার এই মান আমরা ধরে রাখতে পারিনি; পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। স্বাধীনতার পর ইংরেজিসহ বাংলা ভাষাকেও উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এ কথা সত্য যে সদ্যঃস্বাধীন বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষা প্রদান করা ছিল তখনকার সময়ের দাবি। কিন্তু এর একটি নেতিবাচক প্রভাবও জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের ক্ষেত্রে লক্ষ করা গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে শিক্ষার মান ক্রমেই অবনতিশীল হয়। নানা কারণে পাঁচ দশক ধরে দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার মান নিম্নমুখী। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকসব স্তরে শিক্ষার মানের অবনতি হয়েছে, যার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই উচ্চশিক্ষার স্তরেও।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনাপূর্বক আমি শিক্ষা সংস্কারের উদ্দেশ্য এবং একটি আদর্শগত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য সামনে রেখে একটি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠনের প্রস্তাব করছি। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, এ দেশের একজন প্রবীণ শিক্ষক হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল যে একটি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করা এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি কাজ। আমি প্রস্তাবিত শিক্ষা কমিশনের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব উল্লেখ করছি।

কমিশন শিক্ষাক্ষেত্রের বিভিন্ন স্তরে সংঘটিত সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদির তদন্ত করবে।

প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত নিয়োগ, পদোন্নতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে অনিয়ম, দলীয়করণ এবং সীমাহীন দুর্নীতি, উৎকাচ গ্রহণ ইত্যাদি ঘটেছেতার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করবে।

শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তহীন আর্থিক অনিয়মের অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। কোন ক্ষেত্রে অর্থ আত্মসাৎ, পুকুরচুরি, প্রকল্পের নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ চুরি ইত্যাদির তদন্ত করতে হবে।

কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পাঠদানে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

আমি মনে করি, তরুণ শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাওয়ার অর্থ এই নয় যে তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান গ্রহণ করবে না।

কমিশন শিক্ষাক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি তদন্তপূর্বক জাতির সামনে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবে। এরই মধ্যে আর্থিক খাতের অনিয়ম ইত্যাদি নিয়ে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়েছে।

আমি গভীর দুঃখের সঙ্গে বলতে চাই, ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশের বর্ণিত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন নীতিমালা মারাত্মকভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। কেবল দলীয় স্বার্থে অধ্যাদেশকে ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি কোনো একজন উপাচার্য সম্পূর্ণ অবৈধভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে আসীন থেকেছেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমার প্রস্তাব হচ্ছে, তিয়াত্তরের অধ্যাদেশের কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন। এটিকে যুগোপযোগী করে তোলা আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার নৈতিক কর্তব্য। এই প্রক্রিয়ায় অবশ্যই শিক্ষক এবং শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

আধুনিক বিশ্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়ন এবং শিক্ষাক্ষেত্রে এর প্রয়োগ আমাদের জ্ঞানজগতে বিরাট পরিবর্তন এনেছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে সংগতি রক্ষা করার জন্য আমি মনে করি, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়ও কয়েকটি গুণগত পরিবর্তন ও সংযোজন প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে আমি কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব উপস্থাপন করছি।

১. উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধি করতে আমাদের ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই ইরেজি শিক্ষা চালু করতে হবে। বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে বলা হয়েছে যে তৃতীয় শ্রেণি থেকে শিক্ষার্থীরা বিদেশি ভাষা শিখতে (গ্রহণ করতে) পারে। তাই আমি মনে করি, প্রাথমিক শিক্ষার এই পর্যায় থেকে ইংরেজি শিক্ষা প্রদান শুরু করলে এবং মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ইংরেজি ভাষার পঠন-পাঠন ও চর্চা অব্যাহত রাখলে (বৃদ্ধি পেলে) ছাত্র-ছাত্রীরা ইংরেজি ভাষাজ্ঞানে সমৃদ্ধ হবে। অতএব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইংরেজি পাঠ্যপুস্তক ও সহায়ক গ্রন্থ থেকে জ্ঞান আহরণ সহজতর হবে। পাশাপাশি আমাদের ইংরেজি পাঠ্যবই ও সহায়ক গ্রন্থের অনুবাদ এবং বাংলা ভাষায় বই রচনার ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।

২. উচ্চশিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতিমুক্ত রাখতে হবে। এর অর্থ এই নয় যে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করতে হবে। ছাত্রদের রাজনীতি করার অধিকার আছে, কিন্তু শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাসী রাজনীতির প্রভাব থেকে মুক্ত রাখতে হবে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে তারা হীন রাজনৈতিক স্বার্থে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ছাত্র-ছাত্রীদের ব্যবহার করবে না। যখন-তখন রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোকে অচল করে দেওয়া হবে না।

৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারলে সেশনজট দূর হবে। এ ব্যাপারে শিক্ষকদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে তথা জাতীয় স্বার্থে অতিরিক্ত পরিশ্রম করে সেশনজট দূর করতে হবে।

৪. ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির ক্ষেত্রে মেধাই হবে একমাত্র মাপকাঠি। ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-নির্বিশেষে মেধাই হবে উচ্চশিক্ষা লাভের মূল শর্ত। কোটা সিস্টেম বা অন্য কোনো কারণে যোগ্যতা শিথিল করা যাবে না।

৫. শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও যোগ্যতাই হবে একমাত্র মাপকাঠি। শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে তাদের একাডেমিক অর্জন, গবেষণাকর্ম, নিরলস চর্চা ও একাগ্রতার মূল্যায়ন করতে হবে। এর সঙ্গে উচ্চশিক্ষার মান প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। শিক্ষকতার মান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষকদের অবশ্যই গবেষণাকর্মে যুক্ত থাকতে হবে। শিক্ষকের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অবশ্যই নিয়মিতভাবে গবেষণাকাজে লিপ্ত থাকতে হবে। কারণ গবেষণা ছাড়া নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়।

৬. শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো (Pay scale) প্রণয়ন করতে হবে।

৭. আধুনিক শিক্ষা উপকরণ ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে হবে। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রন্থাগার ও ল্যাবরেটরিগুলোকে যুগোপযোগী, আধুনিক ও সমৃদ্ধ করতে হবে।

৮. বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের পাঠ্যসূচি (শিক্ষাক্রম) হবে আধুনিক, আন্তর্জাতিক ও সমকালীন। একদিকে যেমন দেশের ও জাতীয় চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা দরকার; অন্যদিকে আধুনিক, আন্তর্জাতিক বিশ্বজনীন পাঠ্যসূচি বা শিক্ষাক্রমের সঙ্গে সংগতি রেখে সিলেবাস তৈরি করতে হবে। শিক্ষাক্রম এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেন শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞান মানুষ ও সমাজের কল্যাণে ব্যবহার করা যায়। মোটকথা, শিক্ষা হতে হবে কর্মমুখী ও গণমুখী।

 

লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য

এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ