<p>বাংলাদেশের বিদ্যমান আয়কর অধ্যাদেশটি নতুন মলাটে আইন হিসেবে প্রমিতকরণের কাজ শেষ পর্যায়ে। রাজস্ব আইন সংস্কারের এ আয়োজন-উদ্যোগ সহসা সচকিত নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলছে পরিকল্পনা আর প্রাজ্ঞ পরামর্শকদের প্রয়াস পারঙ্গমতা। রাজস্ব আইন সংস্কারের সব উদ্যোগের আগ্রহ অভিপ্রায়ে কোনো কমতি নেই, কিন্তু বিদ্যমান আইনে ‘শতেক শতাব্দী ধরে নামা শিরে অসম্মানভারের’ লাঘব প্রকৃত প্রস্তাবে ঘটছে কি না, সংস্কারকৃত আইন কতটা বাস্তবায়নসম্মত—আয়কর আহরণকারী এবং দাতার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা এবং তার রূপকল্প ও তাৎপর্য তুলে ধরতেই এবারের আয়কর দিবসের প্রাক্কালে এই ভাবনা। প্রসঙ্গত যে এ বছর ২০২২ সালে ১৯২২ সালের ভারতীয় আয়কর আইনের শতবর্ষ, যে আইনটি বেনামে এখনো বাংলাদেশে অনুসৃত হচ্ছে। ১০০ বছরের আয়কর আইনের কাছে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খতিয়ান কষতে এবং তার ভিত্তিতে ভবিষ্যতের বাংলাদেশে আয়কর আইন সংস্কারের রূপরেখা সুপারিশ করতে ব্যবসায়ীদের থিংক ট্যাংক ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশ গত ২৬ নভেম্বর একটি বিশেষ সেমিনারের আয়োজন করে।</p> <p>সেমিনারে সর্বাগ্রে উঠে আসে শতবর্ষী ১৯২২ সালের আয়কর আইন, যার প্রথম ৫০ বছর ছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ-ভারত এবং পাকিস্তান আমল। পরের ৫০ বছর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে, সেখানে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষিতই শুধু থাকেনি, দিন দিন তা আরো জটিল হয়েছে। আমরা জানি যে চিন্তা থেকে যেমন কাজের উৎপত্তি, আইনের প্রয়োগ, তেমনি আইনের দৃষ্টিভঙ্গিভেদে বিভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে। যাঁরা আইন তৈরি করেন, তাঁদের সঙ্গে যাঁদের ওপর এটির প্রয়োগ হবে তাঁদের মধ্যকার সম্পর্কেরও একটা বিশেষ ভূমিকা আছে আইনের দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণে। এখানে তৃতীয় আরেক শরিকের কথাও এসে যায়, যাঁদের মাধ্যমে আইনটির প্রয়োগ হবে, তাঁদের মনোভাব, মনোভঙ্গি সক্ষমতা-অক্ষমতার ব্যাপারটিও বিশেষভাবে বিবেচ্য থেকে যায় আইনের প্রয়োগ তথা বাস্তবায়নযোগ্যতার ক্ষেত্রে। কেননা আইন প্রয়োগের দায়িত্ব আইনপ্রণেতার নয়, নির্বাহী বিভাগের। আইন পরিষদ যদি মনে করে এ আইন অন্যের জন্য, পরিষদ সদস্যদের ওপর সব সময় বা সমভাবে বর্তাবে না এবং নির্বাহী বিভাগও যদি ভাবে এ আইন নিজের ওপর ততটা নয় যতটা অন্যের ওপর প্রয়োগের জন্যই, তাহলে যাঁদের ওপর আইনের প্রয়োগ তাঁরা হয়ে পড়েন আইনপ্রণেতা ও প্রয়োগকারীর প্রতিপক্ষ। এই প্রতিপক্ষতার পরিবেশেই আইনের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে যায় নিবর্তনমূলক, প্রতিরোধাত্মক। এই প্রেক্ষাপটে আইন উপেক্ষার, অমান্যের ও অগ্রাহ্যের পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে।</p> <p>আইন মানুষের জন্য, মানুষ আইনের জন্য নয়, মানুষের কল্যাণেই আইনের প্রয়োজন। মানুষ আগে, আইন পরে। আইন মানুষের মুক্তির জন্য, তাকে বন্দি বা বিব্রত করার জন্য নয়। মানুষের মৌলিক অধিকার আইনের আওতায় স্বীকৃত, নিশ্চিত, নির্ধারিত, নিবন্ধিত হয়ে থাকে। মানুষ তার চিন্তার, বিশ্বাসের, শরীরের, দেহের, চলাচলের, সম্মানের ও মর্যাদার প্রতিষ্ঠা, বিকাশ ও নিরাপত্তা দাবি করতে পারে আইনের কাছে। আইন দৃষ্টিভঙ্গিতে সর্বজনীন এবং প্রয়োগে নিরপেক্ষ হওয়ার আবশ্যকতা অনস্বীকার্য। যে আইন যত সর্বজনগ্রাহ্য, সর্বজনমান্য, সর্বজনবোধ্য, সর্বজন অনুসৃতব্য—সেই আইন তত কল্যাণকর, সেই আইন তত কার্যকর।</p> <p><img alt="" src="http://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/ckfinder/innerfiles/images/Print Version Online/print /2022/11.November/30-11-2022/121/0.jpg" style="float:left; height:300px; margin:12px; width:332px" />বাংলাদেশে বিদ্যমান আয়কর আইনের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি হলে দেখা যাবে এ আইন জন্মগতভাবে ব্রিটিশ দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে ঔপনিবেশিক এবং প্রয়োগিক দিক থেকে জটিল, নিবর্তনমূলক ও প্রতিরোধাত্মক। এ দেশে ভূমি কর বা রাজস্ব আদায়ের প্রথা প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকে চলে এলেও এ দেশে আধুনিক আয়কর প্রবর্তিত হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে। আমরা জানি এ দেশ ১৭৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির কর্তৃত্বাধীনে চলে যায়। পরবর্তী ১০০ বছরে এদেশীয় অর্থনীতির স্বনির্ভর সত্তাকে পরনির্ভরকরণ কার্যক্রম চলতে থাকে। ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এ দেশের শাসনভার কম্পানির থেকে ব্রিটিশ সরকারের হাতে ন্যস্ত হয়। ১৮৬০ সালের ৭ এপ্রিল ভারতে প্রথম ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী জেমস উইলসন (১৮০৫-১৮৬০) তাঁর বাজেট বক্তৃতায় এ দেশে প্রথম আধুনিক আয়কর প্রবর্তনের প্রস্তাব করেন। আয়কর আইন প্রবর্তনের দুই মাসের মাথায় ডিসেন্ট্রিতে কলকাতায়ই মারা যান উইলসন।</p> <p>প্রথম থেকেই আদায়ের ক্ষেত্রে করদাতাদের প্রতি বশংবদ অদায়িত্বশীল আচরণ, পারস্পরিক অবিশ্বাস, ফাঁকি প্রতিরোধাত্মক ঔপনিবেশিক মনোভাব প্রাধান্য পায়। করযোগ্য আয় নির্ধারণ থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে পরিপালনীয় বিধি-বিধানের ভাষা জটিল ও দ্ব্যর্থবোধক হয়ে ওঠে। ‘তোমার আয় হোক আর না হোক, অর্থাৎ বাঁচো মরো রাজস্ব আমার চাই।’ এ ধরনের আইনগত দৃষ্টিভঙ্গির ফলে কর আদায়কারী বিভাগের সঙ্গে করদাতাদের সম্পর্ক জবরদস্তিমূলক, পরস্পরকে এড়িয়ে চলার কৌশলাভিমুখী হয়ে পড়ে। পরস্পর অবিশ্বাসের ও প্রতিদ্বন্দ্বী পরিবেশে কর নির্ধারণ ও পরিশোধের ক্ষেত্রে পরস্পরকে এড়িয়ে চলার এবং সেই লক্ষ্যে অনৈতিক আঁতাতের মাধ্যম রাজস্ব ফাঁকির সংস্কৃতিরও সূত্রপাত ঘটে। দুর্নীতিগ্রস্ততার পরিবেশ সৃষ্টিতে আইনের মধ্যেই যেন রয়ে যায় পরোক্ষ প্রেরণা বা সুযোগ। এমন অনেক আইন আছে, যা বেআইনি আচরণকে উসকে দেয়।</p> <p>১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর আয়কর আইনে যেখানে ‘ভারত’ লেখা সেখানে ‘পাকিস্তান’ এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ‘বাংলাদেশ’ প্রতিস্থাপন করে প্রবর্তিত হয়। শাসকের ও শাসিতের মধ্যকার হরাইজন্টাল ও ভার্টিক্যাল সম্পর্কের শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন সত্ত্বেও আয়কর আহরণসংক্রান্ত ধ্যান-ধারণা একই থেকে যায়। ভারতীয় প্রজাতন্ত্র ১৯৬১ সালে সে দেশের রাজস্ব আইনকে নিজস্ব সমাজ ও সময়ের দাবির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পুনর্গঠিত আইন প্রবর্তন করে। আর আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪ (১৯৮৪ সালের ৩৬ নম্বর অধ্যাদেশ) জারির মাধ্যমে বাংলাদেশে নিজস্ব আয়কর আইন প্রবর্তিত হয় ১৯৮৪ সালে। তখন দেশে আইন পরিষদ বিদ্যমান না থাকায় রাষ্ট্র ও নাগরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ও গণগুরুত্বপূর্ণ আয়কর আইনটি অধ্যাদেশ হিসেবে জারি হওয়ায় এটির প্রণয়ন ও প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে। বারবার দাবি উঠেছে আয়কর অধ্যাদেশের পরিবর্তে আয়কর আইন প্রণয়নের। ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশের ভাষা ও গতি-প্রকৃতি নিবিড় পর্যবেক্ষণে গেলে এটা প্রতীয়মান হয় যে বছর বছর অর্থ আইনে যেসব ছিটেফোঁটা শব্দগত সংযোজন-বিয়োজন এবং মূল ধারণার আওতায় প্রয়োগযোগ্যতার মাপকাঠির পরিবর্তন বা পরিমার্জন অনুমোদিত হয়েছে, তা ধারণ করা ছাড়া সবই মূল ঔপনিবেশিক আইনের ভাব-ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত। তেমন কোনো পরিবর্তন বা সংস্কার দৃষ্টিগোচর হয় না। বরং প্রতিবছর কর নির্ধারণ, শুনানি, বিচার-আচারে কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বা এখতিয়ার, কর অবকাশ-নিষ্কৃতি-ছাড় কিংবা বিশেষ সুবিধাবলির ধারা-উপধারা সংযোজন-বিয়োজন করতে করতে করারোপ, আদায় ও করদাতার অধিকার, কর অবকাশ নিষ্কৃৃতি ও সুবিধাসংক্রান্ত মৌল দর্শন অনেক ক্ষেত্রেই হয়েছে বিস্মৃত। যুগধর্মের সঙ্গে সংগতি রেখে কর নির্ধারণ ও আদায় সংক্রান্ত বিধানাবলি সহজীকরণ-সরলীকরণ তথা করদাতা বান্ধবকরণ করা না হলে আইন আরো জটিল হতে পারে।</p> <p>আর এ নিরিখেই আয়কর আইনের ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি সংস্কারের আওতায় আনা আবশ্যক। স্বেচ্ছায় করদানে সক্ষম করদাতাকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ততায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় এমন নিরুৎসাহবোধের কারণগুলো শনাক্ত করে উপযুক্ত বা প্রযোজ্য পরিবর্তন আনা এবং সংস্কার করা সেই আইন প্রয়োগেও রাজস্ব আহরণ বিভাগের মানসিকতার সমন্বয় প্রত্যাশিত থেকে যাবে। সহজ ও সর্বজন বোধগম্যতার জন্য এ আইন হচ্ছে বাংলা ভাষায়। বিদ্যমান আয়কর আইন স্রেফ পুনর্লিখন এবং কী কী নতুন খাতে কর আরোপ করা হতে পারে (যা প্রতিবছর অর্থ আইনের মাধ্যমে পরিবর্তনযোগ্য) এমন বিষয়কে মতামতের বিষয়ভুক্ত না করে আইনের মৌল দৃষ্টিভঙ্গি তথা দার্শনিকতা, দুর্বোধ্য ও দ্ব্যর্থবোধকতা, করদাতার দায়িত্ব-কর্তব্য তথা তাঁর মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধি-বিধান, আইন প্রয়োগের প্রাকরণিক ও পদ্ধতি প্রক্রিয়াসংক্রান্ত ধারা-উপধারাগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আবহাওয়া ও সংস্কৃতিতে গ্রহণযোগ্যতার নিরিখে নির্মাণে মনোযোগী হওয়ার সময় শেষ হয়ে যায়নি। বাইরে থেকে, আবার কখনোসখনো ভেতর থেকে (বাস্তবায়নকারীর তরফ থেকে) কোনো আইনের কাঠামো ও ভাষ্য চাপিয়ে দেওয়ার প্রয়াস নিকট-অতীতেও ছিল। তড়িঘড়ি করে কিংবা শুধু বাস্তবায়নকারী দপ্তরের প্রযত্নে ও মুসাবিদায় আইন প্রণীত হলে সমস্যা থেকেই যাবে।</p> <p>এ দেশের আয়কর আইন হবে এ দেশেরই আবহমান অর্থনীতির আবহে লালিত ধ্যান-ধারণার প্রতিফলক, হবে সহজবোধ্য, জটিলতা পরিহারী এবং এর প্রয়োগ হবে স্বাচ্ছন্দ্যে সর্বজনীন ব্যবহার উপযোগী। তবেই বাড়বে এর গ্রহণ এবং বাস্তবায়নযোগ্যতা। করদাতা যেন নিজেই নিজের কর ফরম পূরণ, কর নির্ধারণ এবং সরাসরি তা দাখিলে সক্ষম হন। অর্থনীতির বিভিন্ন পর্যায়ে অবস্থানরত করদাতারা যেন অভিন্ন আচরণে আইনগতভাবে কর প্রদানে দায়িত্বশীল হতে স্বতঃস্ফূর্ততা বোধ করেন। কর আদায় নয়, কর আহরণে করদাতা ও কর আহরণকারীর মধ্যকার দূরত্ব যত কমে আসবে, যত অধিকমাত্রায় করদাতা কর নেটের আওতায় আসবেন, তত কর রাজস্ব আহরণে সুষম, সহনশীল ও দায়িত্ববোধের বিকাশ ঘটবে। এরূপ পরিস্থিতিতে করদাতাকে তাড়া করে ফেরার মতো স্পর্শকাতরতার অবসান ঘটবে।</p> <p>   লেখক : সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান</p>