<p>বাংলাদেশ এখন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মোটামুটি একটি পর্যায়ে এসেছে। বিশেষ করে ১৯৯০ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে নানা উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। মূলত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষ দুটি সূচক আমাদের অর্জিত হয়েছে। একটা হলো, আমরা উন্নয়নশীল দেশে পৌঁছেছি। আরেকটা হলো, আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছেছি। আমরা যে অর্থনৈতিক অর্জনটা করেছি, তার কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আমরা কিভাবে ভবিষ্যতে এগোতে পারি, সেটা এখন বিবেচ্য বিষয়।</p> <p>আমাদের তিনটা বিষয়ের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। প্রথমত, আমরা যে অর্জনটা করছি সেটার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশ ছোট্ট একটা ভূখণ্ড। কিন্তু বিশাল জনসংখ্যার দেশ। অনেকে বলেছিল, এটা একটা উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হবে না। উন্নতি করতে পারবে না, এটা তলাবিহীন ঝুড়ি। আবার কেউ বলেছে, উন্নয়নের একটা পরীক্ষা। সেটা ছিল সে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে। বিশেষ করে বাংলাদেশের লোকের যে সামর্থ্য ও যোগ্যতা-আকাঙ্ক্ষা, সেগুলো তারা বিচার করতে পারেনি। এখন এই পর্যায়ে আসার পরে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমরা এসেছি। এখন আমাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে।</p> <p><img alt="" src="http://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/ckfinder/innerfiles/images/Print Version Online/print /2022/12.December/11-12-2022/kalerkantho-ed-1a.jpg" style="float:left; height:262px; margin:12px; width:331px" />প্রথম থেকেই আমরা দেখেছি যে দেশের সার্বিক উন্নয়ন; বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে কতগুলো উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে সবুজ বিপ্লব, কৃষি বিপ্লব—এগুলোর সঙ্গে ধীরে ধীরে আমরা মার্কেট ইকোনমি অর্থাৎ বাজার অর্থনীতির দিকে এগোলাম। তখন শিল্প বিকশিত হচ্ছিল। ছোট ছোট শিল্প দিয়ে শুরু। আস্তে আস্তে আমরা বড় শিল্প, বিশেষ করে গার্মেন্টশিল্প বিকশিত হলো।</p> <p>বিভিন্ন রাস্তাঘাট নির্মিত হওয়া এবং দ্রুত অবকাঠামো তৈরি করে করে আমরা কতগুলো ধাপ পার করে এসেছি। সেখানে অবশ্য কতগুলো দিক ছিল; আমরা প্রবৃদ্ধির দিকে বেশি নজর দিচ্ছিলাম। কিন্তু আমরা ডিস্ট্রিবিউশন বা ইকুয়ালিটি কিংবা সমতা বৃদ্ধির দিকে নজর দিইনি। এখনো যে দিচ্ছি তা না। প্রেক্ষিত আছে কিন্তু আমাদের সেটা প্রভাবিত করেছে। অনেকে এটাকে বলে মডেল। আবার অনেকে বলে বিস্ময়কর বা আশ্চর্য ঘটনা। এগুলো বলার কারণ হলো, মডেল বলে এ জন্য যে মোটামুটি ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিস্ময়কর বলে এ কারণে যে এখানে সম্পদের অপ্রতুলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাজনৈতিক নানা রকম অস্থিরতা, প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও কিন্তু আমরা এগোচ্ছি। এ জন্য অনেকে বলে যে উন্নয়নের চমক। আমরা যে পুরোপুরিভাবে খুব একটা টেকসই উন্নয়নে আছি সেটাকে নির্দেশ করে না।</p> <p>কারণ এখানে আমাদের ঝুঁকিটা কিন্তু রয়ে গেছে। প্রথম ঝুঁকি হলো, আমাদের যে অর্থনৈতিক উন্নয়নটা হচ্ছে, সেটা যেকোনো সময় বাইরের দেশের কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। যেটা এখন হয়েছে। যেমন ধরুন মূল্যস্ফীতি ঘটেছে। রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। রপ্তানিতে সমস্যা আছে। রেমিট্যান্স খুব একটা বাড়ছে না। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে, ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। এগুলো আমাদের বড় ধরনের নাড়া দিয়েছে। এসবের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরীণ কারণেও ঝুঁকি দেখা দিয়েছে, যেমন—আমাদের ব্যাংকিং খাতে সমস্যা আছে। পুঁজিবাজারে সমস্যা আছে। দুর্নীতি, মুদ্রাপাচারের সঙ্গে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলার অভাব আছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতার অভাব আছে। সব মিলিয়ে আমরা একটা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছি। এই ঝুঁকিগুলো কিন্তু আমরা কাটিয়ে উঠতে না পারলে উত্তরণের পথে সেটা বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।</p> <p>আমাদের অর্জন কিন্তু কম নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রূপান্তর ঘটেছে। একসময় কৃষি খাতের যে বিরাট একটা অবদান ছিল, সেটা এখন ২০-২২ শতাংশের বেশি নেই। কৃষি কিন্তু আমাদের অর্থনীতির মেরুদণ্ডের মতো। বিশাল একটা জনশক্তি এটার ওপর নির্ভর করে। গ্রামীণ অর্থনীতির একটা রূপান্তর হয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতি এখন শুধু শস্য উৎপাদন কৃষিনির্ভর নয়। পণ্য প্রক্রিয়াজাত করা হয়েছে। হাঁস, মুরগি, মাছের খামার হয়েছে। আমাদের মাছ রপ্তানিও করা হচ্ছে।</p> <p>গ্রাম ও শহরের যে ভৌগোলিক পার্থক্যটা ছিল এখন কিন্তু আগের মতো সুস্পষ্ট নয়। তবে কিছুটা পার্থক্য আছে। যেমন—ঢাকা শহর বা বড় শহরে যা আছে, তা গ্রামে নেই। গ্রামে ভালো হাসপাতাল নেই। যথাযথ শিক্ষাব্যবস্থা নেই। ভালো বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। সেখানে ঘাটতি আছে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়ন করার ক্ষেত্রে যে সম্ভাবনা, সেটা কিন্তু আছে। গ্রামকে আর শহরকে আলাদা করে না দেখা প্রয়োজন। গ্রাম যে শহরের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং দুটির যে পারস্পরিক সম্পর্ক, এটা কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে।</p> <p>বাংলাদেশে অন্তর্বর্তীমূলক উন্নয়ন নিয়ে কথা হচ্ছে। আমাদের ৫০ শতাংশের বেশি লোক কিন্তু ব্যাংকিংব্যবস্থার ভেতরে নেই। আমি বলব, আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিংব্যবস্থার ভেতরে নেই। অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থার ভেতরে আছে। ক্ষুদ্রঋণ, সেভিংস সোসাইটি, তারপর সঞ্চয়, সমবায়ের ভেতরে এরা আছে। কিন্তু ব্যাংকে নেই। অন্তর্বর্তীমূলক অর্থনীতির সুযোগ কিন্তু সাধারণ মানুষের এখনো নেই। বিশেষ করে ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতারা কিন্তু এখনো ঋণ নেওয়ার সুবিধা পায় না।</p> <p>দ্বিতীয়ত, মফস্বল বা অনেক লোক জানেই না কী সুবিধা পাওয়া যায়। এখানে একটা ইনফরমেশন গ্যাপ আছে। তথ্যের অভাব আছে। মানুষ যদি না জানে সরকার কী সার্ভিস দিচ্ছে, তাহলে কিন্তু মানুষ সে সার্ভিসটা নিতে পারবে না। এই যে তথ্যের অবাধ প্রবাহ, তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া; সেটা যথেষ্ট নয়। অতএব অন্তর্বর্তীমূলক যে উন্নয়ন, আর্থিক ঋণ পাওয়ার সুযোগ, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য খাতে সুযোগ, সেটা কিন্তু অনেক কম হচ্ছে। এটা একটা চ্যালেঞ্জ।</p> <p>সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, আমাদের আয় ও সম্পদের বৈষম্য দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু সবচেয়ে বড় জিনিস হলো যে ব্যবধানটা বেড়ে যাচ্ছে। অনেকে বলবে, গরিব ও গ্রামের লোকদের তো আগে মোবাইল ফোন ছিল না, তারা আধুনিক ছিল না। গ্রামে এখন ব্যায়ামাগার আছে। এখন নাকি গ্রামে বিউটি পার্লারও আছে। এগুলো কোনো ব্যাপার না। এগুলো ছাড়া তাদের সুবিধা আছে, যাদের অর্থ আছে, বিশেষ করে গ্রামে যাদের সন্তানরা বিদেশে আছে, তারা টাকা পাঠায়। তারা এই ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিতে পারে। গ্রামে গিয়ে দেখুন, অন্যরা আবার সেই সুবিধাগুলো নিতে পারে না। অতএব এই বৈষম্যটা যদি আমরা দূর না করি, তাহলে এটা আমাদের জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ।</p> <p>বাংলাদেশ স্বাধীনতার মূল উদ্দেশ্যই ছিল রাজনৈতিক স্বাধিকার এবং অর্থনৈতিক মুক্তি। এবং সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক উন্নয়নের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা; সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, কোয়ালিটি অব লাইফ, এডুকেশন, হেলথ, তথ্য পাওয়ার অধিকার ও নীতিনির্ধারণ করার ক্ষেত্রে জনগণের অধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু এগুলো আমরা এখনো অর্জন করতে পারিনি। এই জিনিসগুলো নিশ্চিত করতে হবে।</p> <p>আমি মনে করি, কতগুলো বিশেষ জিনিস আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। প্রথম হলো, আমাদের যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে, অতিদ্রুত যদি সেগুলোর মোকাবেলা আমরা না করি, তাহলে দেখব হঠাৎ করে আমরা খাদের কিনারে পৌঁছে গেছি। একবার খাদের মধ্যে পড়ে গেলে ওঠার আর কিছু থাকবে না। অতএব আগেই কিন্তু প্রস্তুতিগুলো নিতে হবে। দ্রুত দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের সক্ষমতার অভাব আছে। দ্বিতীয়ত, স্বচ্ছতা-জবাবদিহির অভাব আছে। তৃতীয়ত আছে সুশাসনের অভাব। এই তিনটি বিষয়—সক্ষমতা, স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে।</p> <p>সমস্যা নিয়ে কথা বলা হয় যাক। যেমন—আমাদের গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি। আমাদের প্রডাক্টিভিটি ও দক্ষতা কিন্তু অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক কম। কিন্তু গার্মেন্ট সেক্টরে আমরা উত্তরোত্তর ভালো করছি। আর ডিজাইন, ওরা তো এটা দিয়েই দেয়। আর গুটিকয়েক লোক ব্যাংকের ঋণ পায়। সহায়তা পায়। অন্যগুলো কিছুটা পাচ্ছে—চামড়া, সিরামিকস, তারপরে পাট। এগুলো ঋণ পাচ্ছে, কিন্তু সেটা খুব বেশি না।</p> <p>দ্বিতীয়ত, এটা আমি আগেই বলেছি, এটা ব্ল্যাক হোল। খাদের কিনারে চলে আসা এবং সমস্যা সমাধান না হলে খাদে অর্থাৎ অন্ধ গহ্বরে পতিত হওয়া।</p> <p>তৃতীয়ত হলো, বৈষম্য ও সামাজিক নিরাপত্তা, সোশ্যাল সিকিউরিটি; আমরা বৃদ্ধ ও বিধবাদের ভাতা দিচ্ছি, এটা আসলে একটা বিশেষ শ্রেণির জন্য। এবং ভাতাটা যে খুব বেশি, তা নয়। অতএব, সর্বজনীনভাবে যারা দরিদ্র লোক, যাদের আয়ের সংস্থান কম, যারা কর্মহীন; তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সামাজিক নিরাপত্তার বলয় সম্প্রসারণ ও কার্যকর করতে হবে।</p> <p>সার্বিকভাবে সামষ্টিক নীতি, বাজেট-রাজস্বনীতি, তারপর মুদ্রানীতি, আমাদের এক্সপোর্টের নীতি আছে, বাণিজ্যনীতি—আমরা যে নীতিগুলো নিয়ে থাকি সেগুলো নেওয়া এক জিনিস আর কৌশলগুলো নির্ধারণ করা আরেক জিনিস। সবচেয়ে বড় জিনিস হলো কৌশলগুলো বাস্তবায়ন করা। আমাদের বাজেটে অনেক কার্যক্রমের আশ্বাসের কথা বলা হয়, পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়িত হয় না। এডিবির অনেক পরিকল্পনা নেওয়া হয়, বহু প্রজেক্ট আছে সেগুলো সময়মতো শেষ হয় না।</p> <p>মাইক্রোলেভেলে এবং স্থানীয় পর্যায়ে মোটামুটি লোকজন চেষ্টা করছে। নিজেদের জীবনের সংগ্রামে কৃষক, শ্রমিক, তাঁরা নিজস্ব তাগিদে কিন্তু অনেক কিছু করে যাচ্ছেন। কোনো কিছুই থেমে থাকছে না। সরকার যদি সহায়তা করে, ভালো। সরকার যদি অ্যাফিশিয়েন্ট হয়, সরকার যদি ঠিকভাবে শাসন করে; মানুষের যে সৃজনশীলতা, তাদের যে উদ্যম সেটা কিন্তু আরো বিকশিত হয়। অর্থাৎ যতটুকু প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হওয়ার আমাদের সম্ভাবনা আছে। সেই সম্ভাবনার জন্য আমাদের কিছু বিষয় স্বীকার করতে হবে। বিশ্লেষণ করে বের করতে হবে কী কী ভুল ছিল। উত্তরণের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। সমস্যাগুলো স্বীকার করতে হবে। দ্রুত সমাধানের দিকে যেতে হবে। এবং জনগণকে সঙ্গে নিতে হবে। বিশেষজ্ঞদের কথা শুনতে হবে।</p> <p>লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক</p> <p>অনুলিখন : রায়হান রাশেদ</p>