<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। এখানকার মানুষ বন্যা, নদীভাঙন ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করেই টিকে থাকে। কিন্তু হাওরাঞ্চলের জন্য আরেকটি বাড়তি দুর্যোগ হলো আগাম বন্যা বা ‘ফ্লাশ ফ্লাড’। স্বাভাবিক বা মৌসুমি বন্যা সাধারণত বর্ষাকালে দেখা দিলেও এই বন্যা হয় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে। মৌসুমি বন্যার চেয়ে ছোট হলেও এই বন্যা হাওরাঞ্চলের কৃষকের জন্য সবচেয়ে বড় দুর্যোগ। কারণ আগাম বন্যার কারণে কৃষকের সারা বছরের খাবার বা একমাত্র ফসল বোরো ধান নষ্ট হয়ে যেতে পারে। হাওরের শত শত বিঘা জমির হিল্লোলিত ধান একবেলার মধ্যেই ডুবে যেতে পারে। দুই দিন আগেও পাকা ধান ঘরে তোলার স্বপ্নে বিভোর হাওরের সমৃদ্ধ কৃষক এক রাতে নিঃস্ব হয়ে যেতে পারে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">দেশের অন্যান্য অঞ্চলে এ ধরনের বন্যা সাধারণত দেখা যায় না। এর কারণ হাওরের ভূ-প্রকৃতি। এর প্রায় চারদিকে পাহাড় ঘেরা। আর হাওরগুলো একেকটি গামলার মতো। তাই পাহাড়ি বা উঁচু অঞ্চলে বৃষ্টি হলে তা গড়িয়ে হাওরে আসে এবং আগাম বন্যা দেখা দেয়। আর পাকা বা আধাপাকা ধান নষ্ট হয়ে যায়। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">দেশের অন্যান্য স্থানে যখন মৌসুমি বন্যা আসে, তত দিনে ধান পাকা ও তোলা শেষ। কিন্তু হাওরে সেই বন্যা অনেক আগেই আসে। ফলে হাওরের মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সব কিছু নির্ভর করে আগাম বন্যার ওপর। ধান কাটার আগে এলে কান্না, আর পরে এলে হাসি। দুর্ভাগ্যবশত বেশির ভাগ বছরই আগাম বন্যা এসে হাওরাঞ্চলের আংশিক বা পুরো ধান নষ্ট করে দেয়। প্রায় বছরই দেখা যায় হাওরের কৃষকের হাহাকার। এই কৃষকদের বাঁচাবে কে?</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">প্রকৃতির দয়া ছাড়াও আরেকটি উপায়ে হাওরের এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। সেটা হচ্ছে ফসল রক্ষা বাঁধ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব বাঁধের কার্যকারিতাও কমে যাচ্ছে। এর কারণ অবশ্যই অদক্ষতা ও অনিয়ম। কিন্তু আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে বাঁধ নির্মাণ ও তদারকির সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত না করা। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এটা ঠিক, হাওরের ফসল রক্ষায় বর্তমান সরকার প্রতিবছরই কোটি কোটি টাকা খরচ করে। অর্থাৎ প্রকল্প ও বরাদ্দে কোনো ঘাটতি নেই। হাওরবাসীর সুরক্ষা ও ফসলের সুরক্ষায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নজর রয়েছে। কিন্তু বাঁধ যদি টেকসই না হয়, তাহলে তো সবই গেল। আমি মনে করি, রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের বদলে তা কাজে লাগানো উচিত। হাওরাঞ্চলের জন্য টেকসই বাঁধ নির্মাণ জরুরি। তাহলে আগাম বন্যার হাত থেকে হাওরের ফসল রক্ষা পেত। কিন্তু বাঁধ নির্মাণে জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করা হবে কিভাবে? </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আগে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হতো ঠিকাদার দিয়ে। তাঁদের কন্ট্রাক্ট দেওয়া হতো। তাঁরা কাজ করে টাকা তুলে নিয়ে চলে যেতেন। সেই কাজ কিভাবে হয়েছে, এর মান কেমন—এসব বিষয়ে জবাবদিহি ছিল না বললেই চলে। আমাদের মনে আছে, কয়েক বছর আগে ২০১৭ সালে আগাম বন্যায় হাওরে ব্যাপক ফসলহানি হয়েছিল। অনেক মানুষ পথে বসেছিল। তখন হাওরের বাঁধ ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনেক কথা হয়। এর ফলে বাঁধ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে। প্রণীত হয় কাজের বিনিময়ে টাকা তথা কাবিটা নীতিমালা-২০১৭। হাওরের বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদারি প্রথার অবসান হয়।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">নতুন নীতিমালায় নিয়ম হচ্ছে, স্থানীয় কৃষকদের নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি বা পিআইসি গঠিত হবে। কিন্তু দেখা যায়, কৃষকের বদলে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এসব কমিটিতে যান। আমাদের সোচ্চার হতে হবে, যাতে কৃষকের অধিকার ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। কারণ হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ যদি ঠিক না থাকে, তাহলে এই কৃষকের ফসলই তলিয়ে যায়।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">পিআইসি নিয়ে আরেকটি বিষয় হলো, অনেক বাঁধের ক্ষেত্রেই নীতিমালা অনুযায়ী কৃষককে সেখানে ঢুকতে দেওয়া হয় না। হাওরাঞ্চলের সব নেতাকর্মীকে এই ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এ ছাড়া কোনো হাওরে সময়মতো ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ, সংস্কার বা মেরামত করা হয় না। বাঁধ মেরামত বা সংস্কার যদি দেরিতে হয়, তাহলে তাতে লাভ নেই। কারণ যেকোনো সময় আগাম বন্যা চলে আসতে পারে। আবার দেরিতে বাঁধ নির্মাণ হলে বাঁধের মাটি নরম থাকে এবং আগাম বন্যার সময় সহজে ভেঙে যেতে পারে। এই নজির সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অনেকবার দেখা গেছে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অন্যান্য অনিয়মও হয়। যেমন—নীতিমালা অনুযায়ী বাঁধের অন্তত ৫০ মিটার দূরে থেকে মাটি আনতে হবে। কারণ কাছ থেকে নিলে বাঁধটিই ভেঙে যেতে পারে। বর্তমানে তা মানা হচ্ছে না। কৃষকদের অনেকের অভিযোগ, অনেক অপ্রয়োজনীয় বাঁধও নির্মিত হচ্ছে। বাঁধ ভাঙার আরেকটি বিপদ হলো সেটা বন্যায় ধুয়ে গিয়ে নদী ভরাট হয়। ফলে নদীর নাব্যতা কমে যায়। আবার বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে হাওরের ভূপৃষ্ঠেরও ক্ষতি হচ্ছে। তাই অপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ কিভাবে টেকসই হবে, সেটা নিয়ে গবেষণা বাড়ানো দরকার। হাওরাঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়েও এখন ভাবতে হবে। কারণ এর বিরূপ প্রভাব ক্রমেই মারাত্মক আকার ধারণ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের ধরন, আগাম বন্যার সময়সূচি প্রভৃতি বিষয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে ধানের বীজতলা ও রোপণ বিলম্বিত হচ্ছে। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাওরাঞ্চলে বন্যার সময়ও বদল হচ্ছে। ২০১৭ সালে আগাম বন্যা আঘাত হানে মার্চের ২৮ তারিখে। অথচ তার আগে এপ্রিলের শেষে বা মার্চের প্রথম দিকে বন্যা আসত। এসব নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আগাম বন্যার হাত থেকে বাঁচতে হাওর এলাকা দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোও খনন করা জরুরি। কারণ পলি পড়ে নদীর তলদেশ উঁচু হওয়ায় নদীতে পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে এবং পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। তাই পাহাড়ি ঢলের পানি ছড়িয়ে পড়ে ক্ষেত-খামারে। হাওরের নদীগুলো খনন করতে হবে। সবচেয়ে জরুরি হাওরাঞ্চলের কৃৃষকদের সংগঠিত করে তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা। কৃষকদের অধিকার সচেতন করা গেলে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের অধিকার আদায় করে নেবেন। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">রাজনীতিকদের মধ্যে ঐক্য ও উদ্যম থাকলে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ সময়মতো মেরামত হবে, কৃষকের অংশীদারিও নিশ্চিত হবে। আমি এ জন্য বলব, দল-মত-নির্বিশেষে হাওরাঞ্চলের সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীকে প্রস্তুত হতে হবে। কৃষককে সঙ্গে নিতে হবে। তাঁদের অনেকের হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া নেই। কিন্তু যে লোকায়ত জ্ঞান রয়েছে, সেটা অনেক মূল্যবান। তাঁদের কষ্টার্জিত ফসল আমাদের খামখেয়ালিপনায় যেন নষ্ট না হয়। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লেখক : চেয়ারম্যান, সুনামগঞ্জ ফাউন্ডেশন </span></span></span></span></p>