<p>বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ড. ইউনুসের পক্ষে তাঁবেদারিমূলক কথা বলে ১২ জন মার্কিন সিনেটর পত্র লিখেছেন। চিঠিটি যৌক্তিক কারণেই অনেক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। প্রথমত, একটি সার্বভৌম দেশের সরকারপ্রধানের কাছে এহেন ধৃষ্টতাপূর্ণ চিঠি দিয়ে ১২ জন সিনেটর শুধু আন্তর্জাতিক আইনই ভঙ্গ করেননি, তাঁরা জাতিসংঘ সনদেরও বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। জাতিসংঘ সনদের, যেটি প্রণয়নে যুক্তরাষ্ট্রের মুখ্য ভূমিকা ছিল, ২(১) নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, ‘সংস্থাটি সব সদস্য রাষ্ট্রের সমান সার্বভৌমত্বের নীতির উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত।’ সে অর্থে ছোট-বড়-নির্বিশেষে সব সদস্য রাষ্ট্রই অন্যদের সার্বভৌমত্ব মানতে বাধ্য। আন্তর্জাতিক আইনের এক বিশেষজ্ঞ ওপেনহাইম তাঁর বই, ইন্টারন্যাশনাল ল : এ ট্রিটাইস-এ লিখেছেন যে প্রতিটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হচ্ছে সে দেশের আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে বড় উপাদান। তিনি লিখেছেন, সার্বভৌমত্বের অর্থ কোনো রাষ্ট্রই অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলাতে পারে না। তিনি আরো লিখেছেন, কোনো আত্মসম্মানসচেতন রাষ্ট্রই তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য রাষ্ট্রের নাক গলানো সহ্য করতে পারে না। প্রতিটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ওপর অন্যান্য বিশেষজ্ঞ, যথা আন্তর্জাতিক আদালতের সাবেক বিচারক লটারপ্যাক্ট, হিগিনস, অধ্যাপক ব্রাউন লি, অধ্যাপক সোয়ার্জেন বার্গার প্রমুখ ব্যক্তিরাও একই ধরনের মতামত ব্যক্ত করেছেন। আন্তর্জাতিক আইনের পর্যালোচনায় এটি পরিষ্কার যে উক্ত ১২ জন মার্কিন সিনেটর চিঠিটি লিখে আন্তর্জাতিক আইনকে গলা চেপে হত্যা করেছেন। তা ছাড়া উক্ত পত্রের মাধ্যমে ১২ জন সিনেটর প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে বলে আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার তত্ত্বকে ভূলুণ্ঠিত করেছেন। সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের অনুরূপ, বাংলাদেশের তিনটি অঙ্গ, যথা—প্রশাসন, আইন প্রণয়ন এবং বিচার অঙ্গ একে অন্যের থেকে স্বতন্ত্র, যাতে ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কোর ক্ষমতার বিভাজন (সেপারেশন অব পাওয়ার) তত্ত্বের প্রতিফলন রয়েছে। এই নীতির ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা প্রশাসন থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কোনো ক্ষমতা নেই কোনো আদালতের বিচারপ্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করার। এটিই আইনের শাসন এবং সাংবিধানিক শ্রেষ্ঠত্বের মূল কথা, যেগুলো বাংলাদেশের সংবিধানের অখণ্ডনযোগ্য বৈশিষ্ট্য।</p> <p><img alt="১২ সিনেটরের চিঠির মূল উদ্দেশ্য কী" height="252" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/january/27-01-2024/2.jpg" style="float:left" width="300" />১২ সিনেটরের চিঠি থেকে এটা দিবালোকের মতো পরিষষ্কার যে তাঁরা ড. ইউনুসের মামলার বিষয়বস্তু সম্পর্কে মোটেও কিছু জানেন না। বরং অন্যের, বিশেষ করে হিলারি ক্লিনটনের চাপে পড়ে এই চিঠি লিখেছেন। তাঁরা নিজেরা আইন প্রণেতা হয়েও শ্রম আদালতের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞান, বলতে গেলে, শূন্যের কোঠায়। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট শ্রম আদালতটি দ্রুতগতিতে ড. ইউনুসের মামলার শুনানি সম্পন্ন করেছে বলে তাঁরা যে কথা লিখেছেন, তা থেকে উক্ত সিনেটরদের অজ্ঞতাই প্রকাশ পায়। তাঁরা সম্ভবত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক অধ্যাপকের কথা অনুসরণ করে এটি লিখেছেন। উক্ত অধ্যাপক এই প্রশ্ন রেখে চরম অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন যে, যেখানে অন্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি বিচারপ্রক্রিয়ায় বছরের পর বছর লেগে যায়, সেখানে ড. ইউনুসের মামলা কী করে এত দ্রুত শেষ হলো। অধ্যাপক সাহেব ফৌজদারি আদালতের এবং শ্রম আদালতের বিচারের পার্থক্য বুঝতে অক্ষম হওয়ায় আইনে মৌলিক জ্ঞানসম্পন্ন সবারই অবাক হওয়ার কথা। তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হননি যে শ্রম আদালতের মামলা আর ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়রা আদালতের মামলার সময়সীমার মধ্যে বেজায় পার্থক্য রয়েছে এই অর্থে যে, ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়রা আদালতে প্রচুর মামলার জট থাকার কারণে সেসব আদালতে বিচারপ্রক্রিয়া দীর্ঘস্থায়ী হয়। কিন্তু শ্রম আদালতসমূহে এ ধরনের জট একেবারেই নেই বিধায় সেখানে বিচারে বিলম্ব হয় না। বরং শ্রম আদালতে অন্যান্য মামলায় যে গতিতে বিচার সম্পন্ন হয়, ড. ইউনুসের মামলায় তার চেয়েও অনেক বেশি সময় লেগেছে, মূলত এই কারণে যে ড. ইউনুস তাঁর মামলা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত নিয়েছিলেন। শ্রম আদালতসমূহের মামলাগুলো কয়েক মাসের মধ্যেই শেষ হয়, অথচ আইনের একজন অধ্যাপক ফৌজদারি কার্যবিধি এবং দণ্ডবিধির অধীনে ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বা দায়রা আদালতের মামলা এবং শ্রম আদালতের মামলাগুলোর মধ্যে পার্থক্য বোঝার মতো জ্ঞান বিবর্জিত, যা দেখে অবাক হতে হয়।</p> <p>১২ মার্কিন সিনেটর নিশ্চয়ই সেই অজ্ঞ অধ্যাপকের কথায় প্রভাবিত হয়েই উক্ত অজ্ঞতাপূর্ণ কথা লিখেছেন। উল্লিখিত মামলায় ড. ইউনুসকে তাঁর পক্ষ সমর্থনের জন্য সব ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। মামলাটির শুনানি হয়েছে মোট ২১ দিন। আর ড. ইউনুসের আইনজীবী বিপরীত পক্ষের  সাক্ষীদের আট দিনব্যাপী জেরা করেছেন কোনো বাধার সম্মুখীন না হয়ে। এই বিচারে অনিয়ম হয়েছে বলে উল্লিখিত অধ্যাপকের মতো তাঁরাই দাবি করছেন, আমাদের বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে হয় যাঁরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ অথবা বর্তমান সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য যাঁরা মিথ্যার বেসাতি সাজিয়ে কথা বলছেন। মামলার রায় সরকার দেয়নি, দিয়েছেন আদালত। যাঁরা বিপরীতমুখী কথা বলছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন যে শ্রম আদালতের চেয়ারম্যানসহ বাংলাদেশের সব নিম্ন আদালতের বিচারকগণের নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ হাইকোর্ট, সরকার নয়। তাঁদের পদোন্নতি, বদলি, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, সবই হাইকোর্টের হাতে। তাঁদের এটাও অজানা থাকার কথা নয় যে বাংলাদেশের শ্রম আদালতসমূহ এবং শ্রম আপিল আদালত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, আইএলওর বিধান এবং নির্দেশনা বলে সৃষ্ট এবং কর্মরত, যে সংস্থাটির প্রথম জন্ম হয়েছিল ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, এবং যেটি পরবর্তীতে ১৯৪৪ সালের ফিলাডেলফিয়া ঘোষণা (যেটি হোয়াইট হাউসেই সম্পন্ন হয়েছিল), ১৯৮৮ সালের ডিক্লারেশন অন ফান্ডামেন্টাল রাইটস অ্যাট ওয়ার্ক এবং ২০০৮ সালের ডিক্লারেশন অন সোশ্যাল জাস্টিস ফর এ ফেয়ার গ্লোবালাইজেশন দ্বারা পরিমার্জিত হয়েছিল। সে অর্থে বাংলাদেশের শ্রম আইন এবং আদালতসমূহ বস্তুত আন্তর্জাতিক আইনেরই অংশ।</p> <p>সতেরো শতকে ড. থমাস ফুলার নামক এক ব্রিটিশ মনীষী লিখেছিলেন, ‘তুমি যত বড়ই হও না কেন, আইন তোমার চেয়েও বড়।’ সে কথাই আইনের শাসনের মূল মন্ত্র। এই অবিস্মরণীয় তত্ত্ব বাংলাদেশের সংবিধানেও রয়েছে, যা বিনা ব্যতিক্রমে অনুসরণ করা হয়। এই সাংবিধানিক নির্দেশনা নির্ভয়ে অনুসরণ করে বাংলাদেশের তৃতীয় শ্রম আদালত আইনের শাসনের পতাকা সমুন্নত রেখেছে। বড় মাপের ব্যক্তি হলে বা নোবেল বিজয়ী হলে তাঁদের বিচার করা যাবে না, এ কথা আইনের শাসনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির বিচার করে তাঁঁকে সাজা দিয়েছেন মিয়ানমারের আদালত। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতও তাঁর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্তে নেমেছে। অতীতে ধর্ষণের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) প্রধান স্ট্রস কাহানের বিচার যুক্তরাষ্ট্রেই হয়েছে। সে দেশেই এখন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিচার চলছে। সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজির বিচার প্রক্রিয়াধীন। বাংলাদেশেও সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর বিচার ও সাজা হয়েছে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। নোবেল বিজয়ী হলেই তিনি ধোয়া তুলসী পাতা হতে পারেন না।</p> <p>প্রবেশনের সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পরও শ্রমিকদের স্থায়ী চাকরিতে বহাল না করার কথা ড. ইউনুস অস্বীকার করেননি। তিনি বরং তাঁর সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা দেখানোর চেষ্টা করেছেন। অথচ এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে প্রবেশনকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পর কর্মচারীদের স্থায়ী পদ প্রদান করতে হয়, তাদের প্রাপ্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা যায় না। অতীতে বাংলাদেশের আয়কর কর্তৃপক্ষকে ড. ইউনুস এই বলে প্রতারিত করতে চেয়েছিলেন যে, যে সংস্থার আয়ের ওপর কর আরোপ করা হয়েছে সেটি একটি ট্রাস্ট। অথচ সেটি কুমুদিনীর মতো দাতব্য ট্রাস্ট নয় বরং ড. ইউনুস ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য গঠিত ট্রাস্ট, যা আয়করমুক্ত হতে পারে না। পরে মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশে তিনি আয়করের দায় স্বীকার করে তা শোধ করেছিলেন। আর এক মামলায় তাঁর কম্পানির কর্মচারীগণ ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে তাঁদের পাওনা অর্থ আত্মসাতের মামলা করলে শ্রমিক নেতাদের ঘুষ প্রদান করে মামলা তুলে ফেলার অভিযোগ দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তাঁর সে সময়ের আইনজীবী হলফনামার মাধ্যমে মহামান্য হাইকোর্টকে জানিয়েছিলেন যে তাঁকে ড. ইউনুস অবিশ্বাস্য অঙ্কের টাকা ফিস দিয়েছিলেন, যে অঙ্কের কথা শুনে স্বয়ং মাননীয় বিচারপতিও অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন এত টাকা ফিস পৃথিবীর কোথাও দেওয়া হয় কি না। সে সময়ের আইনজীবী আরো উল্লেখ করেছেন অবিশ্বাস্য অঙ্কের টাকা অন্যত্র খরচ করা হয়েছে, যা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে ড. ইউনুস দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে শ্রমিক নেতাদের প্রভাবিত করেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে মামলাগুলো তুলে নিতে।</p> <p>কয়েক মাস আগে ড. ইউনুসের অতি নির্ভরযোগ্য এবং বিপদকালে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে বদ্ধপরিকর বন্ধু, হিলারি ক্লিনটনসহ ১১০ জন ড. ইউনুসের মামলা তুলে নেওয়ার দাবি জানিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে একই ধরনের চিঠি লেখার পর তাঁদের অনেকেই স্বীকার করেছিলেন যে মামলার বিষয়বস্তু সম্পর্কে তাঁরা তেমন কিছু জানেন না। নজর কাড়ার মতো ঘটনা হলো এই যে, পূর্বতন চিঠিতে ১১০ জন দস্তখত করলেও এবার সংখ্যাটি মাত্র ১২ জনে নেমে গেছে। হিলারি ক্লিনটন সম্ভবত এবার আরো বেশি লোককে প্রভাবিত করতে পারেননি। তবে বাংলাদেশে সরকারকে বিব্রত করার জন্য যাঁরা ড. ইউনুসের কাঁধে ভর করে তাঁদের এজেন্ডা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করছেন, তাঁদের বোঝা উচিত যে তাঁদের অপপ্রয়াস সফল হবে না, কেননা দেশের মানুষ ড. ইউনুসের প্রতারণার কথা বিস্তারিতভাবেই জানে।</p> <p>লেখক<span dir="RTL" lang="AR-YE" style="font-size:14.0pt"> : </span>আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি</p> <p> </p> <p> </p>