বাংলাদেশের বহির্বাণিজ্য সম্পর্কে কিছু কথা

  • ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ
শেয়ার
বাংলাদেশের বহির্বাণিজ্য সম্পর্কে কিছু কথা

বাংলাদেশের মতো একটা দেশের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক দুই দিক দিয়ে হয়। একটা হলো এইড, মানে সাহায্য। আরেকটা হলো ট্রেড, মানে বাণিজ্য। এইড ও ট্রেডএই দুটি হলো আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও উন্নয়নের দুটি ক্ষেত্র।

বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এইড, মানে বৈদেশিক সাহায্য, প্রকল্প সাহায্য এবং কারিগরি সহায়তাএগুলো বিভিন্ন দেশ বা বহুজাতিক সংস্থা থেকে নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে আমাদের উন্নয়নকাজে অর্থের সংস্থান হয়। আরেকটা হলো বহির্বাণিজ্যে আমরা যখন এক্সপোর্ট করি, এটা আমরা আয় করি। এটা আমাদের দেশের বিভিন্ন উন্নয়নকাজে লাগে।
আরেকটা ক্ষেত্র হলো ইমপোর্ট। আরো একটা ক্ষেত্র অবশ্য বহির্বিশ্ব, যার মাধ্যমে টাকা আসে, সেটা হলো রেমিট্যান্স। এটা আজকের বিষয়বস্তু নয়।

এই ট্রেড ও এইডের মধ্যে আমাদের সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে ট্রেডের ওপর।

কারণ আমরা দেখছি, এখন বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। অতএব আমাদের এখন বাণিজ্যের দিকে বেশি নজর দিতে হবে।

বাণিজ্যের দিক নিয়ে যদি বলি, তাহলে রপ্তানি বাণিজ্য নিয়ে কথা বলতে হবে। একটা বিষয় লক্ষ করা যায়, আমাদের রপ্তানি বাণিজ্য মোটামুটি বেড়েছে। একেবারে বিরাট পর্যায়ে উঠে গেছে তা নয়।

এখন আমাদের সর্বসাকল্যে রপ্তানি ৫৫ বিলিয়ন, মানে ৫৫০ কোটি ডলার। বহির্বাণিজ্যের আয় কিন্তু খুব বেশি নয়, বিশেষ করে দেশজ উৎপাদন চার হাজার ৬০০ কোটি ডলারের তুলনায়। যে দেশ খুব উন্নত, যে দেশের রপ্তানি খুব বেশি, তাদের বহির্বাণিজ্য অনেক বেশি। যেমন ভিয়েতনামের কথা বলি। ওদের জিডিপি মানে মোট দেশজ উৎপাদন চার হাজার ২০০ কোটি ডলার। বাণিজ্য কিন্তু তিন হাজার ৭৫০ কোটি ডলারের মতো। মানে প্রায় জিডিপির কাছাকাছি ওদের বাণিজ্য।

https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/February/24-02-2024/2/kalerkantho-ed-1a.jpgবাণিজ্যের কতগুলো দিক আছে। একটা হচ্ছে আঞ্চলিক বাণিজ্য, আরেকটা হলো অঞ্চলের বাইরে। আঞ্চলিক বাণিজ্যে আমাদের সবচেয়ে বড় পার্টনার হলো, যদি সাউথ এশিয়া ধরি, তাহলে ভারত। এশিয়া যদি ধরি, এশিয়া কেন পুরো বিশ্বে আমাদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য পার্টনার হলো চীন। কিন্তু এই আঞ্চলিক বাণিজ্যটা আমাদের সহযোগিতা বা আমাদের বাণিজ্য কিন্তু খুব বেশি নয়। অন্যদিকে ভারতের বহির্বাণিজ্য কিন্তু অনেক বেশি। বাংলাদেশে ওরা এক্সপোর্ট করে। ব্রাজিল, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকাবহু দেশে এক্সপোর্ট করে। আর চীনের কথা বাদই দিলাম। এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে চীন এক্সপোর্ট করে না।

আমাদের এখানে কতগুলো আঞ্চলিক বাণিজ্যচুক্তি আছে, সেগুলো খুব শক্তিশালী নয়। খুব কার্যকরও নয়। যেমনআমাদের এখানে সার্কের কার্যক্রম এখন একেবারেই নগণ্য। তারপর আছে বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান-ইন্ডিয়া-নেপাল), তারপর বিসিআইএম (বাংলাদেশ-চীন-ইন্ডিয়া-মালদ্বীপ)। এগুলোর বাইরেও কিছু বাণিজ্য সম্পর্ক আছে, কিন্তু সেগুলোতে আঞ্চলিক বাণিজ্য খুব বেশি নেই। অঞ্চলের বাইরেও কতগুলো দেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য সম্পর্ক আছে। সবচেয়ে বড় হলো যুক্তরাষ্ট্র। তারপর আছে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা। এখন যেভাবেই হোক, আমাদের বাণিজ্যটা বাড়াতে হবে।

আমরা যখন দেখছি, আমাদের ডলার সংকট আছে। এক্সপোর্টের মাধ্যমে আসছে ৫৫০ কোটি ডলার। রেমিট্যান্সের মাধ্যমে আসছে আরেকটু বেশি। কিন্তু আউট ফ্লো তো অনেক; ইমপোর্ট যদিও আমরা কমিয়েছি, তবে ইমপোর্ট একটা বিশাল অঙ্ক। আর ইমপোর্ট একেবারে সব কমানো সম্ভব নয়। কারণ এখানে মূলধনী যন্ত্রপাতি আছে, কাঁচামাল আছে, অন্যান্য পণ্য আছে। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে ইমপোর্ট কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার। অতএব এখন এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের আঞ্চলিক বাণিজ্য এবং বহির্বাণিজ্য বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ একটা হাবমানে ব্যবসা-বাণিজ্য এবং যোগাযোগের একটা কেন্দ্রবিন্দু। যেমনসমুদ্রপথে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর, মোংলা বন্দর, পায়রা বন্দর। অবশ্য চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে নজর একটু বেশি। বাংলাদেশের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের নৌপথে একটা যোগাযোগ আছে। পশ্চিমে এবং পূর্বে অবস্থিত দেশগুলোর সঙ্গে রয়েছে বঙ্গোপসাগরের সংযোগস্থলএটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটাকে আমরা সমুদ্রপথ বলি। এটার জন্য আমরা মোটামুটি সুবিধাজনক জায়গায় আছি। আরেকটা এমন যে আকাশপথে যদি আমাদের বিমানবন্দরগুলো; এখন মোটামুটি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও দেশের অন্যান্য বিমানবন্দর মোটামুটি আছে, এগুলো যদি আরো উন্নত করতে পারি, অবশ্যই এটা একটা আমাদের যোগাযোগের কেন্দ্রবিন্দু হবে। অতএব বাণিজ্য বাড়ানোর মূল হলো বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো। তদুপরি ভেতরের যোগাযোগরাস্তাঘাট, অবকাঠামো ইত্যাদি থাকবে, সেগুলোও গুরুত্বপূর্ণ।

এখানে আরেকটা বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে বহির্বাণিজ্যের জন্য ডলার, পাউন্ড এবং অন্যান্য মুদ্রার মাধ্যমে আমরা যে বাইরের সঙ্গে বাণিজ্য করব, ইমপোর্ট করব, এক্সপোর্ট করব, সেখানে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমেই করতে হবে। মানে এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের যে বিল পেমেন্ট পরিশোধের সিস্টেম, এটা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সম্প্রতি আমাদের যেহেতু একটু রাজনৈতিক টানাপড়েন আছে, ভারতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে এবং অন্যান্য ওয়েস্টার্ন রাষ্ট্র আমাদের চাপ দিচ্ছে। অতএব বাংলাদেশ ডলার, পাউন্ডের বলয় থেকে বেরিয়ে বিকল্প মুদ্রা (ভারতীয় রুপি, চীনা ইউয়ান, রাশিয়ার রুবলের মাধ্যমে বাণিজ্য করার চেষ্টা করছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক পেমেন্ট সিস্টেম সুইফটের বিকল্প খুঁজছে।

সুইফট পৃথিবীর ১৮০টার বেশি দেশের বাণিজ্যের অর্থ পরিশোধ করার একটা ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন ফিন্যানশিয়াল ট্রানজেকশন হয় বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে। সুইফট থেকে রাশিয়া খুব ইন্টারেস্টেড বের হয়ে আসার জন্য। চীন তো বটেই, ভারতও চায়। তারা চাচ্ছে নিজ নিজ সিস্টেম চালু করার জন্য। মানে ডলারকে রিপ্লেস করার জন্য। এটা খুব কঠিন হবে। ডলারের তো প্রায় ৭০ থেকে ৮০ বছরের পথচালা। এর মধ্যে এ পর্যায়ে আসছে। এটা কঠিন হবে। কারণ ডলার একটা খুব বড় এবং শক্তিশালী রিজার্ভ কারেন্সি। অন্যান্য কারেন্সি আছে, পাউন্ড-স্টার্লিং আছে, ইউরো আছে, ইউয়ান আছে, এখন আবার জাপানের ইয়েন আছে; যোগ হয়েছে এখানে। এগুলোও কিছুটা লোকজন অ্যাকসেপ্ট করে, কিন্তু ডলারের মতো নয়। এই প্রেক্ষাপটটার জন্য আমাদের একটু দেখতে হবে। যদি বেরিয়ে আসাটা সেফ হয় এবং তা কতটুকু অর্থবহ হবে। এখন আবার কতগুলো প্রথা চালু করেছে ভারতীয় মুদ্রা; বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যে। ভারতীয় মুদ্রা দিয়ে আমরা লেনদেন করতে পারি, কিন্তু সেটা খুব বেশি কার্যকর হবে না। কারণ ভারতীয় মুদ্রা আমরা কোথায় পাব? আমরা এক্সপোর্ট করি দুই বিলিয়ন আর ভারত আমাদের কাছে এক্সপোর্ট করে সাত বিলিয়নের মতো। তার মানে আমরা যে দুই বিলিয়ন ভারতে এক্সপোর্ট করি, সেটা দিয়ে তো আমরা সব ভারতীয় মুদ্রা পরিশোধ করতে পারব না। আরো পাঁচ বিলিয়ন ডলার থেকে যায়। তার মানে ডলার ভাঙিয়ে ভারতীয় রুপি কিনতে হবে। এটা কার্যকর সমাধান নয়। আবার এদিকে চীনের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে ইউয়ান নিয়ে, এখানেও একই অবস্থা। চীন থেকে আমরা প্রচুর আমদানি করি, রপ্তানি কম করি। ইউয়ান তো আমরা পর্যাপ্ত পাব না। ওরা চাইলেও তো আমরা দিতে পারব না। তখন বলবে, ডলার ভাঙিয়ে দাও আমাদের। এই জিনিসগুলো কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে। তাৎক্ষণিক আমরা যদি কোনো ইমোশন বা আবেগের বশবর্তী হয়ে কিংবা রাজনৈতিক বিবেচনা দিয়ে এগুলো করতে  চাই, তাহলে কঠিন হবে।

আরেকটা জিনিস আমি বলতে চাই, ২০২৬ সাল থেকে কিন্তু আমাদের ডাব্লিউটিওর (ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন) নিয়ম অনুযায়ী অনেক সুবিধা, মানে করের সুবিধা, শুল্কের সুবিধা, জিএসপির সুবিধা এবং বিভিন্ন দেশকে যে সুবিধা দেয়, সেগুলো ধীরে ধীরে কমে যাবে। কারণ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাচ্ছে। তখন কিন্তু অনেক রকম ছাড় বা সুবিধা পাব না। তখন আমাদের অন্যান্য দেশের সঙ্গে কঠিন প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে হবে। তাড়াহুড়া করে কোনো কিছু তৈরি করে স্পেশাল অ্যারেজমেন্টে বিক্রি করি, তখন এই সুযোগ-সুবিধাগুলো চলে যাবে।

আমরা বেশি নির্ভরশীল রেডিমেড গার্মেন্টসের ওপর। মানে অন্য রপ্তানি বহুমুখীকরণ হয়নি। এটা আমি আলাদা করে বলতে চাই। কারণ রপ্তানি করার কিন্তু অনেক জিনিস আছে এখনো। আমাদের চামড়া আছে, পাট ও পাটজাত দ্রব্য আছে, সিরামিক আছে, ইলেকট্রনিক দ্রব্যাদি আছে। এর থেকে আরো বেশ কিছু দ্রব্য আমরা রপ্তানি করে থাকি। কিন্তু সেগুলোর দিকে উৎসাহ-প্রণোদনা, সরকারের সংস্থা বা সরকারের প্রণোদনা, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ফান্ড আছে, এগুলোর সুযোগ-সুবিধা কিন্তু অত্যন্ত কম।

অতএব আমাদের রপ্তানিটাকে বহুমুখী করতে হবে, পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং ডেস্টিনেশন বাড়াতে হবে। শুধু ইউরোপের বাজারে পাঠাব, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া পাঠাব, সেটা নয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও পাঠাতে হবে, সেখানেও হয়তো আমাদের পণ্যের চাহিদা আছে। সে জন্য আমাদের পণ্যের প্রচার এবং পণ্যের গুণগত মান বাড়াতে হবে।

অতএব আমাদের এখন দরকার, সরকারি যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো এবং বিডার (বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি) কার্যকলাপ আরো বিস্তৃত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংককে রপ্তানি কার্যক্রমে সহায়তা দিতে হবে।

এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের মাধ্যমে কিন্তু অনেক অর্থ পাচার হয়ে যায়, এটা একটা প্রধান সমস্যা, ওভার ইনভয়েসিং-আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। সেটা রোধ করা অত্যন্ত দরকার। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা আছে, এনবিআর, বিশেষ করে কাস্টমসের ভূমিকা আছে এবং অন্যান্য সংস্থারও ভূমিকা রয়েছে। অর্থপাচার রোধ না করলে আমরা যতই এক্সপোর্ট করি, অনেক টাকাই হয়তো দেশে আসবে না। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোকে অত্যন্ত শক্তভাবে এগুলো হ্যান্ডেল করতে হবে, যেন কোনোভাবেই অর্থ পাচার না হয়। কোনোক্রমেই যেন আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে দুর্নীতি না হয়। তবেই কিন্তু আমরা বাণিজ্যের সুফলটা যথাযথভাবে পাব।

লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ এখন ট্রাম্পের হাতে

    ড. ফরিদুল আলম
শেয়ার
ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ এখন ট্রাম্পের হাতে

তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসা যুদ্ধের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে আসা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধের অবসান চাইছে। পুরো বিষয়টির জন্য দায় চাপানো হচ্ছে ইউক্রেনের বর্তমান নেতৃত্বের ওপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের দেশগুলোও এই যুদ্ধে সহায়তা দিয়েছে, যদিও তা যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় কম, তবে তারা এখনো ইউক্রেন এবং এই যুদ্ধের বৈধতার পক্ষে তাদের তৎপরতা চালাচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মধ্যে কৌশলগত স্বার্থের জায়গায় বড় ধরনের চিড় ধরার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।

যুদ্ধ বন্ধের জন্য যে শান্তিপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, সেটিও একতরফাভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনের উদ্যোগে পরিচালনা করা হচ্ছে। ইউরোপের কাছ থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো কিছু জানার প্রয়োজন পর্যন্ত উপলব্ধি করছে না যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে বাগবিতণ্ডার পর যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে চলমান সহায়তা যখন আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছিলেন ট্রাম্প, এর পরপরই ইউরোপীয় দেশগুলো তাত্ক্ষণিকভাবে একত্র হয়ে ২২৬ বিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তাদের পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে সর্বাত্মক সহায়তা প্রদানের কথা বলা হয়। তারাও যুদ্ধ বন্ধ চায়, তবে সেটি যেন উভয় পক্ষের জন্য সম্মানজনক হয় এবং কোনোভাবেই ইউক্রেনকে বাদ দিয়ে না হয় সেটির নিশ্চয়তা চায়।
ইউরোপের এ ধরনের তৎপরতা যে ট্রাম্প ভালোভাবে নেননি, সেটির জানান দিতে বিলম্ব করেননি তিনি। প্রথমে ইউক্রেনে সামরিক এবং পরে গোয়েন্দা সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দেন। এর মাধ্যমে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হলো যে এই যুদ্ধে তিনি ইউক্রেনের পক্ষ ত্যাগ করেছেন।

ভীষণ এক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এখন ইউক্রেন এবং গোটা ইউরোপ।

পুরো ঘটনায় এখন পর্যন্ত দৃশ্যমানভাবে লাভবান পক্ষ হচ্ছে রাশিয়া। ইউক্রেন নিয়ে ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এ ধরনের টানাপড়েনের মাঝেই গেল ৮ মার্চ ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে বড় ধরনের ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ এখন ট্রাম্পের হাতেআঘাত করে বসে রাশিয়া, যেখানে বেশ কিছু নিরীহ মানুষ নিহত হওয়া ছাড়াও অবকাঠামোর ব্যাপক ধ্বংস সাধিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নেওয়া যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও ইউরোপের পক্ষ থেকে গৃহীত ইউক্রেনে শান্তিরক্ষী মোতায়েনের পরিকল্পনাকে প্রত্যাখ্যান করেছে রাশিয়া। অবস্থাদৃষ্টে এটিই বুঝতে পারা যাচ্ছে যে তারা এ বিষয়ে ইউরোপের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনায়ই যেতে সম্মত নয়, বরং এই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ট্রাম্পের এই তৎপরতার মধ্য দিয়ে আপাতদৃষ্টিতে এই যুদ্ধের ফলাফল নির্ণীত হয়ে গেছে, আর তা হচ্ছে এই যুদ্ধে জয়ী হয়েছে রাশিয়া।
পরাজিত পক্ষ কেবল ইউক্রেন নয়, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রও। তবে সেটি কি অনুধাবন করতে পারছেন ট্রাম্প?

আসলে এই যুদ্ধ শুরুর আগেই এমন ধরনের ফলাফল লিখিত হয়ে গিয়েছিল। মার্কিন প্রশাসন এত ব্যয় করে এই যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে যদি রাশিয়ার বিরুদ্ধে জয়ী হওয়ার চিন্তা করে থাকে, তবে সেটি মস্ত বড় একটি ভুল ছিল। এখানে বাইডেনের পরিকল্পনা এবং এর যথার্থতা নিয়ে আলোচনা করার আর কোনো অবকাশ নেই। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট তথা বাইডেন প্রশাসন বিদায়ের পর ট্রাম্পের নেতৃত্বে রিপাবলিকান প্রশাসন এত দিন ধরে চলে আসা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে এক বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে, আর তা হচ্ছে তারা একচেটিয়াভাবে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থকে সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতে চাইছে। এত দিন ধরে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইউরোপের সঙ্গে যেসব বিষয় নিয়ে অভিন্ন স্বার্থ জড়িত ছিল, সে জায়গা থেকে তারা অনেকটাই সরে গিয়ে বর্তমানে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ইউক্রেনের বিরল খনিজ পদার্থে নিজেদের ভাগ বসানোর কাজে। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার শক্তি বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যত্ হুমকির বিষয়টি তিনি কিভাবে মোকাবেলা করবেন, সেসব এখনো স্পষ্ট নয়। তবে যে বিষয়টি স্পষ্ট, তা হচ্ছে ইউরোপের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়তে যাচ্ছে এবং আগামী দিনগুলোতে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের একত্রে চলার নীতি অনেকটাই শ্লথ হয়ে যাবে। এ বিষয়ে এরই মধ্যে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ তাঁর এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপের দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে।

এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কোনো অভিপ্রায় ট্রাম্পের রয়েছেএমন মনে হচ্ছে না, বরং বিষয়টি তাঁর সমন্বিত পরিকল্পনার অংশ বলেই মনে হচ্ছে। ট্রাম্প এর আগের মেয়াদে (২০১৬-২০২০) যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন বহুপক্ষীয় সংস্থাগুলোতে থাকার বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অনেক বেশি মূল্য চোকাতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করে এলেও এবার নির্বাচিত হওয়ার আগেই নির্বাচনী প্রচারণাগুলোতে স্পষ্টভাবে ন্যাটো থেকে বের হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন। আর এ ধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকির একটি বড় কারণ হলো ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সামরিক ও আর্থিক সহায়তা ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় দ্বিগুণ এবং এর মধ্য দিয়ে মূলত ইউরোপীয় দেশগুলোই যুক্তরাষ্ট্রের অবদানের মধ্য দিয়ে সুরক্ষা পেয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য লাভের একমাত্র জায়গা হচ্ছে এই সামরিক সংস্থার আর্টিকল ৫, যেখানে এটি নিশ্চিত করা হয়েছে যে ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশ আক্রান্ত হলে পুরো সংস্থা তার প্রতিরক্ষায় সমন্বিতভাবে কাজ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের হয়তো এই বোধোদয় হচ্ছে যে ১৯৪৯ সালে ন্যাটো প্রতিষ্ঠার যে প্রেক্ষাপট ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর বর্তমান সময় পর্যন্ত মার্কিন নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করার মতো কোনো রাষ্ট্র এখন পর্যন্ত নেই। সে ক্ষেত্রে তারা কেনই বা তাদের অর্থে ইউরোপকে সুরক্ষা দিয়ে যাবে? এমন প্রশ্ন থেকেই ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্যগুলোকে তাদের জিডিপির ৫ শতাংশ ন্যাটোতে বরাদ্দ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের এখন পর্যন্ত এই সংস্থায় থেকে যাওয়ার প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। ট্রাম্প নিজ দেশের নিরাপত্তা নিয়ে যতটা আত্মবিশ্বাস ধারণ করেন, ইউরোপীয় দেশগুলো এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনকে সমন্বিত নিরাপত্তা নিশ্চিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে।

পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে বৈশ্বিক বিষয়ে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক মিলছে না। ট্রাম্পের কথার যৌক্তিকতা রয়েছে। তিনি সম্প্রতি এটিও বলেছেন, সব ইউরোপীয় দেশকে যুক্তরাষ্ট্র যে সহায়তা করে, এর চেয়েও বেশি সহায়তা করতে হয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনকে, যার ফলাফল শূন্য। তিনি এ ধরনের যুদ্ধ চালাতে চাইছেন না। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার যে আগ্রাসী মনোভাব, সেটিকে কি তবে তিনি প্রশ্রয় দিচ্ছেন? এই যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে গোটা পশ্চিমা বিশ্বের সম্পৃক্ততা থাকা সত্ত্বেও রাশিয়া ইউক্রেনের ২০ শতাংশ ভূমির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, যা জেলেনস্কির সঙ্গে ট্রাম্পের বাগবিতণ্ডার পর আরো সম্প্রসারিত হচ্ছে। তবে কি তিনি নীরবে রাশিয়াকে ইউক্রেনের ভূমি দখলে সম্মতি দিচ্ছেন? এই জায়গাটিতে সম্প্রতি নীরবতা ভঙ্গ করেছেন ট্রাম্প। তিনি জানিয়েছেন যে শান্তিচুক্তি না হওয়া পর্যন্ত রাশিয়া যদি তার আধিপত্য ধরে রাখে, এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার বিরুদ্ধেও নতুন করে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি তিনি বিবেচনা করছেন।

এরই মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদ একটি সুবিধাজনক স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের দুই দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। আগামী সপ্তাহে আরেকটি বৈঠকের মধ্য দিয়ে যুদ্ধবিরতির বিষয়টি নিয়ে একটি ধারণায় আসা সম্ভব হতে পারে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে আসার পর ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তাঁদের কাছ থেকে নতুন করে আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি পেলেও তিনি এবং তাঁর ইউরোপীয় মিত্ররা এটি নিশ্চিত জানেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা ছাড়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাঁরা কিছুই করতে পারবেন না। তা ছাড়া শুরু থেকেই এই যুদ্ধে রাশিয়া অনেকটা সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছে। এমন বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সব রাগ, ক্ষোভ ভুলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং যেকোনো শর্তে এই যুদ্ধ বন্ধে আবার আলোচনায় বসতে আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, সব পক্ষই এখন ট্রাম্পকে গুরুত্ব দিচ্ছে।

ট্রাম্প এখন সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গায় রয়েছেন এবং এই যুদ্ধ বন্ধে তাঁর যেকোনো উদ্যোগ ইউরোপের মেনে নেওয়া ছাড়া পথ নেই। এরই মধ্যে ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলেনস্কির সঙ্গে ফের আলোচনায় বসার বিষয়ে অনাগ্রহের কথা জানানো ছাড়াও তাঁকে তাঁর পদ থেকে সরে যাওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি এখন এমন যে যুক্তরাষ্ট্রের ইচ্ছার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জেলেনস্কি যদি সত্বর দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার সঙ্গে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সামনে চলে আসতে পারে, তা হচ্ছে ইউক্রেনের খনিজ পদার্থে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে তারা, বিনিময়ে দনবাস অঞ্চলে রাশিয়ার আধিপত্যের স্বীকৃতি মিলতে পারে। সব শেষে ইউক্রনের জন্য এই যুদ্ধ একটি বড় ট্র্যাজেডি!

 

লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

mfulka@yahoo.com 

মন্তব্য

বাংলাদেশ এবং বৈষম্যের বেড়াজাল

    আব্দুল বায়েস
শেয়ার
বাংলাদেশ এবং বৈষম্যের বেড়াজাল

পাঠকের নিশ্চয়ই দারিদ্র্য ফাঁদের কথা মনে আছে, তেমনি এক ফাঁদ বৈষম্যফাঁদ, যা প্রজন্মে স্থানান্তরিত হতে পারে কিংবা মাকড়সার জালের মতো বৈষম্য ধরে রাখে। পুরুষশাসিত সমাজে একজন নারীর অবস্থানের কথা ধরা যাক, যেখানে একজন নারী সম্পত্তি এবং উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত। তাদের চলাচলের স্বাধীনতা সীমিত। কারণ সামাজিক নিয়ম ভিতরবাহির হিসেবে কাজ শনাক্ত করে দিয়েছে।

এগুলোর সামাজিক প্রতিক্রিয়া খুব ভয়ংকর : মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়, বাড়ির বাইরে কাজ করা মহিলাদের জন্য দুষ্কর এবং পুরুষের চেয়ে মহিলারা কম আয় করে। এর ফলে মহিলাদের নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক পরিণতির দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে মহিলারা ঘরে-বাইরে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে অংশগ্রহণ করতে পারে না।

এমন অসম সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো অতি সহজে পুনরুৎপাদিত হতে থাকে।

যদি একজন নারীর মনে বিশ্বাস জন্মায় যে চুপচাপ থাকা এবং সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলা হচ্ছে ভালো এবং সুন্দর মেয়ের লক্ষণ, তাহলে বিশ্বাসটি সে তার মেয়ে অথবা ছেলের বউয়ের কাছে সংক্রমিত করবে। তেমনি ধনী-দরিদ্রের ক্ষমতাবৈষম্য গরিবের ওপর ধনীর আধিপত্যকে স্বীকৃতি দেয়। উদাহরণ হিসেবে একজন কৃষি শ্রমিকের কথা বলা যায়, যে একজন শক্তিশালী ভূস্বামীর জন্য কাজ করছে। অজ্ঞতা ও অপুষ্টির কারণে সে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারছে না।
আবার সে তার প্রভুর কাছ থেকে নেওয়া ঋণের জালে বন্দি আছে। যদি দেশের আইন তার পাশে দাঁড়ানোর জন্য অপেক্ষা করেও, সে কিন্তু অজ্ঞতা ও অভাবের কারণে রাজনৈতিক ও বিচারিক প্রতিষ্ঠানের সুযোগ নিয়ে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। এভাবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অসমতা অসম সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের দুষ্টচক্রে আটকে আছে।

দুই.

প্রেক্ষিত বাংলাদেশ। আদিকাল থেকে অর্থনীতিবিদদের কাছে প্রবৃদ্ধির পরিমাণগত দিকটা অধিকতর গুরুত্ব পেয়ে আসছে, যদিও সাম্প্রতিক দশকগুলোতে সে ধারার কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশে অর্জিত কৃতিত্বমূলক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি ওই প্রবৃদ্ধির গুণগত অবস্থান তিন দিক থেকে বিবেচনা করা যায়দারিদ্র্য হ্রাসের হার, আয়বিন্যাস ও কর্মসংস্থান। সেটাই হচ্ছে ভালো প্রবৃদ্ধি, যে প্রবৃদ্ধি দ্রুতগতিতে দারিদ্র্য হ্রাস করে, কম বৈষম্য সৃষ্টি করে এবং খুব দ্রুততার সঙ্গে উদ্বৃত্ত খাত থেকে ঘাটতি খাতে শ্রম টেনে নেয়। দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে প্রশংসনীয় কৃতিত্ব দাবি করতে পারে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই দাবি আজ স্বীকৃত, তার পুনরুক্তির প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। যেমনসত্তরের দশকের আয়-দারিদ্র্যের প্রকোপ ছিল প্রায় ৬০ শতাংশ, ২০২৪ সালে তা দাঁড়ায় প্রায় ২৫ শতাংশে। এই উন্নতির পেছনে বড় অবদান রেখেছে লতিয়ে ওঠা মাথাপিছু আয়। বিশেষত, আশির দশকের পর থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাসের মুখে অব্যাহতভাবে জিডিপি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে মাথাপিছু আয় তিন গুণ বেড়ে যায় এবং খুব সহজেই আমরা চিত্তাকর্ষক এ রূপান্তরের তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারি। এর ফলে একদিকে যেমন দারিদ্র্য হ্রাসের দ্বার উন্মোচিত হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম আগের প্রজন্মের চেয়ে অধিকতরকেউ বলে দ্বিগুণ সচ্ছল জীবন যাপন করছে। তার পরও দারিদ্র্যের দহন প্রতিনিয়ত তাড়া করছে অসংখ্য মানুষকে এবং বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ দারিদ্র্যরেখার নিচে বাস করছে বলে জানা যায়। সমাজবিজ্ঞানীদের দৃঢ় বিশ্বাস, মাথাপিছু আয়ের অব্যাহত দ্রুত বৃদ্ধিই তাদের দারিদ্র্যরেখার ওপরে টেনে তোলার ক্ষেত্রে বড় রকমের অবদান রাখতে পারে।

তিন.

কিন্তু যতটা ভাবা যায় সম্পর্কটা আবার ততটা সরলরৈখিক নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেশি হলে দারিদ্র্য হ্রাস দ্রুত না-ও হতে পারে এবং প্রবৃদ্ধিবৈষম্য ও দারিদ্র্য সম্পর্ক নিয়ে আমরা এর আগে আলোচনা করেছি। লক্ষ করা গেছে, এ বিষয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা অন্যান্য দেশ থেকে খুব একটা ভিন্নতর নয়। এখানেও ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্য দারিদ্র্য হ্রাসের ওপর প্রবৃদ্ধির প্রভাবকে সংকুচিত করে রাখছে। যদি বৈষম্যের কথাই বলি, গিনি সহগ ১৯৮৩/৮৪ সালের ০.৩৯ থেকে ২০২৪ নাগাদ ০.৪৯-তে গড়ায়। বৈষম্যের এই বিস্তার শুধু দারিদ্র্য হ্রাসের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলেনি, ক্রমবর্ধিষ্ণু বৈষম্য সমাজে একটি ক্ষুদ্র অংশের হাতে আয় পুঞ্জীভূত করে আপেক্ষিক বঞ্চনার জন্ম দিয়ে চলছে। এই রূঢ় বাস্তবতা আমাদের সামনে আজ এক সামাজিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রকটভাবে উপস্থিত। আর নাগরিকদের জীবনমানের বেলায় পর্বতপ্রমাণ বৈষম্য যে কী ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে, তার ভূরি ভূরি প্রমাণ তো ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছেই। তবে বৈষম্যতাড়িত অসন্তোষ কখন দানা বেঁধে গণবিপ্লবে রূপ নেবে, তা নির্ভর করে সমাজের আয়বৈষম্য সহ্য করার ক্ষমতার ওপর; যেমনবাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে তীব্র বৈষম্যের ভূমিকা খাটো করে দেখার অবকাশ নেই।

চার.

তবে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই যে বেড়ে ওঠা আয়বৈষম্য শুধু বাংলাদেশেরই সমস্যা। উদাহরণ হিসেবে ভারত ও চীনের কথা উল্লেখ করা যায়। সেখানে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন ঘটেছে, তেমনি বাড়ছে বৈষম্য। আর অর্থনৈতিক অধ্যয়নে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ সাইমন কুজনেটসের সাড়া-জাগানো ইনভারটেড ইউ হাইপোথেসিসের কথা নিশ্চয় মনে আছে। তাঁর মতে, প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৈষম্য (বিশেষত আয়বৈষম্য) বৃদ্ধি পায়, তবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছানোর পর বৈষম্য ক্রমাগতভাবে হ্রাস পেতে থাকে। এটি ঘটে মূলত এ কারণে যে বাংলাদেশ এবং বৈষম্যের বেড়াজালদরিদ্র জনগণ দীর্ঘ সময়ে প্রবৃদ্ধিজনিত উপচে পড়া প্রভাবগুলো থেকে ক্রমেই লাভবান হতে থাকে। হতে পারে, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি ও বৈষম্যের মধ্যে বিরাজমান এই বিপরীতমুখী সম্পর্ক কুজনেটসের প্রতিপাদ্যের প্রতি কিছুটা হলেও সমর্থন জানায়। তবে এ প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার যে ধারণাটি এরই মধ্যে প্রচুর বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং প্রশ্ন উঠেছে, নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে কি তাহলে এই প্রবণতা অবশ্যম্ভাবী? এ নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা হয়েছে, যদিও বা শেষ হয়েছে কোনো উপসংহার ছাড়াই। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করেন যে আপাতদৃষ্টিতে প্রবৃদ্ধি ও বৈষম্যের মধ্যে বিপরীতমুখী সম্পর্ক থাকার তেমন কোনো কারণ নেই। অনেক দেশে সম্পদের প্রারম্ভিক বিতরণ তির্যকভাবে অসম থাকার ফলে এবং ওই দেশগুলোতে বৈষম্য হ্রাস সংক্রান্ত কৌশল ও নীতিমালার ব্যর্থতাই এ ধরনের বৈষম্য সৃষ্টির পেছনে ইন্ধন জোগায়। যা হোক, আয়ের পুনর্বণ্টন দুটি উপায়ে দারিদ্র্য হ্রাসের পথ প্রশস্ত করে। প্রথমত, আয়ের স্থায়ী পুনর্বিন্যাস বিতরণ প্রভাবের মাধ্যমে তাত্ক্ষণিকভাবে দারিদ্র্যের প্রকোপ কমাতে সাহায্য করে। দ্বিতীয়ত, এটি প্রবৃদ্ধি সাপেক্ষে দারিদ্র্য প্রভাবগ্রাহকতা বা স্থিতিস্থাপকতাকে স্থায়ীভাবে বৃদ্ধি করে এবং এর ফলে যেকোনো প্রবৃদ্ধির হারের মাত্রায় দারিদ্র্য হ্রাসের বেগ বেড়ে যায়। অর্থাত্ এজাতীয় পুনর্বিন্যাস তখন দ্বৈত পুরস্কার বা ডাবল ডিভিডেন্ড বয়ে আনে : একদিকে প্রবৃদ্ধি নিজেই দ্রুততর হয় আর অন্যদিকে যে গতিতে প্রবৃদ্ধি দারিদ্র্য হ্রাস ঘটায়, তা-ও বেগবান হতে থাকে।

পাঁচ.

গিনি সহগ নিচে নামিয়ে আনতে গেলে বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার যথেষ্ট নয়, চাই একটি সুদৃঢ় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের ঊর্ধ্বে উঠে পাপীদের জন্য যথাযথ শাস্তির বিধান করা। আর তাহলেই বৈষম্য নামক পাপের মাত্রার পরিসমাপ্তি না ঘটলেও তা যে অনেকখানি হ্রাস পাবে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিরাজমান প্রতিষ্ঠানগুলোর আমূল সংস্কার ছাড়া বৈষম্য কমানোর প্রচেষ্টার মানে দাঁড়ায় পেটে কৃমি দূর না করে পুষ্টিকর খাবার ভক্ষণ করা। কিন্তু এই অভাগা বাংলাদেশে তা কতটা সম্ভব সে প্রশ্ন উঠছে প্রতিনিয়ত।

বিরাজমান ব্যবস্থায় এই কাজটি করা খুব কঠিন। এর জন্য প্রয়োজন হবে করকাঠামোতে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা ও দুর্বলতা দূর করে কর ফাঁকি রোধ করা, সাধারণভাবে সম্পত্তি কর পদ্ধতি গ্রহণ করা এবং কর ব্যবস্থাপনায় উন্নতি ঘটানো। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সাদেক আহমেদের মতে, সরকারি ব্যয় পুনর্বিন্যাসের প্রভাব থেকে আসবে জিডিপির ২ শতাংশ এবং অতিরিক্ত করের জোগান থেকে ২.৫ শতাংশ দিয়ে সামাজিক সুরক্ষার জন্য প্রয়োজন জিডিপির ৪ শতাংশ জোগান দেওয়া যেতে পারে। এর সঙ্গে যুক্ত থাকবে বিভিন্ন ধরনের অপচয় থেকে অবমুক্ত অর্থ। এবং সেটি করতে পারলে প্রবল রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতিজনিত বিস্তারিত পরিকল্পনা আয় বিতরণ ব্যবস্থায় উন্নতি ঘটিয়ে অপেক্ষাকৃত অধিকতর সমতা বিধান করতে সক্ষম হবে বলে ধারণা করা যায়।

তা ছাড়া সুশাসনের মাধ্যমেও কিন্তু আয়বিন্যাসে উন্নতি ঘটানো যায়। আইনের শাসনের উপস্থিতি, যথাযথ বিধিমালা, ব্যবস্থা এবং বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে চলতে এবং কাজ করতে দেওয়ার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সমতা বিধানের স্বার্থে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি এবং দম্ভ ও ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষমতা এবং এই ঋণ পরিশোধ না করে খাজনা খোঁজার প্রবণতা অবশ্যই রুখতে হবে। অন্যদিকে একটি অপেক্ষাকৃত ন্যায়সংগত সমাজ বাস্তবায়িত করতে হলে শেয়ারবাজারে অনৈতিক বাণিজ্য এবং অন্যান্য বিকৃতি, কর ফাঁকি, সরকারি ক্রয়ে দুর্নীতি, জোর করে জমি দখল ইত্যাদি রোধ করার মাধ্যমে সমাজের উঁচু ৫ শতাংশের হাতে কুক্ষিগত এসব আয় কিছুটা হলেও কমানো যেতে পারে। বলতে দ্বিধা নেই, কুক্ষিগত সম্পদের পেছনে (এবং বিরাজমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের পেছনে) কাজ করছে বলিষ্ঠ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা, যা বন্ধ না হলে বৈষম্য কমবে বলে মনে হয় না। কিছু প্রতিষ্ঠান; যেমনকেন্দ্রীয় ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক, রাজউক, কর বিভাগ, পৌরসভা ইত্যাদিকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মুক্ত রেখে দেয় নিয়ম-কানুন ও স্বচ্ছতার মাধ্যমে চলতে দিলেই একদিকে যেমন অর্থনৈতিক নৈরাজ্য নির্বাসিত হতে পারে, তেমনি আয়বিন্যাসের উন্নতি ঘটবে বলে আশা করা যায়।

 

লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মন্তব্য

কিডনি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায়

    ডা. এম এ সামাদ
শেয়ার
কিডনি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায়

নিজের ও জাতির কিডনি স্বাস্থ্য সুরক্ষা করতে হলে তিনটি শব্দের অর্থ খুব ভালো করে বুঝতে হবে।

Common-ব্যাপক,  Harmful- ভয়াবহ,  Preventable -প্রতিরোধযোগ্য। অর্থাত্ কিডনি রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যাপক, পরিণতি ভয়াবহ হলেও কিডনি রোগ প্রতিরোধযোগ্য।

কিডনি রোগের হার ব্যাপক।

সারা বিশ্বে শুধু দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বা সিকেডি রোগীর সংখ্যা ৮৫ কোটির বেশি। এই রোগের হার দিন দিন বাড়ছে। উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশে এই রোগের হার অনেক বেশি। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি ৮০ লাখ।
যদি কিডনি রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করে চিকিৎসা না করা যায়, তবে কিডনি ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যায়, যার চিকিৎসা ব্যয় অত্যন্ত বেশি। বাংলাদেশের প্রায় ৪০ হাজার রোগী কিডনি বিকল হয়ে অকালমৃত্যু বরণ করে। আরো ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ আকস্মিক কিডনি বিকলে আক্রান্ত হয়। মৃত্যুর কারণ হিসেবে ১৯৯০ সালে কিডনি রোগ ছিল ১৯তম স্থানে।
বর্তমানে এসেছে সপ্তম স্থানে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৪০ সালে দাঁড়াবে পঞ্চম স্থানে।

কিডনি রোগ মারাত্মক বা ভয়াবহ কেন? প্রথমত, ৭০ থেকে ৯০ শতাংশ নষ্ট হওয়ার আগে অনেক ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ দেখা দেয় না। তাই এই রোগকে বলা হয় নীরব ঘাতক। দ্বিতীয়ত, কিডনি রোগ অন্য রোগের ঝুঁকি অনেক গুণে বাড়িয়ে দেয়।

এ জন্য কিডনি রোগকে বলা হয় ডিজিজ মাল্টিপ্লাইয়ার। যেমন স্বল্প মাত্রায়ও সিকেডি থাকলে হৃদরোগে মৃত্যুর ঝুঁকি ১০ গুণ বেড়ে যেতে পারে, তেমনি আরো অনেক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তৃতীয়ত, কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে গেলে তার চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে আমাদের মতো দেশের শতকরা ১০ ভাগ লোকও তা বহন করতে পারে না। ফলে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কিডনি বিকল রোগী অকালমৃত্যু বরণ করে। চিকিৎসা খরচ মেটাতে গিয়ে অনেক পরিবার দেউলিয়া হয়ে যায়।

আশার আলো এই যে কিডনি রোগ প্রতিরোধযোগ্য। যেখানে অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে ১০ শতাংশ লোক চিকিৎসা নিতে হিমশিম খায়, সেখানে একটু সচেতন হলে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে এই ভয়াবহ কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা যায়।

প্রতিরোধের প্রধান দুটি উপায়

প্রথমত, প্রাথমিক অবস্থায় সুপ্ত কিডনি রোগ নির্ণয় করে তা চিকিৎসা করা। যারা কিডনি রোগের ঝুঁকিতে আছে, তাদের মাত্র দুটি সহজ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগ নির্ণয় করা যায়একটি প্রস্রাবে প্রোটিন যায় কি না; অন্যটি রক্তের ক্রিয়েটিনিন থেকে ইজিএফআর নির্ণয় করে কিডনি শতভাগের কত ভাগ কাজ করছে, তা নির্ণয় করা যায়। এই দুটি পরীক্ষা প্রাথমিক পর্যায়ে হাসপাতালেও করা যেতে পারে।

কিডনি রোগের ঝুঁকিতে আছে কারা?

যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, বংশে কিডনি রোগ আছে, ধূমপায়ী, মাদকসেবী, অতিরিক্ত ওজন, বেশিদিন ব্যথার বড়ি খেয়েছে, বারবার কিডনিতে পাথর বা মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ হয়। শিশুকালে কিডনি রোগ থাকলে। এমনকি বয়স ৫০-এর ওপরে গেলে কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ে। যাঁরা ঝুঁকিতে আছেন, তাঁদের বছরে অন্তত দুইবার কিডনি পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত।

সুস্থ জীবনধারা

কিডনি ভালো রাখতে সুস্থ জীবনধারা চর্চা অপরিহার্য। আটটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় নিয়মিত মেনে চললে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যায়। ১. নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম। ২. উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ। ৩. সুষম ও পরিমিত খাবার গ্রহণ। ৪. পর্যাপ্ত পানি পান। ৫. ওজন নিয়ন্ত্রণ। ৬. ধূমপান ও মাদক পরিহার। ৭. ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ সেবন। ৮. নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা।

কিডনি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রধান চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতা

১. সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব। কিডনি রোগের ঝুঁকি, লক্ষণ সম্পর্কে অজ্ঞতা, চিকিৎসা সম্পর্কে ভুল ধারণা। ২. প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার সুযোগ সীমিত। অনেক অঞ্চলে কিডনি রোগ নির্ণয়ের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা। ৩. আর্থিক সীমাবদ্ধতাডায়ালিসিস ও কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের ব্যয় অনেক বেশি। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা বা বাজেটের অভাব। ৪. কিডনি বিশেষজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর স্বল্পতা। জাপানে প্রতি মিলিয়ন লোকের জন্য ৩৪ জন কিডনি বিশেষজ্ঞ, পক্ষান্তরে বাংলাদেশ আছে দুজনেরও কম। অন্যদিকে সাধারণ চিকিৎসকরা কিডনি সম্পর্কে কম সচেতন। ৫. অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা ও ঝুঁকির কারণ বৃদ্ধি। যেমনডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ ক্রমাগত বাড়ছে; অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়ামের অভাবে কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। ৬. সাংস্কৃতিক ও কুসংস্কার, ঝাড়ফুঁক, কবিরাজ, হারবাল চর্চা করতে গিয়ে বিলম্বে রোগ নির্ণয়ও কিডনি বিকলের ঝুঁকি বাড়ে।

প্রতিবন্ধকতা থেকে উত্তরণের উপায়

নীতিনির্ধারক, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নীতিনির্ধারকদের কিডনি রোগ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমনঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য জাতীয় পর্যায়ে স্ক্রিনিং প্রগ্রাম চালু করা। সুলভ মূল্যে চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করা। উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা।

স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের প্রাথমিক রোগ নির্ণয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সাধারণত চিকিৎসকদের কিডনি রোগের প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রশিক্ষণ দিতে হবে। জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কমিউনিটি আউটরিচ প্রগ্রাম ও বিনা মূল্যে স্ক্রিনিং ক্যাম্পের আয়োজন করতে হবে। গণমাধ্যমের সহায়তায় কিডনি স্বাস্থ্য সম্পর্কে প্রচার করতে হবে।

চিকিৎসার ব্যয় কমানো ও সহায়তা প্রদানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভূমিকা রাখতে পারে। কিডনি রোগীদের জন্য স্বাস্থ্য বীমা চালু করা যেতে পারে। কিডনি রোগীদের জন্য মাইক্রোফিন্যান্স বা স্বল্প সুদের ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সাশ্রয়ী কিডনি চিকিৎসা গবেষণা ও উদ্ভাবনে সহায়তা করতে হবে।

আসুন, কিডনি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সবাই মিলে একযোগে কাজ করি এবং সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে সবার জন্য কিডনি স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা নিশ্চিত করি।

লেখক : সভাপতি, কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস) এবং অধ্যাপক, কিডনি রোগ বিভাগ, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল

 

মন্তব্য

ব্যবসায়ীরা বাঁচলে দেশ ও অর্থনীতি বাঁচবে

    ড. সুলতান মাহমুদ রানা
শেয়ার
ব্যবসায়ীরা বাঁচলে দেশ ও অর্থনীতি বাঁচবে

যেকোনো দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হলো তার ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। ক্ষুদ্র, মাঝারি থেকে বৃহত্ শিল্পসব ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। আমাদের দেশে বর্তমান বৈশ্বিক ও দেশীয় চ্যালেঞ্জের মুখে ব্যবসায়ীদের টিকে থাকা এবং বিকশিত হওয়ার সামর্থ্য প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা যদি বাঁচেন, তবে দেশের অর্থনীতি বাঁচবেএ কথার গভীরতা আজ আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।

সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য কমেছে, বেড়েছে বেকারত্ব। তিনি বলেন, আগের সরকারের অনেকের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হয়েছে তাঁদের নিজেদের কারণেই। সেখানকার শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের চেষ্টা করা হবে। তবে সবাইকে কাজ দেওয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।

বিভিন্ন কারণে বর্তমান সময়ে ব্যবসায় যে মন্দা চলছেএ বিষয়ে সন্দেহ নেই। বড় ব্যবসায়ী ছাড়াও ছোট ব্যবসায়ীদের অবস্থাও খুব বেশি ভালো না। ব্যবসা পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় অর্থনীতিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা-অনিশ্চয়তা বেড়েই চলেছে এবং তা জনমনে অসন্তোষ ও শঙ্কা তৈরি করছে। ব্যাংকগুলোতে এখনো ডলার সংকট তীব্র।

ফলে আমদানিতে ব্যাপক রকম সংকট দেখা দিচ্ছে। আমদানি সংকটের প্রভাব পড়েছে রপ্তানিতেও। উল্লেখ্য, একসময় চিংড়ি দেশের গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি পণ্য ছিল। গ্রামীণ কর্মসংস্থানে অবদান রেখেছিল বেশ। এখন কাঁচামালের ঘাটতি, বিশ্বব্যাপী চাহিদা কম, জলবায়ু পরিবর্তন, আর্থিক অব্যবস্থাপনা ও পরিবর্তিত বাজারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ব্যর্থতাসহ নানা কারণে এই শিল্প হিমশিম খাচ্ছে।
শেয়ারবাজারের অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও আশানুরূপ উন্নতি এখনো ঘটছে না। ডলারের দামে অস্থিরতা, ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদহার, ভ্যাট প্রদানে হয়রানি, ট্রেড লাইসেন্স নবায়নপ্রক্রিয়ায় জটিলতা ও উচ্চ ফি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং অসহনীয় যানজটের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। এমন অসংখ্য ঘটনার খবর গণমাধ্যম কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সূত্র ধরে আমাদের সামনে আসছে।

দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শিল্প-বাণিজ্য পরিচালনা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে নতুন শিল্প স্থাপন আরো বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে। ঋণের সুদহার বৃদ্ধি, ব্যাংকে তারল্য সংকট, টাকার প্রবাহ কমানো, ডলারের উচ্চমূল্য, গ্যাস ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহে ঘাটতি, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাএসব কারণে উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে গিয়ে উদ্যোক্তারা এখন কঠিন সময়ের মুখোমুখি। এ অবস্থায় নতুন শিল্প স্থাপন তো দূরের কথা, বর্তমানে চালু শিল্প টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে দেশে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। এতে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠ অনেক ব্যবসায়ী বিপাকে পড়েন। ফলে ওই সব প্রতিষ্ঠানে দেখা দেয় স্থবিরতা। এরই মধ্যে কয়েকটি বড় গ্রুপের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আরো কয়েকটি গ্রুপের কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে। বিভিন্ন শিল্প খাতে রয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ। এতে দফায় দফায় গার্মেন্টসসহ নানা শিল্পপ্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ হচ্ছে। এর প্রভাবে দেশের অর্থনীতি দুর্বল হচ্ছে। বাড়ছে বেকারত্ব। বিনিয়োগ না হওয়ায় নতুন কর্মসংস্থানের গতিও অনেক কমেছে।

এবারের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক ব্যবসায়ী গণমাধ্যমের কাছে অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, ব্যবসায়ীদের নামে অযথা হয়রানিমূলক মামলা বাণিজ্য শুরু হয়েছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতের অমিল থাকলেই মামলা দেওয়া হচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ীর পরিবারসহ ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে। সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। ব্যবসার প্রয়োজনে বিদেশে যেতে পারছেন না। অস্থিরতার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য ও নতুন বিনিয়োগ বন্ধ করে ঘরে বসে যাচ্ছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।

সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ছয়-সাত মাসে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা শোচনীয়। কোনো শিল্পোদ্যোক্তা নতুন বিনিয়োগ গ্রহণে আগ্রহী হচ্ছেন না, সাহস পাচ্ছেন না। বাস্তবতা হলো, এ রকম অস্থির পরিস্থিতিতে কোনো ব্যবসায়ী নতুন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করতে চান না। যেকোনো দেশের অর্থনীতির গতিপ্রবাহ নির্ভর করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর। যদি আইন-শৃখলা পরিস্থিতি ভালো না থাকে, তাহলে অর্থনীতিতে গতি আনা অসম্ভব ব্যাপার। একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না, দেশে যদি অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে, অর্থনীতি যদি স্থবির হয়ে যায়, তাহলে জনগণকে স্বস্তি দেওয়া যাবে না। মানুষের মধ্যে নানা রকম অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠবে। এটি শেষ পর্যন্ত দেশের এবং দেশের ক্ষতি হবে। দেশকে বাঁচাতে হলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রয়োজন আগে।

সারা দেশে একটি ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। ব্যবসায়ীদের রাজনৈতিক বিবেচনায় না দেখে তাঁদের ব্যবসায়ী হিসেবেই দেখা উচিত। কারণ ব্যবসার সঙ্গে দেশের অস্তিত্বের প্রশ্ন জড়িত। ব্যবসায়ীদের কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থন থাকতেই পারে, কিন্তু সেটিকে পুঁজি করে ব্যবসায় আঘাত হানা কোনো যৌক্তিক বিষয় হতে পারে না। যেকোনো সরকার পরিবর্তনের পর দলীয় তকমা ব্যবসায়ীদের লাগিয়ে দেওয়াটাও সঠিক নয়। এর ফলে অর্থনীতিতে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এমন অবস্থায় ব্যবসায়ীরা উদ্যম হারিয়ে ফেলেন। এ দেশে যেমন রাজনীতিবিদদের অবদান আছে, তাঁরা গণতন্ত্রকে সুসংহত করেন, তেমনি শিল্পোদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীরা ছাড়া দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখা অসম্ভব বিষয়। মূলত ব্যবসা বাঁচলে দেশ বাঁচবে এবং দেশের অর্থনীতি বাঁচবে। কাজেই দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখে দেশকে বাঁচিয়ে রাখতে ব্যবসায়ীদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ রাখার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

sultanmahmud.rana@gmail.com

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ