<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। যত দিন যাচ্ছে, ততই জনগণের প্রত্যাশার মাত্রাও বেড়ে চলেছে। অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠেছে কখন নির্বাচন হবে, কখন রাজনৈতিক সংস্কারের কার্যক্রম শেষ হবে। এরই মধ্যে বিএনপি নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার তাগিদ দিয়েছে। কিন্তু ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই সরকার দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে, সেই ছাত্র-জনতা চায় দেশের প্রয়োজনীয় সংস্কার। দীর্ঘদিনের নানা ধরনের জঞ্জাল পরিষ্কার করে দেশকে মসৃণ পথে নিয়ে যাওয়াই ছাত্র-জনতার মূল লক্ষ্য। এ জন্য তারা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তাদের কমিটমেন্ট নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা দীর্ঘদিনের। বর্তমান সরকারও চায় প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ সংস্কার সাধন। কারণ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতার ওপরই দেশের গণতন্ত্রের পথ সুগম হয় এবং গণতন্ত্র কার্যকর হয়। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো যদি কোনো সরকারের আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করে, তাহলে কোনোভাবেই সেই দেশে গণতন্ত্র যথাযথভাবে পরিচালিত হয় না, বরং সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্র রাজনৈতিক নেতাদের পকেটে উঠে যায়। আমাদের দেশে নানা ধরনের সংকট রয়েছে। বিশেষ করে দীর্ঘদিন থেকে সরকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটিই সম্পূর্ণভাবে জনগণের আস্থায় আনা সম্ভব হয়নি। যখন যে সরকার এসেছে, তারা সেভাবেই তাদের মতো করে নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে সাজানোর চেষ্টা করেছে। জনগণের চরম প্রত্যাশা থাকা সত্ত্বেও নির্বাচনী ব্যবস্থায় আস্থার সংকট থেকেই গেছে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আমরা লক্ষ করেছি, নব্বই-পরবর্তী প্রায় প্রতিটি সরকারের মেয়াদ শেষেই নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সংঘাত ও অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। কখনো সংকট থেকে সুষ্ঠু উত্তরণ ঘটেছে আবার কখনো রাজনৈতিক ঘোলাটে পরিবেশ জাতির জন্য চরম দুর্ভোগের কারণ হয়েছে। দেশের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন আজ পর্যন্ত কোনো সরকারই আনতে পারেনি। রাজনীতিবিদরা তাঁদের প্রদত্ত গণতন্ত্র কায়েমের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। গণতন্ত্র রক্ষার অঙ্গীকার করা হয়, কিন্তু গণতন্ত্র কিংবা গণতান্ত্রিক পরিবেশ কোনোটাই রক্ষিত হয়নি। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুসংহত করার জন্য দেশের রাজনীতিবিদরা অতীতে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কিন্তু সেগুলো তাঁরা রক্ষা করতে পারেননি। যেমন ১৯৯০ সালের তিন জোটের রূপরেখা। ওই রূপরেখার মাধ্যমে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নানা রকম সংস্কারের অঙ্গীকার করেছিল। তারা জাতীয় সংসদকে সব সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করাসহ বিভিন্ন ধরনের ইতিবাচক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু দেশে বিদ্যমান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোই তিন জোটের রূপরেখার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি। বিরোধী দলগুলো সংসদের অধিবেশনগুলো বর্জন করেছে প্রতিনিয়ত। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, গৃহপালিত বিরোধী দল সেজে সংসদকে কার্যকর করার কোনো প্রক্রিয়াই তারা অবলম্বন করেনি। বরং বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল সংসদকে সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে ব্যর্থ হয়েছে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা গণতন্ত্রের প্রধান বেশিষ্ট্য হলেও তা মেনে চলার মানসিকতা বাংলাদেশে নেই। পরমত মেনে চলার প্রসঙ্গে বিশিষ্ট মনীষী ভলতেয়ারের বিখ্যাত উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য : </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘I do not agree with a word you say, but I will defend to the death your right to say it.’ </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">অর্থাৎ </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আমি তোমার একটি কথাও সমর্থন করি না, কিন্তু তোমার মত প্রকাশের অধিকারকে প্রাণ দিয়ে রক্ষা করব।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> রাজনৈতিক দলগুলো আজও একই কণ্ঠে অঙ্গীকার করতে পারেনি, তারা আজ যে সমঝোতা এবং প্রতিশ্রুতি দেবে, তা আগামী দিনেও যথাযথভাবে মেনে চলবে। সরকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়া নিয়ে পুনরায় দেশে কোনো অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে না। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">দেশের সব রাজনৈতিক দলকে হতে হবে স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ এবং গণতন্ত্রমনা। আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষার্থে প্রতিশ্রুতি দেয় ঠিকই, কিন্তু তা রক্ষায় তাদের সফলতার পরিমাণ খুবই কম। সরকারের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি এবং দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষায় নাগরিক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কথা থাকলেও দলতন্ত্র ও ফায়দাতন্ত্রের লাগামহীন চর্চার ফলে তারা যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সংগঠিত নাগরিক সমাজের বেশির ভাগ আজ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অনুগত। নব্বইয়ের গণ-আন্দোলনের সময়ে একতাবদ্ধ শিক্ষক, ডাক্তার, আইনজীবী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী ও অন্যান্য পেশাজীবীর অনেকেই তাঁদের অতীতের নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সরে এসে এখন দলীয় অঙ্গ কিংবা সহযোগী সংগঠনের খাতায় নিজেদের নাম লিখিয়েছেন। ফলে তাঁরা গণতান্ত্রিক শাসনকে সুসংহত করার ক্ষেত্রে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। এবার ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে যে রাজনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতিতে যেভাবে একতাবদ্ধ হয়েছে, তা রক্ষা করা এবং রাজনৈতিক নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার চ্যালেঞ্জটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ছাত্র-জনতা যেন কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি না করে, সঠিক এবং ন্যায্য পথে এগিয়ে যায়, সেটি আমাদের প্রত্যাশা।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">দেশের গণতান্ত্রিক শাসনের ব্যর্থতার মূলে আরো একটি বড় সমস্যা হলো</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান থাকলেও দেশে একটি প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান অর্থাৎ এখানে প্রধানমন্ত্রীই সব ক্ষমতার মূলে। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো কিছুই কার্যকর অর্থে করা সম্ভব নয়। সংসদীয় বিধান মোতাবেক সংসদে সরকারের প্রতি অনাস্থা আনার বিধান থাকলেও সংবিধানে বর্ণিত ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদের ফলে তা বাস্তবায়ন করা অসম্ভব। সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সাংবিধানিক কিছু পরিবর্তন কিংবা সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। কারণ ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু যদি এক ব্যক্তি হন, তাহলে দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির মাত্রার চেয়ে দুর্নীতি কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগই বেশি তৈরি হয়। এ প্রসঙ্গে লর্ড অ্যাক্টনের কথা মনে পড়ে যায়, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ক্ষমতা দুর্নীতির জন্ম দেয়, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিরঙ্কুশ দুর্নীতির জন্ম দেয়।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> বাংলাদেশের সাংবিধানিক ধারা মতে, সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর মতের বিরুদ্ধে সংসদে ভোটাধিকার প্রয়োগ করলে পদ হারানোর ভয়ে সংসদ সদস্যরা নিজস্ব বিবেক-বুদ্ধির বাইরে চলে যান। এটিই হচ্ছে বাংলাদেশে দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার নমুনা। যেখানে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা বিদ্যমান, সেখানে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাবের বিধান থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এ জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমার আহবান, আপনারা নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে সমঝোতা এবং পরবর্তীকালে ক্ষমতায় এসে পুনরায় ক্ষমতা ধরে রাখার নতুন ফন্দি করতে সচেষ্ট না হয়ে গণতন্ত্র রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিন। আমরা চাই সত্যিকার গণতন্ত্র। এ জন্য শুধু নির্বাচন, নির্বাচনকালীন সরকার নয়, বরং নির্বাচন-পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে তা মেনে চলার ইতিবাচক অঙ্গীকার রক্ষা জরুরি।  </span></span></span></span></p> <p> </p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লেখক : অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">sultanmahmud.rana@gmail.com</span></span></span></span></p>