<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এরই মধ্যে অল্প হলেও অবস্থা যে বদলেছে, তাতে সন্দেহ কী? মনে হচ্ছে নতুন একটি বাস্তবতাই তৈরি হয়েছে। কিন্তু সারবস্তুতে সত্যি সত্যি কোনো বদল ঘটেছে কি? আসলে কিন্তু বাস্তবতার ওপরটাই যা বদলেছে, ভেতরের বস্তু আগের মতোই। পুরনো বাস্তবতার নানা প্রকাশ তাই দেখতে পাচ্ছি; যেমন</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">নারী ও শিশু নির্যাতন। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এবারের জুলাই মাসটি তো উত্তাল ছিল আন্দোলনে। মানুষ ফুঁসে উঠেছে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। ছাত্রদের বিক্ষোভ শুরু জুলাইয়ের প্রথম তারিখ থেকেই, ছাত্রলীগের হামলায় তা চূড়ান্ত পরিণতির দিকে যাত্রা শুরু করে ১৫ জুলাই। আন্দোলনের দারুণ সময়েও নারী ও শিশু নির্যাতন কিন্তু থেমে থাকেনি। বরং পুলিশ রাস্তায় ব্যস্ত থাকায় নির্যাতিতরা থানা পুলিশের কাছে যে ছুটে গিয়ে অন্তত নালিশটা করবে, সে সুযোগে ঘাটতি পড়েছে। দুর্বৃত্তরা তাদের কাজে নিরুৎসাহ হয়নি। সব খবর পত্রিকায় আসে না, তবু মহিলা পরিষদ ১৬টি পত্রিকার খবর সংকলিত করে যা জানিয়েছে, তাতে পুরনো বাস্তবতার যে ইতরবিশেষ ঘটেছে, সেটি মোটেই প্রমাণিত হয় না। মহিলা পরিষদের হিসাবে জুলাই মাসে ২৫৫ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে, নির্যাতিত শিশুদের মধ্যে ১২৪ জনই মেয়েশিশু। দুর্বৃত্তদের পাশবিক তৎপরতায় শিশুরা নিরাপদে ছিল না। এখনো নেই; পুলিশের হাতেও শিশুরা নিরাপদ নয়। আন্দোলনের সময়েই পুলিশের গুলিতে ৬৫ জন শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছিল, পরে নিশ্চয়ই সংখ্যাটি বেড়েছে। আর সমাজেও যে শিশুরা, বিশেষভাবে মেয়েশিশুরা বিপদের মধ্যে বসবাস করে, সেই বাস্তবতা আন্দোলনের সময়ে বদলায়নি, পরেও যে বদলাবে এমন ভরসা করা কঠিন। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ থেকে যে খবর পাওয়া গেছে, সেটি তো আরো ভয়াবহ। জুলাই মাসে তারা ১১ ধরনের নারী ও শিশু নির্যাতনের যে </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কল</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> পেয়েছে, তার সংখ্যা দুই হাজার ৩৭২। বিপন্নরা কল দিয়েছে, কিন্তু তেমন সহায়তা পায়নি; কারণ নাকি থানায় পুলিশের সংখ্যাল্পতা। ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস ১০৯-এর তথ্য অনুযায়ী এ বছরের জানুয়ারি মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">কল</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> পাওয়া গেছে ৭৪ হাজার, কিন্তু জুলাই মাসে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৮২ হাজারে। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থকরণের ঘটনাও ঘটেছে। অনেক পরিবার তাই মেয়েদের বাড়ি থেকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছে।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><img alt="পুরনো বাস্তবতার নানা প্রকাশ দেখতে পাচ্ছি " height="439" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/09.September/21-09-2024/0.jpg" style="float:left" width="500" />গত ২৯ আগস্ট খবর পাওয়া গেল যে হাতিরঝিলে ভাসছিল একটি মেয়ের লাশ। মেয়েটি বিবাহিতা। একটি বেসরকারি টেলিভিশনে নিউজ ডেস্কে কাজ করত। কাজ সেরে মধ্যরাতে বাসায় ফেরার পথে হাতিরঝিলে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। বিয়ে করেছিল পরিবারের অসম্মতিতে অর্থাৎ ভালোবাসার কারণে। কিন্তু নিশ্চয়ই সুখে ছিল না। অবশ্যই হতাশায় জর্জরিত ছিল। মৃত্যুর আগে ফেসবুকে সে লিখেছে, </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">জীবন্মৃত থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালো।</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> এমন কথা আরো বহু মানুষের বুকের ভেতর যে অনবরত আঁকুপাঁকু করছে, তাতে সন্দেহ নেই। এবং সেটি হচ্ছে অপরিবর্তিত সমাজ বাস্তবতারই একাংশ। নারী ও শিশু নির্যাতন এবং হতাশ মানুষের আত্মহত্যা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়, তারা একই সূত্রে গাঁথা। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এর মধ্যেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে দুইবার বহিরাগতদের হামলার ঘটনা ঘটেছে; একটিতে একজন ছাত্রের মৃত্যুকে ঘিরে একজন চিকিৎসক অপমানিত ও প্রহৃত হন, অপরটিতে ঢাকার এক মহল্লায় দুই পক্ষের সশস্ত্র সংঘর্ষে এক পক্ষের একজন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে অপর পক্ষ চাপাতি হাতে ইমার্জেন্সিতে এসে আহত পক্ষের ওপর চড়াও হয়। চিকিৎসকদের বক্তব্য, তাঁরাও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছিলেন, কিন্তু এখন হামলার শিকার হচ্ছেন। এর প্রতিবাদে পরের দিন দেশের সব সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা একযোগে দিনভর কর্মবিরতি পালন করেছেন। পরে কর্মবিরতি স্থগিত করে তাঁরা ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছেন চার দফা দাবি বাস্তবায়নের জন্য। সমাজে পেশাগত যত সম্পর্ক আছে, তাদের মধ্যে সবচেয়ে মানবিক হওয়ার কথা চিকিৎসক ও রোগীর সম্পর্ক; সেটিতে যখন ভাঙন দেখা দেয়, তখন বঝুতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে মনুষ্যত্বই বিপদাপন্ন হয়েছে। মনুষ্যত্ব বিনষ্টকারী পুঁজিবাদী বাস্তবতাটি ভাঙতে হলে সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজন; এই সত্যটি আমরা যেন না ভুলি। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এরই মধ্যে তো চারদিকে দেখা দিয়েছে নতুন এক আন্দোলনের তরঙ্গপ্রবাহ। সেটি দাবিদাওয়া আদায়ের জন্য নানা ধরনের বিক্ষোভ, প্রতিবাদ সমাবেশ এবং ঘেরাও। দাবিগুলো চাপা ছিল, প্রকাশের পথ পেয়ে মুখর হয়ে উঠেছে। এবং প্রতিটি দাবির ভেতরেই রয়েছে বৈষম্যের খবর। পেডাল চালানো রিকশাওয়ালারা মিছিল করেছেন ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকদের বিরুদ্ধে। দুই পক্ষই বঞ্চিত, কিন্তু এক পক্ষ নিজেদের অধিকতর বঞ্চিত মনে করে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সুপারিশে নিয়োগপ্রাপ্ত নন-ক্যাডার চাকরিজীবীরা সমাজের অন্যান্য অংশের চেয়ে খুব খারাপ অবস্থায় যে আছেন তা নয়, কিন্তু তাঁরাও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন ক্যাডার সার্ভিসে নিযুক্তদের তুলনায় নিজেদের বঞ্চিত জ্ঞান করে; ৪৩তম বিসিএস নন-ক্যাডাররা সম্প্রতি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের দপ্তরে গিয়ে ভাঙচুর করেছেন, তালা লাগিয়ে দিয়েছেন বিভিন্ন কক্ষে এবং চেয়ারম্যান ও সদস্যদের পদত্যাগ দাবি করেছেন। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আনসার বাহিনী অনেক জরুরি কাজ করে, নির্বাচনের সময় তো বটেই, অন্য সময়েও; কিন্তু তাদের নিয়োগ নিয়মিত নয়, চুক্তিভিত্তিক। তিন বছর পর পর ছয় মাস চাকরি থাকে না। আনসার সদস্যরা অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের মতোই নিয়মিত হতে চান; নিয়মিত হলে চাকরির নিশ্চয়তা বাড়বে, উৎসব ভাতা, পেনশন ইত্যাদির প্রত্যাশা করতে পারবেন। বিভিন্ন সময়ে তাঁরা দাবি জানিয়েছেন, কিন্তু তাঁদের নিয়মিত করা হয়নি। ওই বৈষম্যের বিরুদ্ধে ১৯৯৪-তে তাঁরা বড় রকমের এক আন্দোলন করেন। সেই </span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বিদ্রোহ</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> দমনে মর্টার ও মেশিনগান ব্যবহার করা হয়। ৩০ বছর পার হয়েছে, কিন্তু বৈষম্যের নিরসন ঘটেনি। এবারের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অনুকূল আবহাওয়ায় তাঁরা সচিবালয়ের সম্মুখে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নেন। মনে হচ্ছিল, তাঁদের ন্যায্য দাবিগুলো মেনে নেওয়া হবে, কিন্তু ভয়ের সংস্কৃতির পাশাপাশি সন্ত্রাসের যে সংস্কৃতি দেশে গড়ে উঠেছে, তার প্রকাশ দেখা গেল এখানেও। শেষ পর্যন্ত সংঘর্ষ বাধল এবং সেটি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রদের সঙ্গেই। এটিও যে বাস্তবতার একটি অংশ, তা অস্বীকার করি কী করে। ১৯৯৪-তে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল দুই হাজার ৫০০ আনসার সদস্যকে; এবার অবশ্য অত নয়, গ্রেপ্তার হয়েছেন ৩৮৮ জন। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সমাজ বাস্তবতার প্রধান দিকগুলোর একটি হচ্ছে লুণ্ঠন। যাঁরা ধনী হয়েছেন, তাঁরা প্রায় সবাই লুটপাটের সঙ্গে জড়িত এবং ওই কাজে দক্ষ। বৈধ লুটপাটেরও ব্যবস্থা আছে। সিন্ডিকেট রয়েছে। থাকবেও। সরকার পতনের পর এখানে-সেখানে লুটপাটের নানা মাত্রার ঘটনা ঘটেছে। গণভবন থেকে জিনিসপত্র যেভাবে লুণ্ঠিত হয়েছে, তাকে তো মনে হয়েছে রীতিমতো একটি উৎসব। বিপ্লবকে বলা হয় শোষিত মানুষের উৎসব, কিন্তু সেটি তো লুণ্ঠনের নয়, সৃষ্টির। গণভবনে বসবাসকারীরাও অবশ্য ওই একই কাজ করেছেন ১৫-১৬ বছর ধরে। তাঁদের লুণ্ঠন ছিল অনেক ব্যাপক, সুশৃঙ্খল ও গুপ্ত। কিন্তু লুণ্ঠন যে কোনো অপরাধ নয়, বরং গর্ব ও গৌরবের বিষয়, এই শিক্ষাটি তাঁরাই রেখে গেছেন শাসিত মানুষের জন্য। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ওই শিক্ষায় শিক্ষিত, বলা যায় ওই ধর্মে দীক্ষিত, মানুষ সুযোগ পেলেই লুটপাট করে। হাত নিশপিশ করতে থাকে। ধরা যাক নারায়ণগঞ্জের গাজী টায়ারসে লুণ্ঠনের ঘটনা। গাজী টায়ারসের মালিক মন্ত্রী ছিলেন; ভূমি জবরদখলের অভিযোগ নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু তবু কয়েকটি শিল্প-কারখানাও গড়েছিলেন, কর্মসংস্থান করেছিলেন কিছু মানুষের। ৫ আগস্ট সরকারের পতন ঘটেছে শুনে কারখানায় প্রথম দফা লুটপাট ঘটে। পরে কারখানার মালিক গ্রেপ্তার হয়েছেন শুনে মানুষ আর বাধা মানেনি। বন্যার স্রোতের মতো কারখানার ভবনগুলোতে ঢুকে পড়েছে। যে যা পেয়েছে লুণ্ঠন করেছে। ভ্যান গাড়ি, রিকশা, যা পাওয়া যায় ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে একদল আবার মূল ভবনের নিচতলায় আগুন ধরিয়ে দেয়। কারণ হতে পারে লুটপাটের ব্যাপারে তাদের নিজেদের কাজ ততক্ষণে শেষ হয়েছে, এখন অন্যরা যেন তাদের কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয় তার ব্যবস্থা করা চাই। কারখানা ছিল দাহ্য পদার্থে ঠাসা। আগুন অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে ছয়তলা ভবনটির সর্বত্র। ভেতরের আটকা পড়া লোকজন অবরুদ্ধ অবস্থায়ই রয়ে গেছে। পুলিশের সাহায্য চেয়েও পাওয়া যায়নি। ফায়ার সার্ভিস এসেছে পৌনে তিন ঘণ্টা পরে। আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লেগেছে ২১ ঘণ্টা। তার পরও ভেতরে ঢুকতে সাহস করেননি ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। কারণ দগ্ধ হয়ে ভবনটি তপ্ত ও নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। মৃত্যু ঘটেছে কমপক্ষে ১৭৫ জনের।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়</span></span></span></span></p> <p> </p>