তবে যেভাবেই পরিচালিত হোক না কেন, শিশু-কিশোরদের এসব সংগঠনের বিরুদ্ধে কোনো অসামাজিক ক্রিয়াকলাপের অভিযোগ শোনা যেত না। সেই উনিশ শ পঞ্চাশের দশকে একজন কিশোরের বিচরণক্ষেত্র ছিল তার বাসগৃহ, বিদ্যালয় ও খেলার মাঠ। বাসগৃহে মা-বাবা, ভাই-বোন ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে কথাবার্তা, মান-অভিমান, দাবিদাওয়া—এই পর্যন্তই। এখনকার মতো টিভি, মোবাইল ইত্যাদির আবির্ভাবই হয়নি। ফলে স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফিরে এসে কিছু একটা মুখে দিয়েই সবাই ছুটত পাড়ার বন্ধুদের দঙ্গলে অথবা স্কুলের মাঠে। এই ছিল উনিশ শ পঞ্চাশের দশক বা তার আগের একটি কিশোরের জীবন। সেখানে পাড়ায় পাড়ায় যেসব সংগঠন গড়ে উঠত, সেগুলো হয়তো কোথাও একটি ক্লাব হিসেবে গড়ে উঠত পাড়ার বড়দের সাহায্য-সহযোগিতা ও নজরদারিতে। তবে বেশির ভাগ কিশোরের দলই ছিল পাড়ার অসংগঠিত মিলনক্ষেত্র। এটিই ছিল বর্তমান ‘গ্যাংয়ের’ আদিরূপ। তবে আবারও বলি, এদের কারো বিরুদ্ধে কোনো প্রকার চুরি-চামারি বা অন্য কোনো অসামাজিক কার্যকলাপের অভিযোগ শোনা যেত না।
তাহলে এই যে একটি নিরীহ, নিরুপদ্রব কৈশোরকাল, তা হঠাৎই এ রকম ষণ্ডা-গুণ্ডার রূপ ধারণ করল কেমন করে? এখন কেন তাদের নামের সঙ্গে ‘গ্যাং’ নামক একটি মাস্তানসূচক শব্দ যুক্ত হয়ে পড়েছে, কেন লোকে তাদের নাম শুনলে দু’আ-দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দেয়? সাম্প্রতিককালে পত্রপত্রিকায় তাদের কিছু কার্যকলাপের সংবাদ এমনভাবে এসেছে যে মনে হয়, অচিরেই তারা দেশের অপরাধজগতের নেতৃত্ব দেবে। সেদিন যেন আর বেশি দূরে নয়, যখন কোনো পাড়ায় তাদের ছায়া পড়েছে শুনলেই লোকে ঘরে খিল দিয়ে বসে ইষ্টনাম জপতে শুরু করবে।
প্রশ্ন হলো, কেন এমনটি হলো? এর কারণ অবশ্যই একটি-দুটি নয়, অনেকগুলো। সর্বাগ্রে যে বিষয়টি উল্লেখ করতে হয়, তা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে সর্বগ্রাসী বিবর্তন ঘটেছে, তার ছোঁয়া প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে আমাদের এই অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল স্বল্পোন্নত দেশেও লেগেছে। ১২-১৪ হাজার মাইল দূরের ইউরোপ-আমেরিকা বা জাপানে যা ঘটে তার সংবাদ এক লহমায় বাংলাদেশে পৌঁছে যায় আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে। সে সংবাদ যে শুধু বিমল সন্তোষদায়ক কিছু, তা তো সব সময় নয়। এগুলো যেমন মানবকল্যাণধর্মী বিষয়ের কথা জানান দেয়, তেমনি খুনখারাবি, ব্যাংক ডাকাতি, লুটতরাজ, ছিনতাই ইত্যাদির রোমহর্ষক বিবরণও পরিবেশন করে। আর এসব কিছুর মধ্যে ভালো হোক, মন্দ হোক, একটি অ্যাডভেঞ্চারের গন্ধ থাকে, যা একটি ১০-১২ বছরের কিশোরের মনে দারুণ পুলক জাগায়। এ ছাড়া আছে ছায়াছবি, যা টিভির কল্যাণে ঘরে বসে ২৪ ঘণ্টাই দেখা যায়। একজন নবীন দর্শক মনে করে, ছায়াছবি, টিভি সিরিয়াল বা কোনো সত্য ঘটনার নায়ক যদি অবলীলাক্রমে একটি মেয়ের হাতব্যাগ বা গলার চেইন বাজপাখির মতো চোখের পলকে হাপিশ করে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে, তাহলে আমি পারব না কেন? আচ্ছা, একা যদি না পারি, তাহলে আমার দোস্ত যদু-মধু-কদুদের সঙ্গে নিলেই তো পারি। এভাবেই গঠিত হয় হাল আমলের কিশোর গ্যাং, সোজা কথায় উঠতি ডাকাতের দল। এরা এভাবে কচু-ঘেচু কাটতে কাটতে একদিন মানুষের গলা কাটতেও পারঙ্গম হয়ে ওঠে।
এ তো গেল গণমাধ্যম, বিশেষ করে টিভি, ফেসবুক ইত্যাদির ভূমিকা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে শিশু-কিশোরদের অবসর বিনোদনের উপকরণের অভাব। স্বাধীনতার আগে সাত কোটি-সাড়ে সাত কোটি মানুষের দেশে প্রতিটি শহরে-নগরে শিশু-কিশোরদের জন্য খেলাধুলার মাঠ, পার্ক ইত্যাদি কয়টি ছিল আর এখন কয়টি আছে? আগে বিকেলবেলা ছেলেরা ছুটত খেলার মাঠে, আর এখন? এখন মাঠ নেই, আছে দুষ্টবুদ্ধি চর্চার গোপন-সেমি গোপন কেন্দ্র, যেখানে বসে নির্বিবাদে চলে সব ধরনের অপকর্মের প্রস্তুতি। আর পাঠাগার? এগুলো তো এখন প্রাগৈতিহাসিক যুগের নিদর্শন হতে চলেছে। অতএব পাড়ায় পাড়ায় কিশোর গ্যাং খেতাবধারী সংগঠনের প্রাদুর্ভাব আর যা-ই হোক, অস্বাভাবিক নয়।
পঞ্চাশ-ষাটের দশকে দেশের প্রায় সব জেলা শহরে (কোথাও কোথাও মহকুমা শহরেও) মুকুল ফৌজ, খেলাঘর ইত্যাদি কিশোর সংগঠনের শাখা ছিল। আর ছিল সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় স্কুল-কলেজে স্কাউট/কাবস ট্রুপ। শিশু-কিশোরদের আনন্দ-বিনোদন ও খেলাধুলার উপকরণ সংকটের দিনে এসব সংগঠনকে এখন পুনর্জীবিত করা বোধ হয় সময়ের দাবি।
আরেকটি বিষয় আজকাল আলোচনায় আসে না বললেই চলে। শিশু-কিশোরদের চরিত্র গঠনের জন্য ধর্মীয় শিক্ষার বিকল্প নেই, এ কথা অনস্বীকার্য। পাড়ার মক্তব-মসজিদ-মাদরাসা এবং মন্দির-গির্জা-প্যাগোডায় শিশুদের জন্য সীমিত আকারে হলেও ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলে শৈশব থেকেই তা শিশু-কিশোরদের নৈতিক চরিত্র গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
সব শেষে সেই পুরনো কথাটিই স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, যা বহু যুগ আগে বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কবি গোলাম মোস্তফা তার অমর লেখনীর মাধ্যমে বলে গেছেন : আমরা নূতন, আমরা কুঁড়ি, নিখিল বন-নন্দনে/ওষ্ঠে রাঙা হাসির রেখা, জীবন জাগে স্পন্দনে। লক্ষ আশা অন্তরে/ঘুমিয়ে আছে মন্তরে/ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে/...
হে কিশোর, তোমার ওষ্ঠের ওই রাঙা হাসিটুকুই আমাদের অর্থাৎ বুড়োদের, সব দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা লাঘব করে দিতে পারে, তোমার কিশোর গ্যাংয়ের করাল ভ্রুকুটিরেখা নয়। ওই রাঙা হাসিটুকুই সূর্যোদয়ের মতো জাগাবে সারা জাতিকে, সারা বিশ্বকে, কোনো গ্যাংয়ের দস্যিপনা নয়। বিশ্বাস করো, এতটুকু বাড়িয়ে বলছি না।
সবাইকে খ্রিষ্টীয় নববর্ষের শুভেচ্ছা।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি
mkarim06@yahoo.com