<p>গতকাল কালের কণ্ঠে দেশের ব্যবসায়ীদের উদ্বেগের বিষয় নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, যা রীতিমতো হতাশাজনক। উল্লিখিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে দেড় শতাধিক কম্পানি ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৮৩টি কম্পানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই হয়তো বলার চেষ্টা করবেন যে কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হয়ে থাকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে একের পর এক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে অথবা বন্ধ হওয়ার প্রক্রিয়ায় আছে, তা যে একেবারেই স্বাভাবিক নয়, তা এই প্রতিবেদন থেকেই জানা গেছে। কারণ বিগত অর্থবছরে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সংখ্যা ছিল ২৭৫টি, সেখানে মাত্র গত তিন মাসের মধ্যে বন্ধ হয়েছে দেড় শর বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায় যে কিছু বড় ব্যবসায়ী পরিবারের সদস্যদের ব্যাংক হিসাব জব্দের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একটি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার স্বার্থে এসব খবর মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়, বরং বলা চলে যথেষ্ট হতাশাজনক।</p> <p>বিগত সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের দুই মাস অতিবাহিত হলেও দেশের অনেক কিছুই এখনো স্বাভাবিক হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই বেশ অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সব কিছু পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে বেশ সময় লাগবে। কিন্তু যে খাতে অতিদ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে, সেটি হচ্ছে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। কেননা এই খাতের স্বাভাবিক অবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার বিষয়টি। এ কারণেই অতীতে বেশ কয়েকবার সরকার পরিবর্তন হলেও ব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পেরেছেন। হাতে গোনা দু-একজন ব্যবসায়ীর সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে সাময়িক কিছু অসুবিধা হলেও সব ব্যবসায়ীর মধ্যে সেভাবে আতঙ্ক দেখা যায়নি। ব্যবসায়ীদের সংগঠনের নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ব্যাবসায়িক কর্মকাণ্ড চলেছে নির্বিঘ্নে। এবারও তার কোনো ব্যতিক্রম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে কেন যেন ভিন্ন চিত্রই পরিলক্ষিত হচ্ছে।</p> <p>এ কথা ঠিক যে অতীতের তুলনায় এখন ব্যবসায়ীরা অধিক সংখ্যায় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। এই প্রবণতা যে শুধু আমাদের দেশেই দেখা যায় তেমন নয়, বরং সারা বিশ্বেই একই রকম অবস্থা বিরাজ করছে। ব্যবসা পরিচালনা করতে একদিকে যেমন নানা রকম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়, তেমনি অনেক সুযোগ-সুবিধাও নিতে হয়। এসব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং সুযোগ-সুবিধার বিষয়গুলো আসে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থেকে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে। আর এ কারণেই ব্যবসায়ীরা এখন অধিক সংখ্যায় রাজনীতির সঙ্গে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু এই সম্পৃক্ততার কারণে যদি ব্যবসায়ীদের ঢালাওভাবে অভিযুক্ত করা হয় তাহলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে। অবশ্য যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অপরাধের অভিযোগ আছে, তাদের কথা ভিন্ন। অপরাধ করে থাকলে তাদের বিচার হতেই পারে। কিন্তু দেশের ব্যাবসায়িক কার্যক্রমে যাতে বিঘ্ন না ঘটে সেদিকে সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে।</p> <p><img alt="ব্যবসায়ীদের আতঙ্কগ্রস্ত করার সুযোগ নেই" height="280" src="https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/10.October/09-10-2024/1.jpg" style="float:left" width="321" />ব্যবসায়ীরা দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। একজন ব্যবসায়ী একাধারে বিনিয়োগকারী, ঝুঁকি গ্রহণকারী, কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী এবং সর্বোপরি দেশের দ্রব্য ও সেবা সরবরাহকারী। এ কারণেই দেশের ব্যবসায়ীরা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে দেখা যায় বিনিয়োগে স্থবিরতা নেমে আসে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় না, এমনকি বেকারত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে দেশের অর্থনীতিতে নানামুখী সমস্যার সৃষ্টি হয়ে থাকে। তা ছাড়া ব্যবসা এমন এক ধরনের কার্যক্রম, যার পারিপার্শ্বিক প্রভাব (ডেমোনেসস্ট্রেটিভ ইফেক্ট) অনেক বেশি। অর্থাৎ যখন ব্যাবসায়িক খাতে ভালো বা সহায়ক অবস্থা বিরাজ করে তখন নতুন বিনিয়োগ আসে। কারণ অনেকেই তখন বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হন। ঠিক এর বিপরীত অবস্থার সৃষ্টি হয় যখন ব্যবসা ক্ষেত্রে হতাশা বা আতঙ্ক বিরাজ করে। অর্থাৎ যখন ব্যবসায়ীদের মাঝে হতাশা বা আতঙ্ক বিরাজ করে এবং এ কারণে অনেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়, তখন নতুন ব্যবসার আগমন তো হয়-ই না, উল্টো ভালো অবস্থানে থাকা অনেক ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।</p> <p>এসব কারণে কোনো পরিবর্তনের পর যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন, দেশের ব্যাবসায়িক কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। এই প্র্যাকটিস বিশ্বের সর্বত্রই অনুসৃত হয়। আমেরিকার সবচেয়ে বড় ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ইলন মাস্ক সরাসরি ট্রাম্পের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং ক্রমাগত ডেমোক্র্যাটের সমালোচনা করে চলেছেন। এমনকি মাস্ক এক পর্যায় ট্রাম্পের প্রচারণা তহবিলে পর্যাপ্ত অনুদান প্রদানের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। কিন্ত আমেরিকার বর্তমান বাইডেন সরকার ইলন মাস্কের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপের কথা কল্পনাও করতে পারে না। শুধু তা-ই নয়, আমেরিকার গত নির্বাচনে প্রভাবিত করার অভিযোগ উঠেছিল ফেসবুকের বিরুদ্ধে। এর বড় অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও নামমাত্র কংগ্রেসের শুনানি ব্যতীত কোনো রকম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি ফেসবুকের বিরুদ্ধে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের ব্যবসায়ীদেরও একই অবস্থা। সেখানে বৃহৎ ব্যবসায়ীরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও এমন সিদ্ধান্ত কখনো নেওয়া হয় না, যাতে সেখানকার ব্যাবসায়িক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হতে পারে। একই অবস্থা আমাদের দেশেও অতীতে বিরাজ করেছে।</p> <p>অনেক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের দেশে বেশ কিছু বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে এবং এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ সুনামও কুড়িয়েছে। কোনো কারণে যদি এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে দেশের অর্থনীতিতে যে মাপের ক্ষতি হবে তা আগামী কয়েক দশকেও পূরণ হবে না। অন্যান্য পেশার মতো উদ্যোক্তাও এমন এক পেশা, যা দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তুলতে হয়। শুধু অর্থ থাকলেই উদ্যোক্তা হওয়া যায় না। এ জন্য প্রয়োজন অনেক সাধনা ও অঙ্গীকার। কেউ যদি মনে করেন যে একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আরো অনেক নতুন গ্রুপ দাঁড়িয়ে যাবে। বিষয়টি মোটেই এত সহজ নয়।</p> <p>দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে যদি হতাশা ও আতঙ্ক বিরাজ করে, তাহলে যে শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমন নয়, বিদেশি বিনিয়োগও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সম্প্রতি আমেরিকার ওষুধ প্রস্তুতকারী কম্পানির এক পরিচালকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। এই ওষুধ কম্পানির ভালো বিনিয়োগ আছে বাংলাদেশে। সাম্প্রতিক অবস্থার কারণে তাঁকে বেশি উদ্বিগ্ন হতে দেখেছি। বাস্তবতা হচ্ছে যেকোনো পদক্ষেপের কারণে যদি দেশের ব্যবসায়ীদের মাঝে হতাশা বা আতঙ্ক বিরাজ করে, তাহলে দেখা যাবে দেশে আশঙ্কাজনকভাবে বিনিয়োগ হ্রাস পাবে। ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাবে, দেশের সরবরাহব্যবস্থায় সংকট তৈরি হবে এবং সেই সঙ্গে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। সার্বিকভাবে দেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে। </p> <p>এই বিষয়গুলো আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যেহেতু বোঝে, তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যে বুঝবে না, তেমন নয়। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ, যিনি দেশের ও বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি-প্রকৃতি অন্য যে কারো চেয়ে অনেক বেশি ভালো বোঝেন। তদুপরি অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর দুজনেই প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ, যাঁরা ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে অনেক বেশি ভালো জানেন এবং তাঁরা অনেক বিষয় নিয়ে অতীতে বিভিন্ন ফোরামে কথা বলেছেন এবং লিখেছেনও অনেক। তাই তাঁরা ব্যবসায়ীদের বর্তমান হতাশা এবং অসহায়ত্বের বিষয়টি বুঝবেন এবং এমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেবেন না, যাতে দেশের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং ব্যবসা গুটিয়ে নেন। একটি বিষয় সবাইকে মনে রাখতে হবে যে আমরা এখন গ্লোবাল ভিলেজে বাস করি। ব্যবসায়ীদের সাদরে গ্রহণ করার জন্য অনেক দেশ উদগ্রীব হয়ে বসে আছে। যেমন— ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে উরুগুয়ে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে চলেছে। তাই এমন কোনো অবস্থার সৃষ্টি করা ঠিক হবে না যে দেশের ব্যবসায়ীরা অন্যত্র ব্যবসা স্থাপনের চিন্তা করতে পারে। </p> <p>মানুষ মাত্রই ভুলত্রুটি থাকে। দেশের ব্যবসায়ীরাও মানুষ, তাই তাদেরও ভুলত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। এসব ভুলত্রুটি শুধরে স্বাভাবিক ব্যাবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে সেই ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে দেশের অর্থনীতি লাভবান হবে। সেই সঙ্গে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও যেমন লাভবান হবে, তেমনি আগামীতে নির্বাচনের মাধ্যমে যাঁরা ক্ষমতায় আসবেন, তাঁদের জন্যও কাজটি সহজ হবে। তাই অন্তর্বর্তী সরকার এবং দেশের রাজনৈতিক দলের উচিত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করে তাদের আশ্বস্ত করা এবং তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করা, যাতে তাঁরা তাঁদের ব্যাবসায়িক কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারেন। তা না হলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং অর্থনীতির এমন ক্ষতি হবে, যার খেসারত শুধু যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে দিতে হবে তেমন নয়, আগামীতে যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসবেন তাঁদেরকেও দিতে হবে। যার আলামত এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে। লেখার প্রারম্ভে যে প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করেছি সেখানে যে দেড় শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান মাত্র দুই মাসের মধ্যে বন্ধ করার সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ আছে, তা মূলত দেশের ব্যাবসায়িক খাতে বিরাজমান হতাশা বা আতঙ্কেরই পরিণতি। শুধু তা-ই নয়, বন্ধ হয়ে যাওয়ার তালিকায় বেশ কয়েকটি বৃহৎ প্রতিষ্ঠান যেমন আছে, তেমনি অসংখ্য সাধারণ মানের ব্যবসাও আছে, যা মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। তাই বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে এমন পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে, যেসব পদক্ষেপের কারণে দেশের ব্যবসায়ীরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়। কেননা ব্যবসায়ীদের আতঙ্কগ্রস্ত করার কোনো সুযোগ নেই।</p> <p>লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা</p> <p>nironjankumar_roy@yahoo.com</p> <p> </p> <p> </p>