<p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে সমস্যা এবং সংকট নতুন কিছু নয়। ব্যাংকিং কার্যক্রমের ধরনই এমন। ব্যাংক মূলত অর্থ নিয়ে ব্যবসা করে। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় যে ব্যাংক আমানত সংগ্রহের নামে একজনের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে, সেই অর্থ ঋণ প্রদানের নামে আরেকজনকে ধার দেওয়ার কাজে নিয়োজিত। অর্থ যেখানে ব্যবসার মূল উপাদান, সেখানে ঝামেলা হবেই। যেখানেই ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত হয়, সেখানেই সমস্যা এবং সংকট থাকে। উন্নত বিশ্বের মানসম্পন্ন ব্যাংকিং বা উন্নয়নশীল দেশের অপেক্ষাকৃত দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থা</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">সর্বত্রই সংকট ও সমস্যা আছে এবং থাকবে। পার্থক্য হচ্ছে, উন্নত বিশ্বের সমস্যার মাত্রা এবং ভয়াবহতা অনেক কম, পক্ষান্তরে উন্নয়নশীল বিশ্বের ব্যাংকিং খাতে সমস্যা ও সংকটের মাত্রা এবং ভয়াবহতা অনেক বেশি। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বলার অপেক্ষা রাখে না যে আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে সমস্যার ভয়াবহতা মাত্রাতিরিক্ত। এর অনেক কারণও আছে। দীর্ঘ ৫০ বছরে ব্যাংকিং খাতের অগ্রযাত্রায় অনেক সমস্যা বিভিন্ন সময়ে দেখা দিলেও সন্তোষজনক সমাধানের উদ্যোগ না নিয়ে কোনো রকমে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে সমস্যার জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেই সঙ্গে ক্রমাগত নতুন সমস্যা এসে হাজির হয়েছে। এর পাশাপাশি অনেক অনিয়ম যেমন হয়েছে, তেমনি একেকটি অনিয়ম আগের সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। পক্ষান্তরে ক্রমাগত নতুন নতুন ব্যাংক চালুর মাধ্যমে ব্যাংকের সংখ্যা অহেতুক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মানসম্পন্ন নিয়ন্ত্রণ, তদারকি এবং জবাবদিহির ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে ব্যাংকের সংখ্যা বাড়িয়ে দিলে অবস্থা খারাপ ছাড়া ভালো হয় না। এসব কারণে আজকের ব্যাংকিং খাতের যে সমস্যা ও সংকট, তা মূলত বিগত পাঁচ দশকের পুঞ্জীভূত সমস্যার বহিঃপ্রকাশ।</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"><img alt="ব্যাংকিং খাতে আস্থার সংকট কাটানো জরুরি" height="292" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/12 December/19-12-2024/4.jpg" style="float:left" width="373" />আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতে বিরাজমান সমস্যা ও সংকটের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সুশাসনের অভাব, মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ এবং ঋণ জালিয়াতি। এসব সমস্যার সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে না পারার সমস্যা। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ব্যাংক চরম তারল্য সংকটে পড়ে তাদের গ্রাহকদের চাহিদা মোতাবেক অর্থ প্রদান করতে পারছে না। এর ফলে ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে এবং অনেকে আর্থিক কষ্টেও আছে। দেশের ব্যাংকিং খাতে এই সংকট এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে, যা আগে কখনোই ঘটেনি। দেশের অনেক ব্যাংকের বিরুদ্ধেই মারাত্মক সব অভিযোগ আছে। এমনকি ব্যাংকের টাকা লুট হয়ে যাওয়া বা ব্যাংকের ভল্ট খালি হয়ে যাওয়ার মতো মারাত্মক সব অভিযোগ থাকলেও কোনো ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের চাহিদা মোতাবেক অর্থ ফেরত দিতে পারেনি এমন কথা শোনা যায়নি। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">হঠাৎ করেই কী এমন হলো যে অনেক ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের অর্থ চাহিদামাফিক ফেরত দিতে পারছে না। যে ব্যাংক এক মাস আগেও দিব্যি গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিয়েছে, এখন কেন সেই ব্যাংক পারবে না? সবচেয়ে অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে কেন এমন সংকটময় অবস্থার সৃষ্টি হলো, তার সঠিক ব্যাখ্যাও আমরা দেখছি না। শুধুই বলা হচ্ছে যে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার কারণেই এ রকম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কথার সত্যতা নিশ্চয়ই আছে। দেশ থেকে যে টাকা পাচার হয়েছে, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। যারা এই অর্থ পাচার করেছেন, তাদের চিহ্নিত করতে হবে এবং বিচারও করতে হবে। সেই সঙ্গে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগও নিতে হবে। আমরা যতটুকু জানি, তাতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার, বিশেষ করে অর্থ উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এ ব্যাপারে যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে অনেক দূর এগিয়েও গেছেন। আমাদের বিশ্বাস, শিগগিরই পাচার হওয়া অর্থের বড় একটি অংশ দেশে ফিরে আসবে এবং তখন আর দেশের ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট থাকবে না। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এই অর্থপাচারের অভিযোগের সঙ্গে দেশের ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকট তথা গ্রাহকদের অর্থ প্রদান করতে না পারার বিষয়টি কোনোভাবেই মেলাতে পারছি না। দেশ থেকে অর্থ পাচার হওয়ার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের একটি যোগসূত্র থাকতে পারে এবং থাকেও। দেশ থেকে অর্থপাচারের সঙ্গে দেশের স্থানীয় মুদ্রার তারল্য সংকট কেন দেখা দেবে, যেখানে আমাদের দেশের মুদ্রা টাকার আন্তর্জাতিক লেনদেনে কোনো রকম গ্রহণযোগ্যতা নেই। টাকা দিয়ে দেশের বাইরে কোনো রকম লেনদেন করা যায় না। এমন অবস্থায় টাকা দেশের বাইরে চলে যাওয়ার কোনো রকম সুযোগ নেই। টাকা পাচার করতে হলে প্রথমে সেই টাকা দিয়ে ডলার বা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অন্য কোনো মুদ্রা ক্রয় করে দেশের বাইরে নিতে হবে। ফলে যে পরিমাণ টাকাই পাচার করা হোক না কেন, তা দেশের অভ্যন্তরের মানি সার্কুলেশনেই থাকবে। দেশের বাইরে যাবে সেই টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বিষয়টি একটু জটিল বিধায় একটি কাল্পনিক উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ধরা যাক, দেশের আর্থিক লেনদেন নিষ্পত্তি এবং প্রয়োজনীয় তারল্য নিশ্চিত করার জন্য অর্থনীতিতে ৮০ হাজার কোটি টাকা সার্কুলেশনে আছে। এর মধ্য থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা বাক্সবন্দি করে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এই পাচার হওয়া ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি পয়সা দিয়েও বিদেশে কোনো রকম লেনদেন করা সম্ভব হবে না। এমন অবস্থায় পাচারকারী এই ৩০ হাজার কোটি টাকা একজন হুন্ডি ব্যবসায়ীর কাছে দিয়ে সমপরিমাণ ডলার, ক্রিপ্টো বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংগ্রহ করে বিদেশে লেনদেন করতে সক্ষম হবেন। সেই হুন্ডি ব্যবসায়ী অন্য কোনো অবৈধ লেনদেন সম্পাদনের উদ্দেশ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশে নিয়ে আসবেন। এর ফলে মুদ্রাব্যবস্থায় অর্থ সার্কুলেশন সেই ৮০ হাজার কোটি টাকাই থাকবে। বিদেশে অর্থপাচারের এই চক্রাকার অবস্থার কারণেই দেশের সার্কুলেশনে স্থানীয় মুদ্রার মোট সরবরাহে খুব বেশি তারতম্য হয় না। তবে দেশের মুদ্রার যদি আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা থাকে; যেমন</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">ডলার, পাউন্ড স্টার্লিং, ইউরো প্রভৃতি সে ক্ষেত্রে ভিন্ন কথা। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">বিদেশে অর্থপাচারের কারণে যদি দেশের স্থানীয় মুদ্রার তারল্য সংকট দেখা না দেয়, তাহলে অনেক ব্যাংক আর্থিক সংকটে পড়বে কেন এবং সেসব ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের চাহিদা মোতাবেক অর্থ ফেরতই বা দিতে পারবে না কেন? এর পেছনে আরো অন্য কারণ আছে। প্রথমত, এখন দেশের ব্যাংকিং খাতে চরম আস্থার সংকট বিরাজ করছে। দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নরের কিছু মন্তব্য; যেমন</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">—‘</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">১১টি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাবে, বন্ধ হয়ে যাবে</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">’</span></span><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi"> প্রভৃতি কথাবার্তা এই আস্থার সংকট অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে, যদিও পরবর্তী সময়ে গভর্নর ও অর্থ উপদেষ্টা জোর দিয়ে বলেছেন যে একটি ব্যাংকও বন্ধ হতে দেবেন না। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। দ্বিতীয়ত, অর্থ সার্কুলেশন প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটেছে। সাধারণত এক ব্যাংক থেকে অর্থ উত্তোলন করা হলে, তা সেই ব্যাংকেই ফিরে আসে বা অন্য কোনো ব্যাংকে জমা হয় এবং সেখানে উদ্বৃত্ত তারল্য থাকে। তারল্যে ঘাটতি থাকা ব্যাংক তারল্যে উদ্বৃত্তে থাকা ব্যাংক থেকে অর্থ ধার নিয়ে গ্রাহকদের চাহিদা মিটিয়ে থাকে। এখন যেহেতু এক ধরনের অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে, তাই অনেকেই সেই অর্থ তাত্ক্ষণিক ব্যাংকে জমা না দিয়ে ধরে রেখে পর্যবেক্ষণ করতে চাচ্ছেন যে অবস্থা কোন দিকে যায়। ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে প্রয়োজনের চেয়ে অনেক কম অর্থ থাকছে, যা দিয়ে গ্রাহকদের চাহিদা মোতাবেক অর্থ ফেরত দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না। তৃতীয়ত, দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে দুদক এবং ব্যাংক হিসাব জব্দ বা ফ্রিজ করার আতঙ্ক বিরাজ করছে। ফলে ব্যাংকে টাকা রাখার পর হিসাব ফ্রিজ হওয়ার ভয়ে অনেকেই টাকা ব্যাংকে না রেখে অন্যভাবে রাখার উদ্যোগ নিতে পারেন। এ রকম আরো কিছু সমস্যা আছে, যা দেশের ব্যাংকিং খাতের তারল্য সংকটে ভূমিকা রাখতে পারে।  </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">এসব সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে ব্যাংকিং খাতে মানুষের আস্থার সংকট। বিরাজমান অনেক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ব্যাংক টিকে থাকতে পারে যদি গ্রাহকদের আস্থা অটুট থাকে। মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ বা তারল্য সংকটের কারণে সাধারণত ব্যাংক বন্ধ হয় না। বিশ্বে যত ব্যাংক বন্ধ হয়েছে, তার বেশির ভাগই হয়েছে গ্রাহকদের আস্থার অভাবে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেখানে মোটেই তারল্য বা অর্থের সংকট ছিল না। সেখানে দেখা দিয়েছিল গ্রাহকদের আস্থার সংকট, যার কারণে গ্রাহকদের মধ্যে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে অর্থ উত্তোলনের হিড়িক পড়ে যায়। এ ধরনের প্যানিক উত্তোলনের চাপ কোনো ব্যাংকের পক্ষেই সামাল দেওয়া সম্ভব হয় না। তাই সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকও সেই প্যানিক উত্তোলনের চাপ সামাল দিতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে। এ কারণেই দেশের ব্যাংকিং খাতে যত সমস্যাই থাকুক না কেন, আস্থার সংকট তৈরি হতে দেওয়া যাবে না। যে আস্থার সংকট এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে, তা কাটানো অতি জরুরি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই আস্থার সংকট কাটানো যায় কিভাবে। এটি একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন আলোচনা, যার সুযোগ এখানে নেই। </span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:SolaimanLipi">লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা</span></span></span></span></p> <p><span style="font-size:11pt"><span style="font-family:"Calibri","sans-serif""><span style="font-size:14.0pt"><span style="font-family:"Times New Roman","serif"">nironjankumar_roy@yahoo.com</span></span></span></span></p>