<p>অর্থনীতির চাকা সচল রাখার মাধ্যমে দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধিতে ব্যবসায়ীদের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ক্রেতার চাহিদা ও প্রয়োজন অনুসারে পণ্য উৎপাদন, বিক্রি, বিপণন, সরবরাহ ও রপ্তানি ব্যবস্থার সঙ্গে ব্যবসায়ীরা সম্পৃক্ত। গ্রাম, গঞ্জ, শহরসহ দেশের সর্বত্র ছোট-বড় বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জনগণের সেবায় নিয়োজিত। নানা ধরনের ব্যবসায় নিয়োজিত বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এই সেবার মাধ্যমে তাদের নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করার পাশাপাশি অর্থনীতির চাকা সচল রাখে। এসব অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে এ দেশে বিশাল পরিসরে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এ ছাড়া ভ্যাট, ট্যাক্স ও অন্যান্য কর প্রদানের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অবদানও অনস্বীকার্য।</p> <p><img alt="উদ্যোক্তা তৈরিতে সামাজিক স্বীকৃতি প্রয়োজন" height="407" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/1. january/12-01-2025/Rif/12-01-2024-p4-2.jpg" style="float:left" width="350" />কিন্তু দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে এ দেশের ব্যবসায়ীরা নিজেদের সামাজিক মর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হননি। নিজেদের দৈনন্দিন ব্যাবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনায় অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হওয়ার কারণে সমাজে ব্যবসায়ীরা মর্যাদাপূর্ণ স্থান করে নিতে পারেননি। সামাজিকভাবে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মানহীন পণ্য উৎপাদন বা সরবরাহ, খাদ্যে ভেজাল, কৃত্রিমভাবে মূল্য নিয়ন্ত্রণসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ হরহামেশাই শোনা যায়।</p> <p>দেশের কত শতাংশ ব্যবসায়ী অনৈতিক পথে চলছেন তার কোনো জরিপ ও সঠিক পরিসংখ্যান নেই। একটি ব্যাবসায়িক গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের কোনো এক ব্যক্তি দুর্নীতি বা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়লে শুধু তাঁর কর্মকাণ্ড ঢালাওভাবে বেশি আলোচিত হয়; সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠানের ইতিবাচক অর্জনগুলো নানা অভিযোগের আড়ালে চাপা পড়ে যায়। এ ছাড়া আমাদের দেশে সামাজিকভাবে ভালো কাজের স্বীকৃতি প্রদানের সংস্কৃতি আনুপাতিক হারে কম। এর ফলে যাঁরা নৈতিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করে চলেছেন, ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন ও জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নে সহায়তা করছেন এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে প্রত্যক্ষ অবদানসহ দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু সামাজিক স্বীকৃতি না থাকলে দেশে নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে না। আর এ ধরনের পরিস্থিতি দীর্ঘ মেয়াদে দেশের অর্থনীতির জন্য মোটেও উৎসাহব্যঞ্জক নয়। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ব্যবসায়ীদেরই নিতে হবে।</p> <p> </p> <p><strong>ব্যবসায়ীদের কি সক্রিয় রাজনীতি পরিহার করা উচিত?</strong></p> <p><img alt="উদ্যোক্তা তৈরিতে সামাজিক স্বীকৃতি প্রয়োজন" height="426" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/1. january/12-01-2025/Rif/12-01-2024-p4-3.jpg" style="float:left" width="350" />ব্যবসায়ীদের বর্তমান সামাজিক অবস্থার মূলে তাঁরা নিজেরাই দায়ী। গত কয়েক দশকে এ দেশের রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। এখন ব্যবসায়ীদের ভেবে দেখার সময় এসেছে, রাজনীতির সঙ্গে তাঁদের সরাসরি জড়িত হওয়া সমাজ কিভাবে মূল্যায়ন করছে। এটা তাঁদের সামাজিক মান-মর্যাদা বৃদ্ধি করছে, নাকি রাষ্ট্র ও সমাজে তাঁদের অবস্থানকে উল্টো দিকে ধাবিত করছে। ব্যবসায়ীরা যখন নিজের রাজনৈতিক পরিচয় বা প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে কোনো অনিয়ম বা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের দায় থেকে রেহাই পেয়ে যান, তখন তা সমাজে এক ধরনের নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এটি শুধু এ দেশের ব্যবসায়ীদের সামাজিক মর্যাদাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং আন্তর্জাতিকভাবে দেশের ভাবমূর্তি ও ব্র্যান্ড ভ্যালুও নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।</p> <p>দেশের সব নাগরিকেরই রাজনীতি করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু বিদ্যমান নেতিবাচক ভাবমূর্তি দূর করে রাষ্ট্র ও সমাজে নিজেদের ইতিবাচক অবস্থান তৈরি করতে ব্যবসায়ীদের সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকা উচিত কি না তা এখনই ভেবে দেখতে হবে। মনে রাখা দরকার যে ব্যবসায়ীদের মূল কাজ হলো নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা। জনগণের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান কিংবা গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দারিদ্র্য বিমোচন ও জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখা ব্যবসায়ীদের রাষ্ট্রীয়-সামাজিক দায়িত্বের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।</p> <p> </p> <p><strong>ব্যাবসায়িক পরিবেশ ও নৈতিকতা উন্নয়নে বাণিজ্য সংগঠনগুলোর সক্রিয় ভূমিকা</strong></p> <p>দেশের বাণিজ্য সংগঠনগুলোতে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বর্তমানে সমাজের সচেতন শ্রেণির অন্যতম প্রধান আলোচ্য বিষয়। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে, তখন সেই দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রভাবশালী ব্যবসায়ীকে সচরাচর বিভিন্ন ব্যাবসায়িক সংগঠনের নেতৃত্বে আসতে দেখা যায়। শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন এফবিসিসিআইয়ে দেশের সব খাতের ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে সবার অবস্থান খাতভিত্তিক নয়। দেশের অন্যান্য বাণিজ্য সংগঠনের ক্ষেত্রেও চিত্রটা কমবেশি একই রকমের। আশার কথা, সম্প্রতি বাণিজ্য সংগঠনগুলোতে ব্যবসায়ীদের সক্রিয় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা কমানো এবং প্রতিটি ব্যাবসায়িক খাতের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ব্যাপারে আলোচনা চলছে। এফবিসিসিআইসহ সব ব্যবসায়ী সংগঠন যাতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে সার্বিক ব্যাবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। এ ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যে অনৈতিক কার্যকলাপ রোধে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর উচিত নিজেদের সদস্যভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিতভাবে আলাপ-আলোচনা ও নৈতিক কাউন্সেলিং প্রদান করা। এতে সংশ্লিষ্ট খাতে অনিয়ম ও অনৈতিক কার্যকলাপ দূর হতে পারে। এভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাবসায়িক নৈতিকতার চর্চা বৃদ্ধি পেয়ে অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হবে।</p> <p> </p> <p><strong>সরকারের রাজস্ব-কর আহরণ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ ডিজিটাইজ করা</strong></p> <p>বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপি (চলতি বাজারমূল্যে) প্রায় ৪৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেখানে ব্যক্তি খাতের অবদান মোট জিডিপির প্রায় ৮০ শতাংশ। দেশের জিডিপি, বিনিয়োগ ও রাজস্ব-কর আহরণের প্রধানতম উৎস এবং সামগ্রিক অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো বেসরকারি খাত। কিন্তু দেশের অন্যান্য খাতের মতো সরকারের ট্যাক্স ও অন্যান্য রাজস্ব আহরণ খাতের মধ্যেও নানা জটিলতা, অনিয়ম ও প্রতিবন্ধকতার কথা সমাজে আলোচিত হচ্ছে। পণ্য আমদানি-রপ্তানিসংক্রান্ত বিভিন্ন শুল্ক-কর নির্ধারণ ও আদায়, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স, পণ্য খালাস, পরিবহন প্রভৃতি ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম ও জটিলতার ব্যাপারে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে থাকেন। তাই সরকারের রাজস্ব-কর আহরণের সব প্রক্রিয়ায় ডিজিটাইজেশনের প্রচলন করা গেলে একদিকে যেমন সরকারের রাজস্ব আহরণের সক্ষমতা বহুলাংশে বাড়বে, তেমনি তা ব্যবসায়ীদের সহজে ও সুষ্ঠুভাবে রাজস্ব প্রদানের মাধ্যমে শুল্ক-কর ফাঁকিবাজির সামাজিক অপবাদ ঘোচাতে অনেকাংশে সাহায্য করবে।</p> <p> </p> <p><strong>পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করা</strong></p> <p>গুণমানহীন, ভেজাল ও নকল পণ্যের উৎপাদন, বিক্রি ও বিপণনের ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সামাজিক অভিযোগ রয়েছে। পণ্যের গুণগত মান পরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বিএসটিআই, বিসিএসআইআর গবেষণাগার, বিআরটিএ, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিভিন্ন সরকারি সংস্থার উদ্যোগে মাঝেমধ্যে বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের খবর গণমাধ্যমে দেখা যায়। কিন্তু এসব উদ্যোগে কিংবা মান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট খাতের বাণিজ্য সংগঠন তথা ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে। এ কারণে বিএসটিআই ও বিআরটিএর মতো সব প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা দরকার। এর ফলে সরকারের অনুমোদিত প্রক্রিয়া, পদ্ধতি ও স্পেসিফিকেশন অনুসারে পণ্য উৎপাদন হচ্ছে কি না সেসব বিষয় বাস্তবায়ন ও তদারকির দায়দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সংগঠনের ওপরও বর্তাবে। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীরা নিজেদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে কার্যকর ভূমিকা পালন করার সুযোগ পাবেন। এ ছাড়া পণ্যের গুণগত মান, সঠিক স্পেসিফিকেশন ও বৈশ্বিক মানদণ্ড নিশ্চিত করা গেলে পণ্যের আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য সার্টিফিকেশন প্রদান করা সম্ভব হবে, যা বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।</p> <p> </p> <p><strong>তরুণদের হাতেই উদ্যোক্তাদের সামাজিক মর্যাদা পুনরুদ্ধার ও নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের দায়িত্ব</strong></p> <p>আজকের তরুণরা আমাদের চেয়ে মেধাবী, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং নিত্যনতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে অনেক বেশি পারদর্শী। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিষয়ে তারা জ্ঞান রাখে। উচ্চ ফলনশীল ধান, পুষ্টিকর মাছ, সবজি, ফলমূলসহ নানা কৃষি ও কৃষিজাত ব্যবসা-বাণিজ্যে এখন শিক্ষিত, উদ্যমী ও বিজ্ঞানমনস্ক তরুণদের পদচারণ। তাই তরুণরাই দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ, আগামী বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। তাদের মনোবল ভাঙা যাবে না। নানা ধরনের সৃজনশীল ও উৎপাদনমুখী ব্যাবসায়িক উদ্যোগের মাধ্যমে তরুণরা দেশের অর্থনীতিতে গভীরতা ও বহুমাত্রিকতা সৃষ্টি করে চলছে। কিন্তু এসব তরুণ যদি সামাজিকভাবে স্বীকৃতি না পায় তাহলে তারা উৎসাহ হারাবে। প্রয়োজনীয় সরকারি নীতি সহায়তা এবং যথার্থ সামাজিক স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে এসব তরুণকে উৎসাহিত করা গেলে তারা নিজেদের মেধা, প্রজ্ঞা ও সৃষ্টিশীলতা দিয়ে এক নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করবে এবং এভাবে উদ্যোক্তাদের সামাজিক মর্যাদাও পুনরুদ্ধার করতে পারবে। তাহলে দেশের বাকি তরুণরা আর অনৈতিক পথে হাঁটবে না, যেভাবেই হোক তারা সামনে এগোবে। আর এভাবেই আগামী বাংলাদেশের সুন্দর ও স্বপ্নময় ভবিষ্যৎ রচিত হবে।</p>