<p>বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমাগত উন্নতির দিকে থাকলেও নিত্যপণ্যের বাজারের অস্থিতিশীলতা সমাজের এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিত্যপণ্যের অপ্রাপ্যতা এবং মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ব্যয়ভার বাড়িয়ে তুলছে। পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে অনেক পরিবার তাদের জীবনযাত্রার মান বজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে, যা দীর্ঘ মেয়াদে তাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব <img alt="নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সংস্কার জরুরি" height="471" src="https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/1. january/12-01-2025/Rif/12-01-2024-p6-5.jpg" style="float:left" width="350" />ফেলছে। সরকার বিভিন্ন সময়ে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানা পদক্ষেপ নিলেও তা যথেষ্ট ফলপ্রসূ হচ্ছে না। আমাদের বাজারব্যবস্থায় সরবরাহ শৃঙ্খলে বিভিন্ন বাধা, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য, মধ্যস্বত্বভোগীদের অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের প্রবণতা, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজারে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি কারণে দ্রবমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি। বর্তমান বাস্তবতায় বাজারে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এতে নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল হবে এবং ভোক্তাদের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসবে। নিত্যপণ্যের বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে নিম্নবর্ণিত সংস্কার জরুরি।</p> <p> </p> <p><strong>সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন</strong></p> <p>নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখার পূর্বশর্ত হলো পণ্যের সঠিক ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা। উৎপাদন বা আমদানি থেকে শুরু করে বাজারে পণ্য পৌঁছানো পর্যন্ত একাধিক স্তরের সরবরাহ শৃঙ্খল রয়েছে, যা মাঝে মাঝে অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। সরবরাহ শৃঙ্খলের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও কার্যকর পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন, যাতে মজুদদার ও কালোবাজারির দৌরাত্ম্য কমে আসে। সরবরাহব্যবস্থার ডিজিটাইজেশনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে পণ্যের উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড হবে এবং সংশিষ্ট বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো তা মনিটর করতে পারবে। ডিজিটাল সরবরাহ ব্যবস্থা গ্রহণ করার ফলে ব্যবসায়ীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ভোক্তাদের মাঝেও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। মানবসম্পদ ও ডিজিটাল প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে বাজারের সরবরাহ শৃঙ্খল আরো দক্ষ ও কার্যকর করা সম্ভব হবে। এ ছাড়া সরকার নিজস্ব উদ্যোগে কোনো নির্দিষ্ট পণ্যের সরবরাহ বাড়ালে এমনিতেই সেই পণ্যের দাম কমে আসবে। এতে অনৈতিকভাবে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার অস্থিতিশীল করা সম্ভব হবে না। এ ব্যাপারে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কর্মকাণ্ড আরো বিস্তৃত ও গতিশীল করতে হবে। একই সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি।</p> <p> </p> <p><strong>পাইকারি বাজার ব্যবস্থার পুনর্গঠন</strong></p> <p>পাইকারি বাজার ব্যবস্থা যেকোনো দেশের অর্থনীতির একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এটি উৎপাদক ও খুচরা বিক্রেতার মধ্যকার সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে পাইকারি বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা বেশি থাকা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত এই বাজারগুলোকে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে পাইকারি বাজারে পণ্যের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড বা পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা নেই। এ অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হলে সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়ে পাইকারি বাজার ব্যবস্থা পুনর্গঠন করতে হবে। স্থানীয় বাজারগুলোতে নিয়ন্ত্রিত মূল্য নির্ধারণ এবং সাপ্তাহিক মূল্যতালিকা প্রচলনের ব্যবস্থা করা দরকার। এ ছাড়া বাজার পরিস্থিতি আরো স্থিতিশীল করতে পাইকারি বাজারের আধুনিকায়ন, স্টোরেজ সুবিধা বৃদ্ধি এবং দাম নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যদিও পাইকারি বাজার ব্যবস্থার পুনর্গঠন একটি জটিল প্রক্রিয়া, তার পরও যতক্ষণ পর্যন্ত পাইকারি বাজার ব্যবস্থা পুনর্গঠন করা না যাবে ততক্ষণ পণ্যের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।</p> <p> </p> <p><strong>কৃষক ও খুচরা বিক্রেতার মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন </strong></p> <p>কৃষিপণ্যের বাজারব্যবস্থা আরো দক্ষ ও কার্যকর করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো কৃষক ও খুচরা বিক্রেতার মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন। এই সংযোগ স্থাপন নিশ্চিত করা গেলে মধ্যস্বত্বভোগী এড়ানো যাবে। ফলে কৃষকরা তাদের উৎপাদন করা পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাবে এবং তারা পণ্য উৎপাদনে আরো বেশি উৎসাহী হবে। এ ছাড়া ভোক্তারাও কম দামে কৃষিপণ্য ক্রয় করতে পারবে। তাই প্রতিটি উপজেলায় কৃষকদের জন্য অন্তত একটি কৃষি বিপণন কেন্দ্র বা ‘কৃষকবাজার’ স্থাপন করার ব্যবস্থা নিতে হবে, যেখানে কৃষকরা সরাসরি পণ্য বিক্রি করতে পারবে। এই লক্ষ্যে একটি উপযুক্ত নীতিমালা এবং কৃষকবাজারের একটি আদর্শ মডেল প্রণয়ন করা জরুরি। এ ছাড়া একাধিক কৃষক মিলে একটি সমবায় সংস্থা গঠন করলে সহজে ও ন্যায্য মূল্যে তাদের উৎপাদন করা পণ্য একসঙ্গে বিক্রি করতে পারবে। এতে প্রান্তিক কৃষকরা তাদের উৎপন্ন পণ্যের প্রতিযোগিতামূলক দাম পাবে। এ ব্যাপারে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও সমবায় অধিদপ্তর যৌথভাবে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। কৃষকবাজার ব্যবস্থা চালু করা গেলে কৃষকদের আয় বাড়বে, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে এবং ভোক্তারাও সঠিক দামে গুণমানসম্পন্ন কৃষিপণ্য ক্রয় করতে পারবে।</p> <p> </p> <p><strong>মজুদদারি ও কালোবাজারি রোধে আইনের প্রয়োগ</strong></p> <p>কালোবাজারি ও মজুদদারের নিয়ন্ত্রণে আমাদের পণ্যবাজার। আলু, পেঁয়াজ, ডিম, চাল, ডাল, তেল, চিনি—সব কিছুর দামই তথাকথিত মজুদদার ও আড়তদার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। দেশে উৎপন্ন কিংবা বিদেশ থেকে আমদানি করা প্রায় সব ভোগ্য পণ্যই এখন সিন্ডিকেটের কবলে। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী ও মজুদদার দেশে উৎপন্ন পণ্যে সিন্ডিকেট তৈরি করে থাকে। বিদেশ থেকে আমদানি করা পণ্যের নিয়ন্ত্রণও গুটিকয়েক বড় করপোরেটের হাতে। ফলে সেখানেও রয়েছে সিন্ডিকেটের অদৃশ্য হাত। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এর আওতায় মজুদদারদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ না থাকায় ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ অধিদপ্তর মজুদদারি ও কালোবাজারি রোধে তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। তাই দণ্ডবিধি অথবা বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ প্রয়োগ করার মাধ্যমে মজুদদারি ও কালোবাজারির বিরুদ্ধে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। জেল ও আর্থিক জরিমানার বিধান রেখে মজুদদারি ও কালোবাজারি রোধে একটি যুগোপযোগী নতুন আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা দরকার। নিয়মিত অভিযান এবং আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে বাজারে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।</p> <p> </p> <p><strong>পণ্যের মূল্যতথ্য প্রচারণা এবং ভোক্তা সচেতনতা বৃদ্ধি</strong></p> <p> পণ্যের মূল্যতথ্য প্রচারণা এবং ভোক্তা সচেতনতা বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়ের জন্যই উপকারী। ক্রেতার কাছে পণ্যের মূল্যতথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা গেলে একটি স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক বাজারব্যবস্থা সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। এতে ক্রেতাদের পণ্য ক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হয় এবং বাজারে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা বজায় থাকে। প্রযুক্তির সাহায্যে নিত্যপণ্যের মূল্য জনগণের কাছে সরাসরি পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে অনলাইন বা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে দৈনিক মূল্যতালিকা প্রকাশ করা গেলে ক্রেতারা বাজারের প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে পরিচিত হতে পারবে। এ ছাড়া ভোক্তাদের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে তারা অবগত হয়ে যাচাই-বাছাই করে পণ্য কিনতে পারে।</p> <p> </p> <p><strong>নীতিগত ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা</strong></p> <p>বাজারের জন্য একটি কার্যকর নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করে সরকারের ভূমিকা শক্তিশালী করতে হবে। পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বশীল সংস্থা, যেমন—ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণ অধিদপ্তর, প্রতিযোগিতা কমিশন, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরসহ অন্যান্য নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় বাড়াতে হবে এবং নিয়মিত নজরদারি ব্যবস্থা আরো জোরদার করতে হবে। এতে অপ্রত্যাশিত মজুদদারি বা মূল্যবৃদ্ধি রোধে সরকার আরো কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। মনে রাখতে হবে, শুধু অভিযান চালিয়ে পণ্যের দাম কমানো যাবে না। নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখার জন্য প্রস্তাবিত সংস্কারসমূহ বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি।</p> <p> </p>