<p>জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসংখ্য অবদানের মধ্যে হজযাত্রীর প্রতি উদারতা অন্যতম। ৫৩ বছর আগে বঙ্গবন্ধুর হজযাত্রীর প্রতি উদার মনোভাব আমার স্মৃতিতে আজও জাগ্রত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি পাসপোর্ট ব্যবহার করে ‘সফিনায়ে আরব’ ও ‘সফিনায়ে আরাফাতে’ প্রায় দুই হাজার ৬০০ হজযাত্রী সৌদি আরব গমন করেন। যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয় ট্রিপ আর যায়নি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাঁদের দেশে ফেরত না-ও আনতে পারতেন। প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ, অতঃপর বঙ্গবন্ধু নিজে জাতিসংঘের মাধ্যমে দুই হাজার ৬০০ হজযাত্রীকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে বাদশাহ ফয়সাল বরাবর চিঠি লিখেন। অনুমতি পেয়ে বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারতের মুহাম্মদি জাহাজে করে দুই ট্রিপে হজযাত্রীদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। </p> <p>মুক্তিযুদ্ধকালীন চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজডুবিসহ নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকায় ভারতের মুহাম্মদি জাহাজ প্রথম ট্রিপে সফিনায়ে আরবে করে যাওয়া হজযাত্রীদের জেদ্দা বন্দর থেকে উঠিয়ে মোংলা বন্দরে নামিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সেই লক্ষ্যে বঙ্গোপসাগর থেকে মোংলা বন্দরে পৌঁছতে নদীর ভেতর কিছু এগিয়ে যায়। জাহাজ অনুপাতে নদীর গভীরতা কম। ফলে ঝুঁকি নিয়ে জাহাজ ঘুরিয়ে নিতে হয়। এই জাহাজ চাঁদপুর এসে হজযাত্রীদের নামিয়ে দেয়। হজযাত্রীর আত্মীয়-স্বজন সবাই মোংলা বন্দর থেকে চাঁদপুর আসে। অতঃপর সফিনায়ে আরাফাতে যাওয়া হজযাত্রীদের দ্বিতীয় ট্রিপে জেদ্দা থেকে এনে চাঁদপুর নামিয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যাওয়া হজযাত্রীদের হজ অনুষ্ঠিত হয় সম্ভবত ২৫ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে।</p> <p>এদিকে ১৯৭২ সালের শেষের দিকে হজের কার্যক্রম শুরু করার সময় হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামদ আজাদ সৌদি সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে চিঠি লেখেন বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রী গমনে অনুমতির জন্য। সৌদি সরকারের কাছ থেকে জবাব আসতে বিলম্ব হতে দেখে বঙ্গবন্ধু নিজে ২৬ সেপ্টেম্বর বাদশাহ ফয়সালের কাছে চিঠি দেন হজযাত্রী যেতে অনুমতি দেওয়ার জন্য। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মহৎ উদারপ্রাণ ব্যক্তিত্ব। সৌদি আরব যেহেতু তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, তিনি ইচ্ছা করলে গায়ে পড়ে চিঠি না লিখে পারতেন। চিঠি পেয়ে বাদশাহ ফয়সাল অনুমতি দেন। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রী নেওয়ার জন্য ভারত সরকার মুহাম্মদি জাহাজ পুনঃপ্রদান করে।</p> <p>এতে পাহাড়তলী হাজি ক্যাম্প তৎপর হয় হজ কার্যক্রম নিয়ে। তখন দেশে অভ্যন্তরীণ যাতায়াতের জন্য মাত্র ৪০ আসনের ছোট দুটি বিমান ছিল। এ দুটি বিমান অভ্যন্তরীণ যাতায়াত সামাল দিয়ে কলকাতাও যাওয়া-আসা করত। অন্যদিকে ১৭৮ আসনের ৭০৭ একটি মাত্র পুরনো বোয়িং বিমান ছিল। এটা ঢাকা-ব্যাঙ্কক এবং ঢাকা থেকে দুবাই হয়ে লন্ডন যাতায়াত করত। এমন প্রতিকূল অবস্থায় ভারতের মুহাম্মদি জাহাজে দুই ট্রিপ এবং ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দর হয়ে আকাশপথে মাত্র তিন হাজার হজযাত্রী পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। সে লক্ষ্যে হজযাত্রী পরিবহনে বিমান ভাড়া করা হয়। ভারতের মুহাম্মদি জাহাজটি সফিনায়ে আরব ও সফিনায়ে আরাফাত থেকে কিছুটা বড়। সফিনায়ে আরব ও সফিনায়ে আরাফাতের ধারণক্ষমতা এক হাজার ৩০০ জন বা কিছুটা বেশি। ঢাকা থেকে বিমানে হজযাত্রী পাঠাতে তেজগাঁও বিমানবন্দরের কাছে সরকারি নির্মীয়মাণ বড় দালানকে সাজিয়ে অস্থায়ী হাজি ক্যাম্প করা হয়। এ পদ্ধতি বর্তমান বিমানবন্দরের বিপরীতে আশকোনা হাজি ক্যাম্প না হওয়া পর্যন্ত চালু ছিল। ১৯৭৩ সালের হজে বিমানের ভাড়াসহ সর্বমোট খরচ ছিল পাঁচ হাজার টাকা।</p> <p>জেদ্দা হজ টার্মিনাল, পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনায় বাংলাদেশ হজ মিশন এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে অস্থায়ী অফিস খোলা হয়। হজের শেষ ফ্লাইটে সবাই হজ টার্মিনাল হয়ে ঢাকায় চলে আসেন। তখন হজ ছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ভারতে মুহাম্মদি জাহাজ পুরনো ও মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় ১৯৭৪ সালে হজে শুধু বিমানে হজযাত্রী পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।</p> <p>১৯৭৩ সালে মাত্র তিন হাজার জনকে হজ করানোর সিদ্ধান্ত হয় এবং তা নির্ধারণ করা হয় জেলাভিত্তিক জনসংখ্যা অনুপাতে লটারির মাধ্যমে। সে লক্ষ্যে একটি বিমান বিদেশ থেকে ভাড়া করা হয়। বিমানগুলো থাকত অনেকটা ছোট ৭৩৭ বোয়িং আকৃতির। জেদ্দা যাতায়াত করত দুবাইয়ে থেমে। ১৯৭৪ সালেও মাত্র তিন হাজার জন হজে গমন করেন লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে। টাকা সর্বমোট ৯ হাজার ৫০০। ১৯৭৫ সালে বেড়ে হজের সর্বমোট খরচ দাঁড়ায় ১৬ হাজার টাকা। বস্তুত বঙ্গবন্ধু ছিলেন উদার মহত্প্রাণ ব্যক্তিত্ব, ছিলেন ধর্মানুরাগী। শুধু হজ বিষয়ে নয়, ১৯৭৪ সালে লাহোর ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানকে বঙ্গবন্ধু গুরুত্ব দিয়েছেন।</p> <p>চাঁদের তারিখ মতে, ১৫ জুন ২০২৪ হজ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমাদের উচিত, হজ বিষয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অবদান স্মরণ রাখা।<br />  </p>