<p>খুলনা জেলাসহ আশপাশের এলাকায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা। গত ১৪ বছরে এই অঞ্চলের তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১১ সালে এই অঞ্চলের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ছিল ৩১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর চলতি বছর সেই তাপমাত্রা ছাড়াল রেকর্ড ৪১.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়া দপ্তরের ১৪ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে।</p> <p>সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, খুলনা অঞ্চলে দিন দিন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট হচ্ছে। এ কারণে তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ নানা প্রাকৃতিক প্রভাব পড়ছে। বিশেষ উচ্চ তাপমাত্রায় হুমকির মুখে পড়ছে কৃষি, মৎস্যসহ উত্পাদন খাত। তাই এখনই এ বিষয়ে সচেতন হওয়া ও কার্যকর উদ্যোগ জরুরি।</p> <p>খুলনা আবহাওয়া দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল মে মাসে ৩৪.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১২ সালে ৩৬.৭, ২০১৩ সালের জুনে ৩৩.৯, ২০১৪ সালে ৩৬.৮, ২০১৫ সালে ৩৬,  ২০১৬ সালের এপ্রিলে ৩৬.৩, ২০১৭ সালের মে মাসে ৩৫.৯, ২০১৮ সালের এপ্রিলে ৩৩.৮, ২০১৯ সালের মে মাসে ৩৬.২, ২০২০ সালের এপ্রিলে ৩৪.৪, ২০২১ সালের এপ্রিলে ৩৬.৪, ২০২২ সালের এপ্রিলে ৩৫.২ এবং ২০২৩ সালের এপ্রিলে ৩৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলতি বছরের ২০ এপ্রিল রেকর্ড ৪১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস স্পর্শ করে, যা ১৪ বছরের রেকর্ড। </p> <p>ন্যাশনাল অ্যারোনটিকস অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নাসা) গডার্ড ইনস্টিটিউট ফর স্পেস স্টাডিজ (জিআইএসএস) বলছে, ১৮৮০ সাল থেকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা কমপক্ষে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশির ভাগ উষ্ণায়ন ঘটছে ১৯৭৫ সাল থেকে। প্রতি দশকে ০.১৫ থেকে ০.২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা বাড়ছে। ২০২৩ সালে ১.১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়।</p> <p>বৈশ্বিক তাপমাত্রা হ্রাসে যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ২০১৫ সালের কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজের (কপ২১) প্যারিস চুক্তিতে। ওই চুক্তিতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ১.৫ ডিগ্রি, সম্ভব হলে ১.৪ ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ রাখা। প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী প্রাক শিল্প বিপ্লবের সময় থেকে ২১০০ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার অঙ্গীকার করেন বিশ্বনেতারা। </p> <p>কৃষি তথ্য সার্ভিসে বলা হয়েছে, সাধারণত ধান চাষের ক্ষেত্রে ১৮ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন। কিন্তু এর বেশি তাপমাত্রায় ধান উৎপাদন কমছে। বর্তমানে বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়াচ্ছে। এতে ধানের পরাগায়ণ বাধাগ্রস্ত ও উত্পাদন ব্যাহত হচ্ছে। আবার উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি জমির মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ফসল উৎপাদন ক্ষমতা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। অনেক কৃষিজমি পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। কৃষিজমির লবণাক্ততা বাড়তে থাকলে কৃষি আয় বছরে ২১ শতাংশ কমে যাবে। উপকূলীয় অঞ্চলের ৪০ শতাংশ কৃষিজমি হুমকির মুখে পড়বে। এতে এই অঞ্চলের দুই লাখ ৪০ হাজার কৃষকের বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ধান ছাড়া অন্যান্য শস্য, যেমন—পাট, গম, ভুট্টা, মটর, ছোলা উৎপাদনও ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।</p> <p>কৃষি তথ্য আরো বলছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর বিভিন্ন পরিবর্তনের ফলে মৎস্য উৎপাদন মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে পানি গরম হয়ে পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। এতে মাছের পোনা উৎপাদন অনেকাংশে হ্রাস পায়। এর ফলে মৎস্য খাত থেকে আয় কমে যাচ্ছে।</p> <p>বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার কৃষিগ্রাম খ্যাত দ্বীপচর। এই গ্রামের চাষি মনির সওদাগর জানান, সারা বছরই তাঁদের গ্রামে ফসলের চাষ হয়। এ বছরও প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে পুঁইশাক, পাট, ঢেঁড়স, কলমিশাকসহ নানা জাতের শাক-সবজির চাষ হয়েছে। পানির অভাবে সব বিবর্ণ হয়ে গেছে। গ্রামের সব ডোবা, নালা, পুকুর, খাল শুকিয়ে যাওয়ায় পাশের খাল থেকে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে সেচ দিয়ে ফসল টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। ঘণ্টায় ৩০০ টাকা করে বিঘায় দেড় হাজার থেকে প্রায় দুই হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। তাঁর গ্রামের ৫০ জন চাষি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অথচ তাঁরা এই অবস্থার জন্য দায়ী নন।</p> <p>সাতক্ষীরার কৈখালী ইউনিয়নের বৈশখালী গ্রামের নুরুল হক গাজী বলেন, তীব্র দাবদাহে এলাকার সব পুকুর শুকিয়ে গেছে। নলকূপের পানিও নোনা।</p> <p>খুলনার কয়রা উপজেলার কৃষক শাহজাহান সিরাজ ও পাইকগাছা উপজেলার মাতম গ্রামের সেলিম সরদার জানান, দিন দিন দুর্যোগ বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে গরম, লবণাক্ততা ও পানিসংকট চরম আকার ধারণ করছে। সব কাজে খরচ বাড়ছে। কিন্তু এ জন্য তাঁরা কোনো ক্ষতিপূরণ পান না।<br /> জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষিতে পানিসংকট নিরসন অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ মনে করেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবীর। তিনি বলেন, ‘আমরা নদী-খালের পানিপ্রবাহ সরবরাহে গুরুত্ব দিচ্ছি। নদী-খাল খনন, বড় বড় পুকুরে বর্ষাকালের পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’</p> <p>খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনের সংসদ সদস্য মো. রশীদুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, কয়রা-পাইকগাছা মূলত উপকূলীয় এলাকা। গত তিন-চার দশকে এ অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও দুর্যোগে মানুষের কর্মসংস্থান কমে গেছে। প্রায় ৮০ শতাংশ কর্মজীবী মানুষ কাজের জন্য এলাকা ছেড়েছে। তবে মানুষ এখন কৃষিতে ফিরতে চায়। তাই লবণবিরোধী জনমত গড়ে উঠছে।</p>