<p>ডুব চলচ্চিত্রটি মুক্তির আগেই যে বিতর্কটিকে উস্কে দেয় তা হলো, এটি হুমায়ূন আহমেদের বায়োপিক, নাকি বায়োপিক নয়? পরিচালক, হুমায়ূন পরিবার ও মিডিয়া এ নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং ফলাফল যা দাঁড়ায় তা হলো, এটি বায়োপিক, আবার না। ছবিটি মুক্তির পরও এ নিয়ে দ্বন্দ্ব কোনোমহলেই ঘোছেনি। দর্শক ছবিটি দেখে নিজেরাই বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছেন, হুমায়ূনের সাথে কোনো অংশ মেলাতে পারছেন, কোনো অংশ পারছেন না, কেউ আবার পুরোটাই সত্য ভেবে মেনে নিচ্ছেন। ব্যক্তি হুমায়ূন আহমেদ আমাদের কাছে এত রহস্যঘেরা ব্যক্তিত্ব ছিলেন যে, তার সম্পর্কে তিনি যেরকম নানান গল্প আমাদের সামনে উপস্থিত করেছেন, আবার আমরা নিজেরাও কিছু গল্প তৈরি করে নিয়েছি। ফলে প্রকৃত হুমায়ূন আহমেদ আমাদের কাছে চিরকালই অধরা থেকে গেছেন। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সহজেই তাই সেই অধরা ব্যক্তিটিকে নিয়ে গল্পের অবতারণা করেছেন। যেখানে কিছু জায়গায় আমরা হুমায়ূন আহমেদকে পাচ্ছি আবার কিছু জায়গায় আমাদের নিজেদের সৃষ্টি হুমায়ূন আহমেদকে পাচ্ছি।</p> <p>যাই হোক, চলচ্চিত্রটির শুরু দেখেই দর্শকের বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, এটি প্রথাগত চলচ্চিত্রের ধারা থেকে ভিন্ন। ঠাস করে একটা গুলি পর্দার এ প্রান্ত ঘেঁষে ছুটে গেল আর নাম ভেসে উঠল সিনেমার নাম ‘বুলেট’। এইরকম কোনো দৃশ্য নয়। একটা সূর্যাস্তের দৃশ্যের মধ্যে দিয়ে পর্দা উন্মোচিত হচ্ছে, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী যেন তার দর্শকদের প্রস্তুত করে নিচ্ছেন যে, একটা বিষণ্ণ করুণ গল্প এরপর থেকে তারা প্রত্যক্ষ করতে থাকবেন। এই গল্পের বিস্তার চক্রাকার এবং পূর্ব নির্ধারিত। আমরা তা পুন:পুন: প্রত্যক্ষ করি। তবে এখানেও তিনি কৌশলের আশ্রয় নেন। তিনি ভালো করেই জানেন যে, এই মনোবিষণ্ণ করা গল্প বেশিক্ষণ কারো পক্ষেই সহ্য করা সম্ভব নয়, তাই কিছু পরপরই হালকা রসের জোগান দিয়ে গেছেন। যেমন জাভেদ-মায়ার বিয়ের গল্প, নিতুর অভিসার পর্ব, শুটিং বাড়ির কর্মচারীদের নানান কর্মকাণ্ড ইত্যাদি ইত্যাদি।<br /> জাভেদ চরিত্রটিকে দেখে  জীবনানন্দ দাশের “বোধ” কবিতা বারবার মনে পড়েছে, ‘সকল লোকের মাঝে বসে/আমার নিজের মুদ্রাদোষে/আমি একা হতেছি আলাদা?...’ জাভেদ যখন তার প্রথম স্ত্রী মায়া, কন্যা সাবেরী ও ছেলেকে নিয়ে পাহাড়ঘেরা রিসোর্টে বেড়াতে যায় এবং কন্যা সাবেরীর অনুরোধে জাভেদ ও মায়া কিছু একান্ত সময় অতিবাহিত করে ; তখন তাদের মাঝে যে কথপোকথন হয়; তাতে দর্শকের বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, তাদের দাম্পত্যজীবনের মাঝে একটা শিথিলতা, স্থবিরতা এসেছে। এবং এটি সবচেয়ে আগে উপলব্ধি করতে পারে তার মেয়ে সাবেরী। ফলে সাবেরীই ঠেলে পাঠায় তাদের দুজনকে কিছু সময় অতিবাহিত করার জন্য। সেখানে মায়া, জাভেদের কাছে এইরকম প্রশ্ন রাখে যে, কেন জাভেদ বারবার অতীতস্মৃতি রোমন্থন করছে, তবে কি বর্তমান শূন্য হয়ে গেছে? তারপর নিরবতা, মাছির ভন ভন, হাওয়া শনশন। আবহসঙ্গীত যে কত অর্থবহ হতে পারে ‘ডুব’ না দেখলে তা বোঝানো কষ্টকর। সারা চলচ্চিত্র জুড়ে এরকম অসংখ্য নিরবতা। এক একটা যতি এবং শূন্যস্থান।<br /> বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখক জগদীশ গুপ্ত’র বিখ্যাত ছোটগল্প ‘দিবসের শেষে’ গল্পটির শুরুতে একটা ভয়াবহ সংবাদ আমরা জানতে পারি যে, রতির পাঁচ বছরের ছেলে পাঁচু যখন বলে যে, মা, আজ আমায় কুমিরে নেবে। এই টেনশন কিছুপর নানান চরিত্রের কর্মব্যস্ততায় পাঠক যখন ভুলতে বসে ঠিক তখনই ছেলেটিকে কুমিরে নিয়ে যায়। আমরা এই চলচ্চিত্রটির প্রথমেই তেমন ইঙ্গিত প্রত্যক্ষ করি, যখন জাভেদ সাহেব তার প্রাণপ্রিয় কন্যা সাবেরীকে বলে যে, মানুষের যখন প্রয়োজন ফুরায় তখন মানুষ মারা যায়। তারপর ঘটনা প্রবাহ নানান দিকে মোড় নেয়। কন্যার বান্ধবী নিতুকে নিয়ে সংসারে অশান্তির বিষ ছড়ায়। আমরা স্থির অচঞ্চল জাভেদকে এই একবারইমাত্র উত্তেজিত হতে দেখি। স্ত্রীর অভিমান করে মায়ের কাছে চলে গেলে তাকে আবার ফিরিয়ে আনতে দেখি। কিন্তু যে সন্দেহের বিষবৃক্ষের বীজ রোপিত হয়ে গেছে তা ডালপালা মেলে অন্ধকার আরো গাঢ় করলে জাভেদ একসময় সব দায়ভার তার কাঁধে নিয়ে দূরে সরে আসে এবং বিয়ে করে নিতুকে। জাভেদ কেন নিতুকে বিয়ে করল? কারণ ঐ যে মাছি ভন ভন! জাভেদের নিস্তরঙ্গ জীবনে নিতু একটা ঘূর্ণিঝড়। এই ঝড়কে যে আঁটকাতে চেয়েছে কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে। এই ঝড়ে সে হারিয়ে ফেলে তার পূর্বের স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সঙ্গে সম্পর্ক। নিতু চরিত্রটিকে বড়ই খেয়ালি, আবেগতাড়িত, অকপট, সাহসী আমরা প্রত্যক্ষ করি। তার যা ভালো লাগা মন্দ লাগা তা প্রকাশে তার কোনো কুণ্ঠা নেই। ফলে সহজেই সে পূর্বের সমস্ত কিছু বদলে ফেলতে চায় ঘরের পর্দা থেকে শুরু করে জাভেদকে পর্যন্ত। এটিকে অনেকেই নেগেটিভ হিসাবে দেখতে পারেন কিন্তু নির্মোহভাবে যদি দেখা যায় তবে এই চরিত্রটি যা করেছে তা খুবই স্বাভাবিক। সে শুধুমাত্র তার ভালোবাসার মানুষটিকে পাওয়ার জন্য যেরকম ত্যাগ ও নিষ্ঠা নিয়ে তাকে অর্জন করেছে; তাতে করে তার এরকম অধিকার চাওয়া অন্যায় হতে পারে না। সে চেয়েছে সম্পূর্ণ জাভেদকে, কোনো খণ্ডিত অংশকে নয়। এবং জাভেদের হৃদয়ে নিতুর অবস্থানটুকু ছোট্ট একটা ঘটনার মাঝে উন্মোচিত হয় যখন তাঁর একজন চলচ্চিত্র শিক্ষার্থী ফেসবুকে প্রফাইল পিকচার হিসাবে নিতুকে বাদ দিয়ে শুধু জাভেদ ও তাঁর ছবি পোস্ট দেয় তখন জাভেদ বলে ওঠে, তুমি কিভাবে আমাকে সম্মান করলে ওকে বাদ দিয়ে? আমরা ভাবতে শুরু করি এইবার জাভেদ সাহেবের নিস্তরঙ্গ জীবনে আনন্দের কিছু ঘটতে শুরু করবে, ভালোবাসা লুটোপুটি করবে। কিন্তু নিতু ঝড় থেমে গেলে মানুষ যেরকম ঝড়ে হারানো জিনিসগুলো খুঁজতে শুরু করে, জাভেদকে আমরা সেরকম হারিয়ে যাওয়া প্রাক্তন স্ত্রী-কন্যা-পুত্রকে খুঁজতে দেখি। কিন্তু সাবেরী এখানে আড়াল হয়ে দাঁড়ায়। সে অভিশাপ দেয় যে জাভেদ কখনো আর তার পুত্র-কন্যার খোঁজ জানতে পারবে না। জাভেদ নানাভাবে চেষ্টা করে যখন আর কোনোই সংযোগ রক্ষা করতে পারে না বা জাভেদ যখন ক্রমেই বিচ্ছিন্ন হতে থাকে তার চেনাজগত থেকে তখন নিতুর কাঁধে তাঁর আত্মসমর্পন দেখি। আর ঠিক তখনই ক্যামেরা প্যান করে। আমরা দেখি কোরআন তেলওয়াত এবং জানি জাভেদ এর মৃত্যু। এটি আবারো আমাদের মনে করিয়ে দেয় জাভেদের সেই উক্তি, মানুষের যখন প্রয়োজন ফুরায় তখন মানুষ মারা যায়।<br /> জাভেদের মৃত্যুর সংবাদ যখন মায়া, সাবেরী এবং তার পুত্র জানতে পারে তখন তাদের প্রতিক্রিয়ায় ভিন্নতা দেখি। সাবেরী অপ্রয়োজনেই হাঁটাহাঁটি করে, সাবেরী পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ দিয়ে ডিম খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। একধরণের পলায়ন আমরা প্রত্যক্ষ করি। ঘটনার ঘাত থেকে নিজেকে দূরে সরে নেওয়ার কৌশল হিসাবে। কিছু পরেই দেখি স্থিরতা, ছেলেটা দেয়ালের দিকে মুখ করে শূন্য দৃষ্টিতে, মায়ার আয়নায় মুখ দেখা আর সাবেরী বাথটবে পানি ছেড়ে বসে থাকা। নিরবতা। যে ঘাত থেকে তারা দূরে সরে যেতে চেয়েছিল তা যেন আরো প্রগাঢ় হয়ে তাদের বুকে চেপে বসে।<br /> চলচ্চিত্রটিতে একটিই মাত্র গান। সেটির প্রয়োগমুহূর্তটি অসাধারণ। সম্পর্ক ছিন্নের পর তৃষ্ণার্ত জাভেদ পানি খেতে গিয়ে পানিশূন্য জগ পায়। প্রতীকীভাবে আমাদের জানিয়ে দেয়া যে, ভালোবাসার সব আধারই বর্তমান ছিল কিন্তু তা আজ শূন্য। চলে আসার সময় কন্যা সাবেরী একগ্লাস পানি হাতে ছুটে আসে জাভেদের কাছে। পানি এগিয়ে দেয়, জাভেদ পানি খায়। অনেকক্ষণ ধরে গ্লাসটা ধরে রাখে। সাবেরীর কান্নাচাপা মুখ। এই সময় ‘ আহারে জীবন...’ গানটি আমাদের তন্ত্রীর সবকটা তার ছিঁড়ে ফেলতে চায়। বাবা হিসাবে, প্রাণপ্রিয় সন্তান হিসাবে সাবেরীকে আদর করার যে অধিকার, তা হারিয়ে জাভেদকে যেন দেখি গ্লাসে লেগে থাকা কন্যার স্পর্শটিকেই সে অনুভব করছে, আদর করছে। আসলে এই চলচ্চিত্রটিতে জাভেদ ও সাবেরী এই দুটি চরিত্রকেই মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তার সমস্ত হৃদয় দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। পিতা ও কন্যা। ফ্রয়েড সাহেব কি উপস্থিত হবেন না এখানে? হয়েছেনও তিনি। তাইতো সাবেরীকে দেখি স্কুলবন্ধু নিতুর এই বাবা অপহরণকে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। সে অবান্তর যুক্তির অবতারণা করে নিজের সান্ত্বনা খোঁজে যে, সবকিছুতেই জয়ী তাকে হারাতে না পেরে নিতু তার বাবাকে ছিনিয়ে নিয়ে জয়ী হতে চেয়েছে। আসলে নিতু তার সমবয়সী একজন নারীর কাছে নিজের হেরে যাওয়াটাকে মেনে নিতে পারে না। এটাই ফ্রয়েডিও কমপ্লেক্স। ফলে পরবর্তীতে চলচ্চিত্র জুড়েই পিতা কন্যার এই দ্বৈরথ আমরা প্রত্যক্ষ করি। তাদের মনোকষ্ট, পীড়ন, হাহাকারে আমাদের হৃদয়ে বেদনার বৃষ্টি ঝরে।</p> <p>এরকম অসম্ভব অনুভব, নিরবতা আর অপ্রকাশের ভাষা চলচ্চিত্রটির পাতায় পাতায়। মোস্তফা সরয়ার ফারুকী যেন এই ‘ডুব’ চলচ্চিত্রটিতে এসে পূর্বতন তার গল্প বলার সমস্ত কৌশলকে ভেঙে ফেলে নতুন এক কাব্যিক দ্যোতনা আমাদের সামনে উপস্থিত করতে চান। পিঁপড়াবিদ্যা দিয়ে তিনি যে মনোজাগতিক চলচ্চিত্রের হাত মসকো করেছিলেন তার সার্থকতা আমরা দেখি ‘ডুব’ চলচ্চিত্রটিতে এসে। শিল্পের যে ভাষাটি তিনি এই চলচ্চিত্রের মাঝে উপস্থিত করেছেন তার প্রয়োগ কিছুপূর্বে বাংলা চলচ্চিত্রে খুব একটা দেখা যায় না। ‘ডুব’ চলচ্চিত্রটিকে কাব্যাশ্রয়ী বলছি এ কারণে যে, একটি ভালো কবিতার যেসব সদগুণ বর্তমান থাকতে হয় যেমন উপমার, অলংকার এর সার্থক প্রয়োগ, নিরবতা ও অপ্রকাশের ক্ষণ নির্ধারন, দর্শন, মেদহীনতা, সর্বোপরি পাঠকের মনোজগতে জারণ। তার পুরোটাই বর্তমান এই চলচ্চিত্রটিতে। স্বল্প সংলাপ, হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য, অনাড়ম্বর উপস্থাপনা, নিরবতা, দর্শন, দর্শকের মাঝে পূর্ণতার অতৃপ্তি।<br /> এতসব ভালোর মাঝখানে যেটুকু চোখ চুলকিয়েছে তা হলো, এক. জাভেদ চরিত্রটির বাংলা উচ্চারণ। পরিচালক এই দুর্বল দিকটি জানতেন বলেই হয়ত কিছুটা ইংরেজি সংলাপ জাভেদকে দিয়ে বলিয়েছেন। আর দুই. মৃত্যুর পর জাভেদের ফিরে আসা তার প্রাক্তন স্ত্রীর বাড়িতে। সেখানে জাভেদের মুখে এক চিলতে হাসিও দেখি। তিনি এটি কেন করেছেন, তা বোধগম্য হয় নি। যেখানে পুরো চলচ্চিত্রটিই বাস্তবানুগ, সেখানে হঠাৎ করেই এই ফ্যান্টাসি ভালো লাগে নি। যদি তিনি এর মধ্যে দিয়ে বোঝাতে চান যে, জাভেদের অতৃপ্ত আত্মা খুঁজে ফিরেছে মায়াকে, তার সন্তানদের কিংবা নিতুর সাথে তাঁর সংসারটা শেষ পর্যন্ত খুব সুখকর ছিল না। তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এই একটি বারই তিনি বাহুল্য দৃশ্যের অবতারণা করেছেন।<br /> এইটুকু বাদ দিলে একটা ধন্যবাদ তো জানানোই যেতে পারে। ধন্যবাদ মোস্তফা সরয়ার ফারুকী । ‘ডুব’ দেখানোর জন্য এবং অন্তর্গত নিমজ্জনে পতিত হওয়ার জন্য।</p> <p><em> রবিউল করিম, কথাসাহিত্যিক ও মিডিয়াকর্মী</em></p>