<p>ফলটি দেখতে টমেটোর মতোই। তবে আকারে তুলনামূলক ছোট। বৃতি দ্বারা আবৃত থাকে। ব্যবহার মূলত সবজি হিসেবে। বাইরেটা সাধারণত উজ্জ্বল সবুজ। ভেতরের অংশ মাংসল ও দৃঢ়। বেশ রসালো ও ক্ষুদ্রাকৃতির অসংখ্য বীজসম্পন্ন। সোলানেসি গোত্রভুক্ত ফলটির নাম টমাটিলো। মেক্সিকান এই সবজির বৈজ্ঞানিক নাম Physaslis ixocarpa/philadelphica|</p> <p>টমাটিলো ফুল থেকে পরিপক্ব ফল হওয়া অবধি বৃতি দ্বারা আবৃত থাকে। সেই সুবাদে কোনো রকম রাসায়নিক ব্যবহার ছাড়াই এই ফল পোকামাকড় ও পাখির আক্রমণ থেকে নিরাপদ রাখা যায়। কচি টমাটিলো দেখতে দেশীয় বুনো বেগুন বা ফোসকা বেগুনের মতোই।<br /> তখন ফলের বৃতি থাকে সবুজ। পরিপক্ব হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি বাদামি রং ধারণ করে। পাকলে বৃতিটি ফেটে যায়। তখন বাইরে থেকে সবুজ টমাটিলো দৃষ্টিগোচর হয়। ওটাই ফল সংগ্রহের উপযুক্ত সময়।</p> <p>বাংলাদেশে সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে টমাটিলো নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কৌলিতত্ত্ব ও উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাহিদ জেবার তত্ত্বাবধানে চলে এর গবেষণা। দীর্ঘ চার বছর গবেষণার পর সাউ টমাটিলো-১ (সবুজ) ও সাউ টমাটিলো-২ (বেগুনি) নামের দুটি জাত ২০১৬ সালে কৃষক পর্যায়ে অবমুক্ত করেন এই কৃষিবিদ। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, ফেনীসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে এই সবজি কৃষক পর্যায়ে অবমুক্ত করা হয়েছে। এই দুটি জাত এখন বাংলাদেশে সফলভাবে চাষও করা হচ্ছে।</p> <p>ড. জেবা বলেন, রঙিন ফল হওয়ায় টমাটিলো উচ্চ মাত্রায় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। এতে  রয়েছে শর্করা, আমিষ, কপার, লোহা, ফসফরাস, ম্যাঙ্গানিজসহ অন্যান্য খনিজ উপাদান। এ ছাড়া রয়েছে ভিটামিন এ, বি, সি, ই এবং কে। টমেটোর তুলনায় এতে অধিক পরিমাণ খনিজ উপাদান বিদ্যমান। আরো থাকে উচ্চ মাত্রায় পেকটিন, যা রক্তের সুগার কমাতে সাহায্য করে। কোলেস্টেরল কমাতেও কার্যকর ভূমিকা রাখে এটি। এই ফল অধিক পুষ্টি উপাদান ও কম ক্যালরি-সম্পন্ন হওয়ায় ওজন কমাতে সাহায্য করে। উচ্চ মাত্রায় অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় ত্বক সতেজ রাখে। কোষ্ঠকাঠিন্য ও ডায়রিয়া প্রতিরোধী উপাদানও রয়েছে এতে।</p> <p>এই কৃষিবিদ জানান, বাংলাদেশে বহুল পরিচিত টমেটোর মতো টমাটিলোতে লাইকোপেন নেই। এই ফলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ‘ইক্সোকারপাল্যাক্টোন-এ’। এই রাসায়নিক পদার্থ ক্যান্সার কোষ ও ব্যাকটেরিয়া কোষের কার্যক্রম প্রতিরোধ করে। আর এতে উচ্চ মাত্রার দ্রবণীয় ডায়েটারি ফাইবার ‘পেকটিন’ বিদ্যমান।</p> <p>আবাদ : টমাটিলো মূলত শীতকালীন সবজি। অক্টোবর থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে ফলের বীজ বপন করতে হয়। চারা গজানোর ২০ থেকে ২২ দিনের মধ্যে মূল জমিতে স্থানান্তর করতে হয়। জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে শুরু করে এপ্রিল পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা যায়। সুষ্ঠু পরাগায়ণের জন্য জমিতে বা বাগানের টবে অন্তত দুটি টমাটিলো গাছ থাকতে হয়। কেননা এরা স্বপরাগায়ণে অক্ষম। টমেটোর তুলনায় এতে ২০ থেকে ২৫ দিন আগে ফুল ফোটে। সাউ টমাটিলো-১-এর প্রতিটি গাছে ফলের সংখ্যা থাকে গড়ে ৭০টি। ফলের গড় ওজন ৭৩ গ্রাম। প্রতি হেক্টরে গড় উৎপাদন ৭০ টন। তবে গত বছর উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে হেক্টরপ্রতি ৮০ টন করে ফলন পাওয়া গেছে বলে জানান ড. জেবা। সাউ টমাটিলো-২-এর প্রতি ফলের গড় ওজন ৩৫-৪০ গ্রাম এবং প্রতি হেক্টরে গড় উৎপাদন ৫০ টন।</p> <p>ড. নাহিদ জেবা জানান, সাউ টমাটিলো-২-এর ফলন কম হলেও তা সাউ টমাটিলো-১-এর চেয়ে স্বাস্থ্যকর। আর টমাটিলো মেক্সিকান সবজি হলেও সে দেশের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশে তিন গুণ ফলন মিলছে। উপযুক্ত আবহাওয়া, জলাবায়ু, মাটির উর্বরতা ও অনুকূল পরিবেশের কারণে এই বাড়তি ফলন পাওয়া সম্ভব হচ্ছে।</p> <p>টমাটিলোর জমিতে হেক্টরপ্রতি ১০ টন গোবর, ৫৫০ কেজি ইউরিয়া, ৪৫০ কেজি টিএসপি এবং ২৫০ কেজি এমওপি প্রয়োগ করতে হবে। জমিতে শেষ চাষের সময় টিএসপি ও এমওপি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে হয়। পরে ইউরিয়া উপরি প্রয়োগ করতে হয়। তবে মাটির উপাদানের ভিন্নতার কারণে এমওপি এক-দুবার উপরি প্রয়োগের প্রয়োজন হতে পারে। নিয়মিত আগাছা দূর করতে হয়। আর ফলের ওজন বেশি হওয়ায় উপযুক্ত খুঁটি দিয়ে গাছ সোজা রাখতে হয়।</p> <p>কৃষিবিদ ড. জেবার মতে, টমাটিলো উচ্চ ফলনশীল, স্বল্পমেয়াদি, সুস্বাদু, বহুমুখী ব্যবহার উপযোগী, পরিবেশবান্ধব ও উচ্চ ভেষজ গুণসম্পন্ন একটি ফল। তিনি মনে করেন, এটি চাষ করে কৃষকরা দ্বিগুণ লাভবান হতে পারেন। কারণ টমেটোর চেয়ে টমাটিলোর ফুল ও ফল আগে ধরে। স্বল্প সময়ের মধ্যে এই ফসল পাওয়া যাওয়ায় কৃষকরা মধ্যবর্তী ফসল হিসেবে অন্য আরেকটি ফসল চাষ করতে পারে। সংগ্রহের পর ৩০ দিনের বেশি সময় ধরে এটি সংরক্ষণ করা যায়। টমাটিলো কাঁচা বা রান্না করে খাওয়া যায়। জ্যাম, জেলি, আচার, সস, সুপ ও সালাদ হিসেবেও খাওয়া যাবে।</p> <p> </p>