ভূমিকা
বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত। দেশের পুষ্টি সরবরাহ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র্য বিমোচনে পোল্ট্রি শিল্পের ভূমিকা অপরিসীম। ওয়ার্ল্ড পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউপিএসএ) এই খাতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তবে বাস্তবে এটি একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। ডব্লিউপিএসএ-বিবি (বাংলাদেশ শাখা) মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে, যার ফলে স্থানীয় খামারি, গবেষক ও শিক্ষাবিদরা কাঙ্ক্ষিতভাবে সম্পৃক্ত হতে পারছেন না।
ডব্লিউপিএসএ-এর লক্ষ্য ও বর্তমান বাস্তবতা
ডব্লিউপিএসএ-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অত্যন্ত মহৎ:
লক্ষ্য
একটি সুস্থ ও অপুষ্টিমুক্ত জাতি গঠন।
পুষ্টি সংবেদনশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
মিশন:
পোল্ট্রি শিল্পের প্রসার ঘটিয়ে অপুষ্টি দূরীকরণ।
পোল্ট্রি বিজ্ঞান সম্পর্কে শিক্ষাদান, গবেষণা ও সচেতনতা বৃদ্ধি।
মূল্যবোধ:
"বিশ্বকে খাওয়ানোর জন্য একসঙ্গে কাজ করা।"
"গবেষণা ও শিক্ষার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি।"
"কম খরচে বেশি করা।"
তবে বাস্তবতায় দেখা যায়, ডব্লিউপিএসএ-বিবি প্রধানত ঢাকার নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভরশীল এবং বিভাগীয় ও প্রান্তিক পর্যায়ে সংযোগ স্থাপনে ব্যর্থ।
এটি বর্তমানে একটি অভিজাত ক্লাবের মতো কাজ করছে, যেখানে সাধারণ কৃষক ও খামারিরা অংশ নিতে পারছেন না।
বাংলাদেশে ডব্লিউপিএসএ-এর কার্যক্রম: সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পের উন্নয়নে ডব্লিউপিএসএ-বাংলাদেশ শাখার একাধিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা এর অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করছে।
ঢাকাকেন্দ্রিক কার্যক্রম ও একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ
ডব্লিউপিএসএ-বিবি মূলত ঢাকা শহরের নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত হয়, যা বিভাগীয় ও প্রান্তিক পর্যায়ে সংযোগ স্থাপনে ব্যর্থ।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও তাদের সাথে কার্যকর সংযোগ স্থাপন করা হয়নি।
স্থানীয় কৃষকদের মতামত বা অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।
বিভাগীয় শাখাগুলোর দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতা
সম্প্রতি ডব্লিউপিএসএ বিভাগীয় শাখা গঠন করলেও এগুলো কার্যকর কোনো দায়িত্ব বা ক্ষমতা পায়নি।
কেন্দ্রীয় কমিটি ও বিভাগীয় শাখার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব থাকায় তথ্য আদান-প্রদান ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
একগুঁয়ে নীতিমালা ও অভিজাতদের জন্য বরাদ্দ কার্যক্রম
১৩তম ডব্লিউপিএসএ পোল্ট্রি শো (১৮-২২ ফেব্রুয়ারি, ঢাকা) উপলক্ষে আয়োজিত টেকনিক্যাল সেমিনারে শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু অংশগ্রহণকারী সুযোগ পাচ্ছেন।
স্থানীয় বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও খামারিদের উপস্থিতির সুযোগ রাখা হয় নাই।
পোল্ট্রি খাতের সমস্যাগুলো নিয়ে নীতি-নির্ধারকদের সাথে বাস্তব আলোচনার কোনো ব্যবস্থা নেই।
ডব্লিউপিএসএ-এর কাঠামোগত পরিবর্তন কেন প্রয়োজন?
যদি ডব্লিউপিএসএ-বিবি প্রকৃত অর্থে দেশের পোল্ট্রি খাতের উন্নয়ন করতে চায়, তবে এর কাঠামোগত পরিবর্তন অপরিহার্য।
নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করা জরুরি:
গ্রামীণ কৃষক ও স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করা
ডব্লিউপিএসএ-এর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কৃষকদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।
বিভাগীয় পর্যায়ে নিয়মিত কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ পরিচালনার মাধ্যমে পোল্ট্রি বিজ্ঞানকে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছাতে হবে।
কেন্দ্রীয় ও বিভাগীয় শাখার মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করা
বিভাগীয় শাখাগুলোকে স্বায়ত্তশাসিত ক্ষমতা দিতে হবে এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে।
গবেষণা, প্রশিক্ষণ এবং পোল্ট্রি খাত উন্নয়ন সংক্রান্ত তথ্য সর্বস্তরে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
টেকনিক্যাল সেমিনার ও পোল্ট্রি শোতে বৈচিত্র্যময় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা
শুধুমাত্র নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর জন্য নয়, বরং দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় কৃষক ও বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
পোল্ট্রি শো ও টেকনিক্যাল সেমিনারের স্থান ঢাকায় সীমাবদ্ধ না রেখে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে আয়োজন করতে হবে।
ডব্লিউপিএসএ-বিবি-এর একচেটিয়া মনোভাব পরিহার করা
ডব্লিউপিএসএ-বিবি-কে একটি উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণমুখী সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষকদের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।
উপসংহার
ডব্লিউপিএসএ-বিবি যদি প্রকৃত অর্থে দেশের পোল্ট্রি খাতকে সমৃদ্ধ করতে চায়, তবে এর কাঠামোগত ও নীতিগত সংস্কার প্রয়োজন। একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে সমান সুযোগ, ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব ও বাস্তবসম্মত সমন্বয় নিশ্চিত করা আবশ্যক। না হলে, এটি শুধুমাত্র একটি অভিজাত শ্রেণির সংগঠন হিসেবেই থেকে যাবে, যার সুফল সাধারণ খামারি বা গবেষকদের কাছে পৌঁছাবে না। দেশের পোল্ট্রি শিল্প ও কৃষকদের কল্যাণে ডব্লিউপিএসএ-এর কার্যক্রমকে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক : ডেপুটি চিফ ভেটেরিনারিয়ান, ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, এবং সভাপতি (২০২৩-২৪), রোটারি ক্লাব অফ রাজশাহী সেন্ট্রাল; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ লাইভস্টক সোসাইটি (বিএলএস), যুগ্ম নির্বাহী সম্পাদক (বাংলাদেশ লাইভস্টক জার্নাল; আইএসএসএন ২৪০৯-৭৬৯১), সভাপতি, বিবিসিএফ, রাজশাহী এবং সম্পাদক, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), রাজশাহী ।