<p>রাজধানী ঢাকায় বেশির ভাগ ভবন আগুনের ঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে ৬০২টি প্রতিষ্ঠান ঝুঁকিপূর্ণ। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১২৭টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।</p> <p>গত বৃহস্পতিবার বেইলি রোডে সাততলা ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় ঢাকার অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।</p> <p>এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগুন লাগার ক্ষেত্রে ঢাকায় অনেক প্রতিষ্ঠান ঝুঁকিপূর্ণ ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ঢাকার এক হাজার ২০৯টি প্রতিষ্ঠানে জরিপ চালিয়ে আমরা এসব তথ্য পেয়েছি।’</p> <p>এর আগে ঢাকায় বড় কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর ভবনগুলোর ওপর বিশেষ জরিপ চালায় ফায়ার সার্ভিস। হাসপাতাল, মার্কেট, আবাসিক হোটেল ও উঁচু ভবনগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। সেখানে বলা হয়, ঢাকার বেশির ভাগ ভবনই অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে।</p> <p>ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার ৯৬ শতাংশ বিপণিকেন্দ্র, ৯৮ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ৯৮ শতাংশ হাসপাতাল-ক্লিনিক অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে।</p> <p>ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, যেকোনো ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার ক্ষেত্রে পরিদর্শনের সময় ভবনের মাটির নিচের জলাধারের ধারণক্ষমতা, অবস্থানকারীর সংখ্যা, প্রবেশদ্বারের প্রশস্ততা, ধোঁয়া ও তাপ শনাক্তকরণ যন্ত্রের উপস্থিতি, মেঝের আয়তন, জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, লিফটসহ অন্যান্য বিষয় খতিয়ে দেখা হয়। এরপর ভবনগুলোকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ ও ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে শনাক্ত করা হয়।</p> <p>এ বিষয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিবছর আমরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আপডেট করি। আমরা ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার পর বাকি কাজ রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। এ ক্ষেত্রে আমাদের এখতিয়ার একেবারেই সীমিত। এনফোর্সিং এবং রেগুলেশন ক্যাপাসিটি নেই। ঝুঁকিপূর্ণ ভবন আমাদের সিলগালা করার অধিকার দেয়নি সরকার। দেখা যাচ্ছে, অনেকেই লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করে যাচ্ছে। পুলিশ তাদের কিছু বলছে না।’</p> <p>লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে মালিকদের চিঠি দিই। আমাদের কাজ সমস্যা চিহ্নিত করা, মানুষকে সচেতন করা। বল প্রয়োগ করা আমাদের কাজ নয়। যারা মানছে না, আমরা তাদেরও চিহ্নিত করি। আইন প্রয়োগ করার জন্য অন্য সংস্থা রয়েছে।’</p> <p>সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার বিষয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে প্রাথমিক পর্যায়ে অগ্নিনির্বাপণ করতে পারছি না। ফলে আগুন নানা কারণে বড় হয়ে যায়।’ তবে তিনি সবাইকে বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ ও মহড়া আয়োজন করার অনুরোধ জানান।</p> <p>এ বিষয়ে তিনি পরামর্শ দেন, সিঁড়িতে ও দোকানের সামনে মালপত্র স্তূপ করে রাখা যাবে না। আর মার্কেটের ভেতরে কোনো ধরনের ধূমপান করা যাবে না। অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের শুরুতেই ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিতে হবে। ফায়ার সার্ভিসকে নির্বিঘ্নে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে।</p> <p>ফায়ার সার্ভিস সূত্র বলছে, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বহুতল ভবনের খাবারের দোকানে গ্যাসের চুলা রয়েছে। সেখানে অরক্ষিতভাবে রাখা হয়েছে বিভিন্ন সিলিন্ডার। সে কারণে পুরো ভবন অরক্ষিত। বেশির ভাগ মার্কেট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে আগুনের ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আসছে না।</p> <p><strong>পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ</strong></p> <p>বেইলি রোডের আগুনের ঘটনায় নতুন করে মার্কেটগুলোতে খোঁজ নিতে শুরু করেছে পুলিশ। প্রতিটি মার্কেটে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনসহ গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার খ. মহিদ উদ্দিন। গতকাল তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের তালিকভুক্তসহ যেসব মার্কেট অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে, সেখানকার সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির খোঁজ রাখছেন তাঁরা।</p> <p>এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘বিভিন্ন মার্কেট পরিদর্শন করে আমরা দেখেছি, কোথাও বিদ্যুৎ সমস্যা, আবার কোথাও ফায়ার (আগুন সমস্যা)। তাই সমস্যা এখন যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, ফায়ারে দায়িত্বশীলরা বলেন তিন-চার কোটি টাকার ফায়ার সেফটি সরঞ্জাম লাগবে। এখন প্রশ্ন হলো, এত বড় অঙ্কের টাকা আমরা কোথায় পাব? সরকার বলছে, ফায়ার সেফটির জন্য যত সরঞ্জাম লাগবে, সেগুলো ট্যাক্স ফ্রি থাকবে। এটা দেশের মানুষের জন্য করা হচ্ছে। তবে আমরা যখন বিভিন্ন সংস্থার কাছে যাচ্ছি, তখন তারা সেই কাজটি করছে না।’</p> <p><strong>অগ্নিঝুঁকিতে থাকা বিপণিকেন্দ্র</strong></p> <p>গত এপ্রিলের জরিপ সূত্রে ফায়ার সার্ভিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে ৯টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট ভবন রয়েছে। এগুলো হলো নিউ মার্কেট রোডের গাউছিয়া মার্কেট, গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়ার বরিশাল প্লাজা, রাজধানী ও নিউ রাজধানী সুপারমার্কেট, চকবাজারের আলাউদ্দিন মার্কেট, শাকিল আনোয়ার টাওয়ার, শহিদুল্লাহ মার্কেট, সদরঘাটের শরীফ মার্কেট, মায়া কাটারা (২২ মার্কেট) ও সিদ্দিকবাজারের রোজনীল ভিস্তা।</p> <p>মাঝারি ধরনের অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে জুরাইনের আলম সুপারমার্কেট, খিলগাঁওয়ের উত্তরা মার্কেট, ডেমরার সালেহা শপিং কমপ্লেক্স, মনু মোল্লা শপিং কমপ্লেক্স, দোহারের জয়পাড়ার লন্ডন প্লাজা শপিং মল, ওয়ারীর র‌্যাংকিন স্ট্রিটের এ কে ফেমাস টাওয়ার, রোজভ্যালি শপিং মল, নিউ মার্কেটের মেহের প্লাজা, মিরপুর রোডের প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টার, নিউ চিশতিয়া মার্কেট, নেহার ভবন, এলিফ্যান্ট রোডের ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং কমপ্লেক্স, ইসমাইল ম্যানশন সুপারমার্কেট, সুবাস্তু এরোমা শপিং মল। এসব ভবন ছাড়াও আরো ৩৫টি ভবন রয়েছে অগ্নিঝুঁকিতে।</p> <p><strong>দেশে ৪২৪ প্রতিষ্ঠান অতি ঝুঁকিতে</strong></p> <p>ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, গত বছরের জরিপে সারা দেশে এক হাজার ৬৯৪টি ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৪২৪টি প্রতিষ্ঠান অতি ঝুঁকিপূর্ণ। পাঁচ হাজার ৩৭৪টি প্রতিষ্ঠানে জরিপ চালিয়ে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে রাজশাহী বিভাগে ৩৮৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫১টি ঝুঁকিপূর্ণ, অতি ঝুঁকিতে ১১টি। খুলনায় ৮৭৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ২৯৮টি, অতি ঝুঁকিতে ছয়টি। রংপুরে ৬৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ৯৪টি, অতি ঝুঁকিতে ১৯টি। সিলেটে ২৫৩টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪৪টি ঝুঁকিপূর্ণ। ময়মনসিংহে ৯৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ চারটি, অতি ঝুঁকিতে ছয়টি। চট্টগ্রামে এক হাজার ৪৮৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ৫২৪টি, অতি ঝুঁকিতে ২৪৬টি। বরিশালে ৪৩৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ ৭৭টি, অতি ঝুঁকিতে ৯টি।</p>