<p>বন তথা আবাস উজাড়, চোরা শিকার ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের মতো বিভিন্ন কারণে প্রতিবছর পৃথিবী থেকে  কোনো না কোনো বন্য প্রাণী চিরতরে বিলুপ্ত হচ্ছে বা বিলুপ্তির মুখে পড়ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রাণী বিলুপ্ত হওয়ার হার আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। বাংলাদেশ থেকে এরই মধ্যে প্রায় ৩০০ প্রজাতির বন্য প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। আরো এক শর বেশি প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। ফলে আগামী দিনে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কাও বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।</p> <p>এমন প্রেক্ষাপটেই বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবস’। ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ৬৮তম সাধারণ অধিবেশনে ৩ মার্চকে বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০১৪ সালে প্রথম দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্বের বন্য প্রাণী এবং উদ্ভিদকুল বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এই দিবসের মূল লক্ষ্য।</p> <p>প্রাণ ও পরিবেশ সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংগঠন দ্য ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন ইউনিয়ন (আইইউসিএন) বাংলাদেশ শাখার গবেষণায় দেখা গেছে, এরই মধ্যে দেশের দেড় শ প্রজাতির বন্য প্রাণী, ৪৭ প্রজাতির দেশি পাখি, আট প্রজাতির উভচর প্রাণী, ৬৩ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী এবং ১০টি স্তন্যপায়ী প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। একইভাবে ১০৬ প্রজাতির উদ্ভিদ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে।</p> <p>বাংলাদেশের এক হাজার ৬০০ প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে ৫০টিরও বেশি প্রজাতি বিলুপ্তির ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে লাল তালিকাভুক্ত করেছে আইইউসিএন। আইইউসিএনের লাল তালিকাভুক্ত প্রাণীদের অন্যতম বন্য হাতি। প্রাণীটি দেশে ‘চরম সংকটাপন্ন’ অবস্থায় রয়েছে। বাংলাদেশের বনাঞ্চলে ২৮৬টি এবং বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন চিড়িয়াখানা বা সাফারি পার্কে ৯৬টি হাতি রয়েছে। বুনো হাতির সংখ্যা গত কয়েক বছরে আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে। শুধু ২০২১ সালেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৩০টির বেশি হাতির অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে অভিযোগ রয়েছে।</p> <p>বিশেষজ্ঞরা বলেন, কয়েক দশক আগেও কিছু শহরের বাইরের জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে চিতাবাঘ দেখা যেত। এখন জঙ্গলেও এই প্রাণীটি চরম সংকটাপন্ন। সারা বিশ্বে বিপন্ন বা সংকটাপন্ন না হলেও বাংলাদেশে চিতাবাঘকে চরম সংকটাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করেছে আইইউসিএন।</p> <p>ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততার প্রভাবে সুন্দরবনের অনেক প্রাণী এখন বিপন্ন। চোরা শিকার ও বনের খালে বিষ প্রয়োগের মতো ঘটনা বেঙ্গল টাইগারসহ বিভিন্ন প্রাণীকে হুমকির মুখে রেখেছে। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন বন ও জলাশয়ে থাকা উল্লুক, ঘড়িয়াল, মেছোবাঘ, বনরুই, বনগরু, অজগর, রাজ গোখরা, বনবিড়াল, ভোঁদড়, শকুন, বিরল জাতের কচ্ছপ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। টিকে থাকা বন্য প্রাণীরাও পরিবর্তিত পরিবেশে বিপন্ন। সংখ্যায় অর্ধেক প্রজাতিই এখন কোনো না কোনো ধরনের হুমকির মুখে আছে।</p> <p>বিশেষজ্ঞদের মতে, জনসংখ্যার চাপ, ব্যাপক হারে বন উজাড়, বন্য প্রাণী শিকার ও পাচার, জলাভূমি ধ্বংস ও নদীর নাব্যতা হ্রাস, অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার এবং অসচেতনতা ও অবহেলার কারণে বন্য প্রাণীদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। সাম্প্রতিককালে পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব। এ অবস্থা চলতে থাকলে এক সময় দেশ জীববৈচিত্র্য শূন্য হয়ে পড়তে পারে। তাতে দেখা দেবে পরিবেশগত বিপর্যয়।</p> <p>বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে মোট বন্য প্রাণীর ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ আগামী কয়েক বছরেই বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক ও ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)র সদস্যসচিব শরীফ জামিল। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রকৃতির প্রতি মানুষের নৃশংসতা, পরিবেশদূষণ ও পরিবর্তিত জলবায়ুর কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আইন ও নীতিমালার সঠিক প্রয়োগের অভাব সংকটকে আরো গুরুতর করছে। তাই আইনের সঠিক প্রয়োগ ও ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তোলা দরকার।</p> <p>বনাঞ্চলগুলো ধীরে ধীরে মানুষের দখলে চলে যাওয়ায় বন্য প্রাণীদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে মনে করেন সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বন কেটে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল দখল করা হচ্ছে। প্রাণীর আবাসে মানুষের আবাস হচ্ছে, তাহলে প্রাণীরা কই যাবে?’</p> <p>মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, বিলুপ্তপ্রায় বন্য প্রাণী রক্ষায় ও অবৈধভাবে পাচার প্রতিরোধে পুলিশ নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। ২০২৩ সালে ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, সিরাজগঞ্জ, খুলনা, সাতক্ষীরা, ফেনীসহ দেশব্যাপী ২৪টি অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানে বিপন্ন প্রজাতির ভালুক শাবক, হগ ব্যাজার, হনুমান, উল্লুক, রাজধনেশ, কোকিল, টিয়া, ময়না, কাঠবিড়ালি, বানরসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণী উদ্ধার করা হয়। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে বন্য প্রাণী আইন-২০১২ অনুযায়ী বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ ছাড়া জনগণের মধ্যে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে।</p>