গত আড়াই বছর এক রকম পালিয়ে বেড়িয়েছেন ব্লগার নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নিলয়। ফেসবুকে ও ব্লগে লেখালেখি করলেও চলাফেরা করতেন অনেকটা গোপনে। নিজের অবস্থান গোপন করার জন্য ঢাকায় বসবাস করেও ফেসবুক পেজের 'কারেন্ট সিটি'তে লিখেছিলেন কলকাতার নাম। হুমকির কারণে কর্মস্থলও বদল করেছেন তিনি।
ব্লগারদের পাশে কেউ নেই
এস এম আজাদ

এখন নিহত নিলয়ের মতোই চরম ভয়, উৎকণ্ঠা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন তালিকাভুক্ত আরো ৮১ জন ব্লগার। আতঙ্কে আছেন অনেকেই। কারণ মুক্তচিন্তা বা যুক্তিবাদী লেখালেখির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁদেরও হুমকি দেওয়া হয়েছে বিভিন্নভাবে। নিহতদের স্বজন, সহকর্মী ও সুধীসমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, ব্যক্তিজীবনের তথ্য না জেনে 'নাস্তিক' বলে তালিকা প্রকাশের পর ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ডে চরম উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে সক্রিয় হওয়ার পরই কয়েকজন ব্লগারের সূত্র ধরে প্রগতিশীল সব ব্লগারকেই কৌশলে নাস্তিক বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। একটি সংগঠন তালিকা করে সরকারের কাছে তা জমাও দিয়েছে। কথিত সেই নাস্তিকদের বিচারের দাবি আংশিক রক্ষাও করেছে সরকার। তবে একের পর এক হত্যাকাণ্ড এবং হুমকির ঘটনা ঘটলেও এসবের নেপথ্যে কারা, তা বের করতে পারছে না পুলিশ ও গোয়েন্দারা। আনসার আল-ইসলাম, আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, আনসারুল্লাহ বাংলা ৭, আনসারুল্লাহ বাংলা ৮ বা ১৩-এর নামে হত্যার দায় স্বীকার করা হচ্ছে। প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হচ্ছে এসব নামে। অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব সূত্র ধরে খুনি ও হুমকিদাতাদের শনাক্ত করা সম্ভব। কিন্তু ব্লগারদের নিরাপত্তার বিষয়ে সরকার উদাসীন বলেই তা হচ্ছে না।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল বলেন, 'এখন তথ্যপ্রযুক্তির অনেক উন্নতি হয়েছে। এর পরও একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে আর পুলিশ খুনিদের শনাক্ত করতে পারছে না। অল্প সময়ের মধ্যে এ ঘটনাগুলো ঘটেছে। কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হলে এমনটি হতো না। এটি খুবই দুঃখজনক।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, 'হুমকির বার্তা প্রকাশ করে হত্যা করা এবং হত্যার দায় স্বীকার করার পরও খুনি গ্রেপ্তার না হলে এটি সমাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এতে বিভিন্ন গোষ্ঠী অপরাধে উৎসাহিত হয়ে উঠবে। হুমকি এবং দায় স্বীকারের সূত্র রয়েছে। এসব সূত্র ধরে তদন্ত হলে অপরাধী শনাক্ত করা সম্ভব।'
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আমরা যতই সোচ্চার হয়েছি ততই হুমকি এসেছে। তালিকা করে গ্রেপ্তার, হুমকি, হত্যার ঘটনার পরও আমরা পুলিশ প্রশাসনের সহায়তা পাইনি। নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে গণজাগরণ মঞ্চের প্রতিটি কর্মী। এদের মধ্যে যারা ব্লগে মুক্ত চিন্তার লেখালেখি করে তাদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।'
নিহত নিলয়ের স্ত্রী আশামনি জানান, ২০১৩ সালে ব্লগার রাজীব হায়দার খুন এবং ব্লগারদের তালিকা হওয়ার পর থেকেই অনলাইনে হুমকি পেয়েছেন নিলয়। এরপর তিনি গোড়ানের সরু গলির ভেতরে পাঁচতলা ভবনে বাসা ভাড়া নেন। কয়েক মাস আগে চাকরিস্থলও পরিবর্তন করেন। নিলয়ের ধারণা ছিল, খুনিরা তাঁর বাসা অবধি পৌঁছতে পারবে না। গত ১৩ মে শাহবাগ থেকে বাসায় রওনা হলে দুই যুবক তাঁকে অনুসরণ করে। বিষয়টি টের পেয়েছিলেন নিলয়। এরপর হয়তো তাঁর অজান্তেই তাঁর বাসা চিনে ফেলে ঘাতকরা। আশামনি বলেন, ভয়ে নিলয় কাউকে তাঁর বাসার ঠিকানা বলতেন না। ফেসবুকে কারেন্ট সিটির স্থলে কলকাতা লিখে রাখেন। আড়াই মাস আগে জিডি করতে গেলে পুলিশ তাঁকে দেশ ছাড়ার কথা বললে বেদায়দায় পড়ে যান নিলয়। সুযোগ থাকলেও দেশ ত্যাগের কোনো পরিকল্পনাই ছিল না তাঁর।
স্বজনরা জানান, নিলয় তাঁর মা-বাবার একমাত্র ছেলে। এ ছাড়া ভালোবেসে যাকে বিয়ে করেছেন, সেই আশামনি মুসলমান পরিবারের মেয়ে। এ ঘটনায় পরিবারে কিছুটা টানাপড়েন চলছিল। এ কারণেই মূলত তিনি দেশ ছাড়ার কথা চিন্তাও করতে পারেননি।
নিলয়ের সহকর্মী দেবজ্যোতি চৌধুরী বলেন, 'অনুসরণ করার আগেই ওকে ফোনে ও অনলাইনে হুমকি দেওয়া হয়েছে। উগ্রবাদী ব্লগার ফারাবির হিটলিস্টের তিন-চার নম্বরেই ছিল নিলয়ের নাম। এসব কারণে ও দুশ্চিন্তায় ছিল। আমাদের সে কথা বলেছে। আমরা সাবধানে থাকতে বলেছিলাম।' তিনি আরো বলেন, 'গত ১৫ মে সে খিলগাঁও থানায় গিয়ে হুমকির কথা বলেছিল। পুলিশ তখন দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেয়। আরো কয়েকজন ব্লগারকে এভাবে দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ চলেও গেছে।'
গবেষণা ও উন্নয়ন কানেকটিভিটি (আরডিসি) নামের একটি সংস্থায় কর্মরত ছিলেন নিলয়। এই সংস্থাটির চেয়ারম্যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল বলেন, 'আরডিসি'তে নীলের যোগদান বেশি দিনের নয়, মাত্র কয়েক মাস। এই স্বল্প সময়েই নিরাপত্তাহীনতার কারণে তিনি ঢাকার বাইরে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁর চাহিদা অনুযায়ী ঢাকার বাইরেও পাঠানো হয়। মফস্বল অঞ্চলে কাজ করতে না পারায় আবার ঢাকায় চলে আসেন। কিন্তু মাস খানেক আগে একই কারণে চাকরি ছেড়ে দেন।'
নিলয়ের স্বজনদের অভিযোগের সূত্র ধরে জানা গেছে, গত ১৫ মে খিলগাঁও থানায় ডিউটি অফিসার ছিলেন এসআই রফিকুল ইসলাম এবং এসআই ফকরুল ইসলাম। তাঁরা দুজন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, 'অভিযোগ দিতে গিয়েছেন কি না এবং সে ব্যাপারে পুলিশের গাফিলতি ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে আমরা তিন সদস্যের একটি কমিটি করেছি। এই কমিটির প্রধান এডিসি তারেক বিন রশিদ।'
ব্লগারদের পলাতক জীবন : ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরুর পর কিছু ব্লগারের লেখালেখি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। 'নাস্তিক' আখ্যা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের ওপর চাপ তৈরি করে হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি সংগঠন। ওই বছর ৩১ মার্চ সেসব সংগঠনের পক্ষে আল বাইয়্যিনাত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ব্লগারদের নাম এবং ব্লগের নাম উল্লেখ করে একটি তালিকা দেয়। ওই তালিকা ধরে ব্লগারদের শাস্তি দাবি করে হেফাজত। সূত্র জানায়, ওই বছরের ১ এপ্রিল আসিফ মহিউদ্দীন, মশিউর রহমান বিপ্লব, সুব্রত অধিকারী শুভ ও রাসেল পারভেজকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই ব্লগাররা জামিনে ছাড়া পেয়ে আত্মগোপনে যান। তিনজন বিদেশে পাড়ি জমান।
সূত্র জানায়, ব্লগার রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডের পর আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আস্তানা থেকে দুটি 'হিটলিস্ট' উদ্ধার করে গোয়েন্দা পুলিশ। একটিতে ২০ জন এবং অন্যটিতে ৫৪ জনের নাম ছিল, যারা ৮৪ জনের তালিকাভুক্ত। এ ছাড়া গত বছর ফারাবীকে সিলেট থেকে গ্রেপ্তারের সময় আরেকটি হিটলিস্ট উদ্ধার করা হয়, যেখানে নিলয়, অভিজিৎ রায় ও অনন্ত বিজয়ের নাম ছিল। ৮৪ জনের তালিকায় নিলয়ের নাম না থাকলেও গ্রেপ্তারকৃত সুব্রতর সঙ্গে ইস্টিশন ব্লগে লিখতেন তিনি। তালিকায় নাম থাকা রাজীব, অভিজিৎ রায় এবং অনন্ত বিজয় দাশ ইতিমধ্যে খুন হয়েছেন। এতে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে সব ব্লগারের মধ্যেই।
ব্লগার অমি রহমান পিয়াল বলেন, 'আমি ও আরিফ জেবতিকসহ কয়েকজন ধর্ম নিয়ে কখনোই লেখালেখি করি না। আমরা যুদ্ধাপরাধ ইস্যু ও সামাজিক ইস্যুতে লিখি। অথচ আমাদের ব্লগকেও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। আমাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে।' তিনি আরো বলেন, 'বাংলাদেশে অনলাইনে ব্লগে ২০০৬ সাল থেকেই লেখালেখি হচ্ছে। অথচ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আমরা যখন শাহবাগে জড়ো হলাম তখনই নাস্তিক ইস্যু তোলা হলো। আমরা যারা বিচারের দাবিতে সোচ্চার হলাম তাদের ওই তালিকায় ফেলে দেওয়া হলো। এতে স্পষ্ট যে এটি কোনো মহলের ষড়যন্ত্র। অথচ সরকার বিষয়টি নিয়ে কিছুই করেনি।'
ব্লগার মাহমুদুল হক মুন্সী জানান, 'আমাকে ফেসবুকে এবং টেলিফোনে বার বার হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। অথচ আমি আক্রমণ করে কিছু লিখিনি। সম্প্রতি পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও করেছি। পুলিশ কয়েক দিন আমার বাসার সামনে ঘুরেছে, কিন্তু যারা আমাকে হত্যার হুমকি দিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করেনি।'
'একুশ তাপাদার' ব্লগার (ছদ্মনাম) তার পলাতক জীবনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন, 'আমাকে নিজের জীবনের রুটিনই পাল্টে ফেলতে হয়েছে। যেমন- আমি প্রতিদিন একই সময় ঘর থেকে বের হই না; একই সময় ঘরে ফিরি না। আমার অনেক পুরনো ব্লগ ডিলিট করে ফেলতে হয়েছে; হাইড করে ফেলতে হয়েছে।'
তালিকাভুক্ত আরেক ব্লগার পরিচয় না লেখার শর্তে বলেন, 'গত দুই বছরে আমি পাঁচটা বাসা বদল করেছি। ফোন নম্বর বদলেছি তিনবার। দুইটা চাকুরিও বদলেছি। অফিসে না যাওয়ার কারণে একটা চাকুরি চলে গেছে। এখন আমি ব্লগে লিখি না। তার পরও আতঙ্ক পিছু ছাড়ছে না। এভাবে থাকা যায় না। দেশের জন্য আবার নতুন করে আন্দোলনে নেমেছিলাম। হয়তো শেষ পর্যন্ত দেশই ছাড়তে হবে।'
হত্যা স্বীকার ও হুমকির পরও রহস্য অজানা : গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অভিজিৎ রায় খুনের পর ৩ মে ভারতীয় উপমহাদেশের আল-কায়েদার প্রধান আসিম উমর দায় স্বীকার করে একটি ভিডিও বার্তা ইন্টারনেটে তোলেন। তবে খুনিদের কোনা হদিস পায়নি তদন্তকারীরা। গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, 'হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সাতজনের সম্পৃক্ততা আমরা পেয়েছি। কিন্তু এই সাতজনের কেউ এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়নি। এফবিআই ল্যাবে আমাদের ১১টার মতো যে আলামত রয়েছে সেগুলোর ফলাফল এখনো আমাদের কাছে আসেনি।'
গত ১২ মে সিলেটে ব্লগার অনন্ত বিজয় দাশ খুন হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর দায় স্বীকার করে বার্তাটি এসেছিল আনসার বাংলা ৮ নামের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে। সেখানেই বলা হয়, আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ইদ্রিস আলী নামের সিলেটের এক ফটো সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হলেও রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। বিশেষ পুলিশ সুপার (সংঘটিত অপরাধ) মির্জা আব্দুল্লাহ-হেল বাকী বলেন, 'আমরা আলামত এবং তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে তদন্ত করছি। এখনো খুনি শনাক্ত হয়নি।'
গত ৩০ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়ী এলাকায় কুপিয়ে ব্লগার ওয়াশিকুরকে হত্যা করে পালানোর সময় জনতার হাতে ধরা পড়ে জিকরুল্লাহ ও আরিফুর রহমান নামের দুই মাদ্রাসাছাত্র। ডিবির এডিসি সাইফুল ইসলাম বলেন, 'আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ইকবাল, আব্দুল্লাহ ওরফে হাসিব, শরীফ, তাহের, আবরার, জিকরুল্লাহ, আরিফুল ও সাইফুল এই হত্যার পরিকল্পনায় ছিল। তবে পরিকল্পনাকারীসহ সংশ্লিষ্টদের হদিস পাওয়া যায়নি। তদন্ত চলছে।' ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পল্লবীতে ব্লগার রাজীব হত্যার ঘটনায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় সাবেক শিক্ষার্থীসহ আনসারুল্লাহর প্রধান মুফতি জসিম উদ্দিন রাহমানীকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। তবে পরিকল্পনাকারী রেদওয়ানুল আজাদ রানার নাগাল মেলেনি আড়াই বছরেও। গত বছর একইভাবে হত্যা করা হয় সিলেটে ব্লগার জগোজ্যোতি তালুকদার ও আশুলিয়ায় ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আশরাফুল আলমকে এবং ২০১৩ সালের ৯ এপ্রিল বুয়েটের আরিফ রায়হান দ্বীপকে।
এদিকে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ডাকযোগে চিঠি পাঠিয়ে দুই দফায় হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে আনসার বাংলা-১৩ নামে। এই হুমকিদাতার উৎসও খুঁজে পায়নি পুলিশ। নিলয়কে হত্যার পর প্রথমবারের মতো কালের কণ্ঠসহ কয়েকটি গণমাধ্যমে সরাসরি ই-মেইল পাঠিয়ে হত্যার দায় স্বীকার করা হয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার মুনতাসিরুল ইসলাম বলেন, 'দায় স্বীকারের সূত্র ধরে আমরা তদন্ত করছি।'

ছুটির ঘোষণা

পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ৩০-৩১ মার্চ ও ১ এপ্রিল কালের কণ্ঠ বন্ধ থাকবে। তাই ৩১ মার্চ এবং ১-২ এপ্রিল পত্রিকা প্রকাশিত হবে না। পবিত্র ঈদুল ফিতর ১ এপ্রিল হলে ৩ এপ্রিলও পত্রিকা প্রকাশিত হবে না। তবে ঈদের ছুটিতে কালের কণ্ঠ অনলাইন চালু থাকবে।
— সম্পাদক

শ্রমসচিবের গাড়ির সামনে টিএনজেড গ্রুপের শ্রমিক-কর্মচারীরা

বকেয়া বেতন ও বোনাসের দাবিতে টিএনজেড গ্রুপের শ্রমিক-কর্মচারীরা গতকাল বিজয়নগরে শ্রমসচিবের গাড়ির সামনে বসে পড়েন।ছবি : কালের কণ্ঠ
।
ব্যারিস্টার তানিয়া আমীরের দেশে জরুরি অবস্থা জারির উসকানি
কালের কণ্ঠ ডেস্ক

দেশে জরুরি অবস্থা জারির উসকানি দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর। ভারতের সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডেকে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এই উসকানি দেন।
গত বৃহস্পতিবার ‘বাংলাদেশ সেনাপ্রধানের মনে কী আছে’ (‘হোয়াট’স অন বাংলাদেশ’স আর্মি চিফ’স মাইন্ড?’) শিরোনামে ইন্ডিয়া টুডেতে একটি সংবাদ বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়। সেখানে মূলত সেনাপ্রধান বাংলাদেশের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়বেন কি না, তা নিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করা বিবিসি ও রয়টার্সের সাবেক সাংবাদিক সুবির ভৌমিকের লেখায় বলা হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান একজন রক্ষণশীল ও পেশাদার কর্মকর্তা, যিনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেন। তাঁর সহকর্মীরা জানান, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশে সামরিক শাসন কার্যকর নয়। ইতিহাস, বিশেষ করে পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা তাঁকে এই দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের উদ্ধৃতি দিয়ে সেখানে বলা হয়েছে, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে কঠোর দমন-পীড়ন না চালাতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে জাতিসংঘ সতর্ক করেছিল এবং তা কার্যকর হয়েছিল।
তবে ওয়াকার সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তিনি গুলি চালানোর অনুমতি দেননি এবং শেখ হাসিনা ও তাঁর উপদেষ্টাদের নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেন।
সম্প্রতি কিছু ব্লগার ও অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতারা অভিযোগ করেছেন, জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ভারতের প্রতি অনুগত এবং তিনি আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছেন। তবে সেনাপ্রধানের ঘনিষ্ঠরা বলেন, তিনি কোনো গোষ্ঠীর অনুগত নন, বরং তিনি পেশাদার ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অনুকরণ করে রাজনীতির বাইরে থাকতে চান।
এদিকে সেনাপ্রধান চাইলে দেশে জরুরি অবস্থা জারিতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে সমর্থন দিতে পারেন বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানিয়া আমীর।
আওয়ামী লীগপন্থী এই আইনজীবী বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন; আর এ ক্ষেত্রে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান তাঁকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করতে পারেন। এর ফলে রাষ্ট্রপতি অন্তর্বর্তী সরকার বাতিল করে দ্রুত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের আয়োজন করতে পারবেন। সেনাবাহিনী সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের কঠোর হস্তে দমন করতে পারবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সঠিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে।’
তবে তানিয়া আমীরের এমন মন্তব্য উড়িয়ে দিয়েছেন সেনা কর্মকর্তারা।
অন্যদিকে এক অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল, যাঁর অধীনে সেনাপ্রধান আগে চাকরি করেছেন, তিনি বলেন, ‘যদি মনে হয় তাঁকে (সেনাপ্রধান) সরিয়ে দেওয়ার গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তাহলে তিনি কঠোর ভূমিকা পালন করবেন।’
ইন্ডিয়া টুডের সংবাদ বিশ্লেষণে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সেনাপ্রধান সম্প্রতি আফ্রিকা সফর শেষে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘আমাকে এমন কিছু করতে বাধ্য করবেন না, যা আমি করতে চাই না।’ এতে বোঝা যায়, তিনি কঠোর অবস্থানে যেতে বাধ্য হতে পারেন, যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
উল্লেখ্য, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুষ্টিয়া-৪ আসন থেকে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করতে মনোনয়নপত্র কিনেছিলেন ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর। তাঁর বাবা ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম কিনেছিলেন কুষ্টিয়া-৩ আসনের জন্য।

রমজানে সহনীয় পণ্যের দামে স্বস্তিতে রোজা পার
নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রতিবছর পবিত্র রমজান মাসকে কেন্দ্র করে অসাধু মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা বাজার অস্থিতিশীল করে তোলেন। রমজান এলেই মাছ-মাংস, শাক-সবজি থেকে শুরু করে কয়েকটি পণ্যের দাম বাড়তে বাড়তে দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে যায়। বিশেষ করে রোজার ভোগ্যপণ্য হিসেবে পরিচিত ছোলা, খেজুর, ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, চিনির বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়। বছরের পর বছর ধরে এমন চিত্রই দেখে আসছে দেশবাসী।
রমজান মাসে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি এবং পণ্যের দাম কমানোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নানামুখী পদক্ষেপ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে এবার রমজানে নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত সরকারের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে অসাধু ব্যবসায়ীদের যে সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছিল তা এখন ভেঙে গেছে। এ ছাড়া এ বছর রমজান সামনে রেখে ট্যাক্স-ভ্যাট কমার পাশাপাশি পণ্য আমদানি বেড়েছে, যার সুফল মিলছে বাজারে।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমদানি বাড়ানো ও মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভোজ্যতেল, ছোলা, চিনি, পেঁয়াজ, আলু, খেজুরসহ বিভিন্ন পণ্যে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে আমদানিতে উৎসাহ বাড়ায় এবার ব্যাপক হারে ভোগ্যপণ্য আমদানি করেছেন আমদানিকারকরা। এতে গত বছরের তুলনায় কিছুটা কমে বিক্রি হয়েছে ছোলা, পেঁয়াজ, চিনি, দেশি রসুন, আলু ও আদাসহ কয়েকটি পণ্য। সবজি ও মুরগির বাজারেও কিছুটা স্বস্তি ছিল।
এবার রমজানে পেঁয়াজ ও আলু গত বছরের তুলনায় অর্ধেক দামে বিক্রি হচ্ছে।
গত রমজানে রাজধানীর খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজ কেজি ১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এবার বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজিতে। আলু বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৩০ টাকায়, যা গত বছর রমজানে বিক্রি হয় ৪০ টাকা কেজি। পাকা টমেটো কেজি ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা গত বছর বিক্রি হয় মানভেদে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়। এখন ঈদ ঘিরে মুরগির দাম বাড়লেও রোজার শুরু থেকে মাঝামাঝি পর্যন্ত অনেকটাই সহনীয় দরেই এবার মুরগি বিক্রি হয়। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৯০ টাকা এবং সোনালি মুরগি ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। ঈদ উপলক্ষে এখন মুরগির দাম কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় ব্রয়লার মুরগি কেজি ২১০ থেকে ২২০ টাকা এবং সোনালি মুরগি কেজি ৩০০ থেকে ৩৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছর রোজায় ব্রয়লার মুরগি কেজি ছিল ২৩০ থেকে ২৪০ টাকা, রোজার আগে আগে যা ২৫০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। দাম কমে চিনি কেজি ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছর ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার ডেপুটি প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার জানিয়েছেন, গত বছরের রমজানের তুলনায় এ বছর বেশির ভাগ পণ্যের দাম কমেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তালিকায় রয়েছে গম, ডাল, মুরগি, ডিম, মাছ, সয়াবিন, পামঅয়েল, চিনি, লবণ, আলু, টমেটো, মরিচ, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ও হলুদ।
বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন বলেছেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ায় এবার রমজানে বাজারে পণ্যের দাম সহনীয়।
এদিকে এবার রোজায় পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে সরকারের একাধিক সংস্থা মাঠে আছে। সংস্থাগুলো হলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল, র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর মনিটরিং টিম। এ ছাড়া নিত্যপণ্যের বাজারে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারিও করা হচ্ছে।