<p>ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে অস্ত্রের লাইসেন্স নেওয়ার পর সেই অস্ত্রের যথেচ্ছ ও অবাধ ব্যবহার হচ্ছে চট্টগ্রামে। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটে গত শনিবার রাতে; চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু নিজের লাইসেন্স করা অস্ত্র দিয়ে যুবলীগ নেতা জয়নাল উদ্দীনের পায়ে গুলি করেন। আটক করার পরও মঞ্জুকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, জব্দ করা হয়নি অস্ত্রও। ‘অস্ত্রটি জব্দ করা হয়নি। তবে পুলিশ একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে। এটির তদন্ত চলছে।’ কালের কণ্ঠকে গতকাল সোমবার বলছিলেন কোতোয়ালি থানার অফিসার ইনচার্জ মো. জসীম উদ্দিন। অস্ত্র জব্দ কেন করা হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই ঘটনায় মামলা না হওয়ায় অস্ত্র জব্দ করা হয়নি।’ বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার হলে আইন অনুযায়ী করণীয় কী? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে তদন্ত হোক। তার পরই তো ব্যবস্থা।’</p> <p>এদিকে মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) এস এম মোস্তাইন হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেছেন, ‘শনিবার রাতেই কোতোয়ালি জোনের সহকারী কমিশনার জাহাঙ্গীর আলম ঘটনাস্থল থেকে মঞ্জুর অস্ত্রটি পুলিশ হেফাজতে নিয়েছেন। অস্ত্রটি এখন পুলিশের কাছে জমা আছে।’ অস্ত্রটি জব্দ দেখানো হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পুলিশ জিডির তদন্ত শেষ করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেবে।’ এর আগে কোতোয়ালি থানা এলাকার বাসিন্দা ও তালিকাভুক্ত যুবলীগদলীয় সন্ত্রাসী হেলাল আকবর বাবরের দফায় দফায় বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করার প্রসঙ্গটি তুললে তিনি বলেন, ‘তখন তো আমি উপকমিশনারের দায়িত্বে ছিলাম না, আগের ঘটনার বিষয়ে জানি না। তবে এটা বলতে পারি, বর্তমানে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করে পার পাবে না।’</p> <p>তবে তথ্য-উপাত্ত বলছে, চট্টগ্রামে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার বাড়ছেই। গত ১৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় হাটহাজারীর চৌধুরীহাট এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুই অস্ত্র ব্যবসায়ী মো. শফিউল বাশার রনি (২৮) ও সোহেল রানাকে (৩২) একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন ও ৫৬ রাউন্ড গুলিসহ গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এই ঘটনায় হাটহাজারী থানায় ধৃতদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়ের করে র‌্যাব। কিন্তু তদন্ত পর্যায়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর মুহাম্মদ তৌফিক চৌধুরী অস্ত্রটি নিজের বলে দাবি করে অস্ত্র ফিরে পেতে র‌্যাবের কাছে আবেদন করেন। আর ঘটনার কিছুদিন পরই হাটহাজারী থানা পুলিশ অস্ত্র আইনের মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কাউন্সিলরকে ফাঁসাতেই প্রতিপক্ষ এই ঘটনা ঘটিয়েছিল। এ বিষয়ে জেলা পুলিশের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে কাউন্সিলরকে ফাঁসানোর জন্যই এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল।</p> <p>সরকারদলীয় নেতা ও সন্ত্রাসীরা বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করলেও পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সিটি করপোরেশনের একজন কাউন্সিলরের বৈধ অস্ত্র সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছিল র‌্যাব। হাটহাজারী থানায় মামলাও করা হয়েছিল। বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারকারীরা সবাই ক্ষমতাসীন দলের নেতা কিংবা দলীয় ক্যাডার হওয়ার কারণেই পুলিশ তাদের অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের মতো প্রতিবেদন দিতে পারছে না বলে চট্টগ্রামের কয়েকজন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠ’র সঙ্গে আলাপকালে নিশ্চিত করেছেন।</p> <p>পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, নগরে বৈধ অস্ত্রের আলোচিত অবৈধ মহড়া দিয়েছিলেন তৎকালীন যুবলীগদলীয় সন্ত্রাসী দিদারুল আলম মাসুম। ২০১৩ সালের ৭ এপ্রিল চট্টগ্রাম মহানগরের লালখান বাজার এলাকায় হেফাজতে ইসলামের হরতাল চলাকালে দিদারুল আলম মাসুমের নেতৃত্বে সরকার সমর্থকরা হরতাল প্রতিহত করতে মাঠে নামে। ওই দিনই হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিলেন মাসুম। অস্ত্রটি ছিল মাসুমের নামে লাইসেন্স করা। তিনি এখন লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। মাসুমের সেই অস্ত্র মহড়ার দৃশ্য এখনো নগরবাসীর মনে দাগ কেটে আছে। ওই সময়ে কালের কণ্ঠ’র প্রশ্নের জবাবে সিএমপির তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ অ্যান্ড অপারেশন) বনজ কুমার মজুমদার বলেছিলেন, ‘যারা গুলি চালিয়েছে, তাদের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেলে অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।’ তবে পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল, সেই প্রতিবেদনের মর্মার্থ ছিল, দিদারুল আলম মাসুম আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছিলেন। এমন প্রতিবেদন দেওয়ার পর মাসুমের অস্ত্রটি জব্দ করেনি জেলা প্রশাসন।</p> <p>কেন এ ধরনের প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছিল ওই সময়? এমন প্রশ্নের জবাবে ২০১৩ সালে মহানগর পুলিশের বিশেষ শাখায় কর্মরত ছিলেন এবং এখন অন্যত্র কর্মরত এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গুলি চালানোর প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের সঙ্গে পুলিশ কথা বলেছিল। ছবিও সংগ্রহ করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তদন্ত করতে গিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছিল। এর বাইরে কিছু বলতে পারব না।’ বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারে মাসুমের পরই আছেন যুবলীগদলীয় পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর। তিনি চলতি বছরের শুরুতেই পাহাড়তলী থানার গ্রিন ভিউ আবাসিক এলাকার মো. লোকমান হাকিমের বাড়ির সীমানাপ্রাচীর ভাঙতে গিয়েছিলেন সদলবলে। রাতের অন্ধকারে একদল সন্ত্রাসী অন্তত দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি চালিয়ে পুরো এলাকায় আতঙ্ক তৈরি করেছিল।</p> <p>ওই ঘটনার ভিডিও ফুটেজে পুলিশ দেখতে পায়, বাবর ও তাঁর সহযোগীরা মুহুর্মুহু গুলি ছুড়েছে। এরও আগে বাবর লাভ লেন এলাকার বাসিন্দা যুবলীগ নেতা শহীদুল ইসলাম শামীমকে বাসায় খুঁজতে গিয়ে তাঁকে না পেয়ে বাসার সামনে বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে এলাকায় আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। বাবরের দুটি বৈধ অস্ত্র আছে বলে মহানগর পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানিয়েছেন। এমন ঘটনার পরও পুলিশ হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের অস্ত্র জব্দের উদ্যোগ নেয়নি। এখন বাবর ৮-১০ জন সশস্ত্র ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রহরী নিয়েই নগরে চলাফেরা করেন বলে মহানগর পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।</p> <p>এ ছাড়া গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ফটিকছড়ি, বোয়ালখালী, হাটহাজারী, রাঙ্গুনিয়া ও চন্দনাইশের নির্বাচনে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার হয়েছিল। ওই সময় পুলিশের গোপন প্রতিবেদনে উঠে আসে বিষয়টি। পরে চট্টগ্রামের মাসিক আইন-শৃঙ্খলা সভায় চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের তৎকালীন পুলিশ সুপার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেছিলেন, পুলিশ খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে, বৈধ অস্ত্র নির্বাচনী মহড়ায় প্রদর্শিত হয়েছে এবং গুলিও ব্যবহৃত হয়েছে। এসব গুলি কারা সরবরাহ করেছে, তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও তিনি বলেছিলেন মিটিংয়ে। সভায় তৎকালীন জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন বলেছিলেন, ‘পুলিশের ছাড়পত্রের ভিত্তিতেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে জেলা প্রশাসন থেকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। পুলিশ অস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদনকারীদের আরো ভালোভাবে তদন্ত করলে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার অনেকাংশ কমে আসবে।’</p> <p>চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উত্তর) মো. মশিউদ্দোলা রেজা গতকাল সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, হাটহাজারীতে দুই পক্ষে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার একাধিক ঘটনায় বৈধ অস্ত্র প্রদর্শিত হয়েছে, এমন তথ্য পুলিশের কাছেও আছে। এ বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে।</p>