ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তি ও তাঁদের পরিবারের কাছ থেকে জানা গেছে, প্রতিকার না পাওয়ায় ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে যাচ্ছে না। তাদের অভিযোগ, ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশি চৌকি (চেকপোস্ট) বসালেও গাড়ির কাগজপত্র দেখায়ই বেশি ব্যস্ত থাকেন পুলিশ সদস্যরা। তা ছাড়া ভোরে ও বিকেলে টহল ও তল্লাশি থাকে না বেশির ভাগ এলাকায়। এ সুযোগে বেড়ে গেছে ছিনতাইকারীচক্র।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, রাজধানীর ১৪১টি স্পট আছে যেখানে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। এলাকাভিত্তিক বখাটেরা ছিনতাইয়ের ‘গ্যাং পার্টি’ গড়ে তুলেছে। এরই মধ্যে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ছিনতাইকারীদের বেশ কিছু চক্রের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এলাকাও শনাক্ত করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি এলাকায় ছিনতাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এর মধ্যে মোহাম্মদপুরের কলেজগেট থেকে রিং রোড, আগারগাঁওয়ের সংযোগ সড়ক, খিলক্ষেত থেকে বিমানবন্দর সড়ক, মৌচাক মার্কেট থেকে মগবাজার, সদরঘাট থেকে সূত্রাপুর-দয়াগঞ্জ, ওয়ারী, উত্তরা থেকে আব্দুল্লাহপুর, ঝিগাতলা থেকে রায়েরবাজার-শংকর, মিরপুরের রূপনগর-বেড়িবাঁধ, যাত্রাবাড়ীর দোলাইরপাড়-শ্যামপুর উল্লেখযোগ্য।
রাজধানীতে ছিনতাই বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি গত ৯ ডিসেম্বর ডিএমপির মাসিক অপরাধ সভার আলোচনায়ও উঠে আসে। সেখানে ডিএমপি কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘ছিনতাই প্রতিরোধে টহল বাড়ানোর পাশাপাশি চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালাতে হবে।’
চিকিৎসক ফরহাদ আলমের মৃত্যুর ঘটনায় গত দুই সপ্তাহেও ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ বিষয়ে গতকাল জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার ওসি জামাল উদ্দিন মীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমরা চেষ্টা করছি ধরতে। আশা করি পারব।’
এ ছাড়া গত ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের মেলা থেকে একটি ল্যাপটপ কিনে রিকশায় কল্যাণপুরের বাসায় ফেরার পথে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন কালের কণ্ঠ’র বার্তা বিভাগের শিফট ইনচার্জ ও কবি সফেদ ফরাজী। মোটরসাইকেলে আসা ছিনতাইকারীরা সফেদের ল্যাপটপের ব্যাগটি টান দিয়ে নিয়ে যায়। ওই সময় রিকাশা থেকে পড়ে আহতও হন তিনি।
এ ঘটনায় হওয়া মামলার ব্যাপারে জানতে চাইলে শেরেবাংলানগর থানার ওসি গোপাল গণেশ বিশ্বাস বলেন, ‘এমন ঘটনা বেশি, তা ঠিক নয়। আমাদের তল্লাশি আছে। আশপাশ থেকে এসে অপরাধীরা এসব করে। ছিনতাইকারীদের ধরতে অভিযান চালাচ্ছি।’
সম্প্রতি কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন তরুণ মডেল আরমান হোসেন। শুটিং শেষ করে উত্তরা থেকে মোটরসাইকেলে রামপুরার বাসায় ফেরার পথে তিন ছিনতাইকারী পিস্তল ঠেকিয়ে আইফোন ও পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে চলে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খিলক্ষেত থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কে রাতে ও ভোরে প্রায়ই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। সম্প্রতি ওই এলাকায় ডিবি পুলিশ পরিচয়ে ৪০ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানবন্দর থানার ওসি নুরে আযম সিদ্দিকী বলেন, ছিনতাইরোধে পুলিশি টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। ছিনতাইকারীচক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
এ ছাড়া ১০ ডিসেম্বর রাতে ওয়ারীতে শাহীদা নামের এক নারীর পায়ে গুলি করে টাকাসহ হাতব্যাগ ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। এর আগে মৌচাক এলাকায় রিকশায় যাওয়ার সময় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে আহত হন ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মাহবুবুল হক।
বড় মগবাজার এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহিম বলেন, ‘মৌচাক মোড় থেকে মগবাজার ওয়্যারলেস গেট পর্যন্ত রাস্তায় প্রতিদিনই ছিনতাই হচ্ছে। মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার নিয়ে ছিনতাইকারীরা সেখানে অপকর্ম করে। ব্যাগ টেনে নিয়ে যায়। আবার কখনো পথ আটকায়।’
এদিকে চলতি বছর দুইবার ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলেন নিউ মার্কেটের কাপড় ব্যবসায়ী আব্দুল মজিদ। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতি রাতে উত্তরায় বাসায় ফেরার সময় একটা-দুটো চেকপোস্ট দেখি। সেখানে পুলিশ অপরাধী বের করার তল্লাশি করে না। করে ট্রাফিক পুলিশের কাজ। ঝামেলা দেখলে চলে দেনদরবার। তখন অপরাধীরা পাশ দিয়ে চলে যেতে পারে।’ তিনি আরো অভিযোগ করেন, ‘ভোরে চেকপোস্ট বলে কিছু থাকে না।’
এর আগে ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর ধানমণ্ডির সোবহানবাগে টানা পার্টির কবলে পড়ে শিশুসন্তান রাইসার সামনে প্রাণ হারান মা রিপা। ২০১৫ সালের ২৪ আগস্ট কমলাপুরে চিকিৎসক দম্পতি সানজানা জেরিন খান ও মোনতাহিন আহসান ভূঁইয়া রনি একইভাবে পড়েন টানা পার্টির কবলে। মাথায় গুরুতর জখমে কোমায় চলে গেছেন ডা. জেরিন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ছিনতাইকারী বা টানা পার্টি চক্রে স্থানীয় ছাত্রলীগকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসহ বখাটে গ্রুপ জড়িত। গত ৮ নভেম্বর এমন একটি ছিনতাইকারী গ্রুপ রায়েরবাজারের তরুণ সাব্বির হোসেনকে হত্যা করে।
এ বিষয়ে মোহাম্মদপুর থানার এসআই পীযূষ কুমার সরকার জানান, এই চক্রটি শংকর, রায়েরবাজার ও জাফরাবাদসহ আশপাশে ছিনতাই করত। গেণ্ডারি সোহাগ, সোহেল ও চাচা টুটুলসহ কয়েকজন এই চক্রের হোতা।
গত বছরের ডিসেম্বরে মিরপুর থেকে ছিনতাইকারী চক্রের হোতা গোপালগঞ্জ ছাত্রলীগ নেতা তুহিনকে গ্রেপ্তার করে পল্লবী থানা পুলিশ। পরে তুহিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানায়, মিরপুর কলেজ ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে মিরপুর, পল্লবী, কালশী ও কাফরুল এলাকায় মোটরসাইকেল দিয়ে রিকশাআরোহীদের ব্যাগসহ দামি জিনিস ছিনিয়ে নিত চক্রটি।
ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার নুরুল আমিন বলেন, ছিনতাইরোধে এলাকায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। এর পরও বিচ্ছিন্নভাবে ঘটনা ঘটে। তবে অপরাধীরাও ধরা পড়ে।
ডিএমপির অপরাধ বিভাগের তথ্য অনুয়ায়ী, গত দুই মাসে ডিএমপিতে মাত্র ১২টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। যেসব ঘটনায় মামলা হয়েছে সেগুলোই তাঁরা বিবেচনায় নিয়েছেন। ডিবি পুলিশের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, এরই মধ্যে ১৪১ এলাকা বা স্পটকে শনাক্ত করা গেছে। এসব এলাকায় কারা ছিনতাই করছে তা খোঁজ নিচ্ছে ডিবি। হালনাগাদ করা হচ্ছে ছিনতাইকারীদের তালিকা। শিগগিরই বিশেষ অভিযান শুরু হবে।