<p>আমি বাংলায় কথা কই, আমি বাংলায় ভাসি, বাংলায় হাসি, বাংলায় জেগে রই—বাঙালির হৃদয়ে যখন এই গান বাজে, রাস্তায় বেরোলে তাকে দেখতে হয় ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড। রাজধানীর ধানমণ্ডি, গুলশান, বারিধারা থেকে ডুমনীর কোনো গলি, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া কিংবা সুদূর সেন্ট মার্টিনস—কোথায় নেই ইংরেজি সাইনবোর্ড? এ ব্যাপারে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা উপেক্ষিত। সরকারি প্রতিষ্ঠানে বাংলার ব্যবহার হলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান হাইকোর্টের নির্দেশনা মানছে না। মানতে বাধ্য করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।</p> <p>১৯৮৭ সালের ‘বাংলা ভাষা প্রচলন আইন’-এ ‘প্রবর্তন ও কার্যকরী’ অংশে বলা হয়, ‘এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগ কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে।’ ‘প্রবর্তন ও কার্যকরী ব্যবস্থা’ অংশে বলা হয়, ‘যদি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী এ আইন অমান্য করেন তাহা হইলে উক্ত কার্যের জন্য তিনি সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে এবং তাহার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে।’</p> <p>আইনে ‘বাংলাদেশের সর্বত্র’ বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে বলা হলেও বিলবোর্ড ও সাইনবোর্ডে ইংরাজির ছড়াছড়ি। বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ একটি রিট আবেদন করেন। শুনানি শেষে ওই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট এক আদেশে দেশের সব প্রতিষ্ঠানের (দূতাবাস, বিদেশি সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র ছাড়া) নামফলক, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ইত্যাদি বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক করতে নির্দেশ দেন। ওই বছরের মে মাসেই সরকার বিজ্ঞাপন জারি করে এসব ক্ষেত্রে বাংলা লেখা বাধ্যতামূলক করে। কিন্তু হাইকোর্টের এই আদেশ উপেক্ষিতই থেকে যায়। কিছুদিন এ নিয়ে সতর্কতা থাকলেও কয়েক দিন পরই শুরু হয় ফের আইনের লঙ্ঘন। যে কারণে হাইকোর্টের নির্দেশনার তিন বছর পরে এসেও ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরকে বাংলা ব্যবহারের নির্দেশনা দিতে হয়। গত ২৮ জানুয়ারি ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তর একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সাত দিনের মধ্যে সব নামফলক, বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড ও ব্যানার বাংলায় লেখার নির্দেশনা দিয়েছে। ডিএনসিসির গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, হাইকোর্ট বিভাগের ১৬৯৬/২০১৪ নং রিট পিটিশনে প্রদত্ত আদেশ অনুযায়ী সকল প্রতিষ্ঠানের (দূতাবাস, বিদেশি সংস্থা ও তত্সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্র ব্যতীত) নামফলক, সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার ইত্যাদি বাংলায় লেখা বাধ্যতামূলক।</p> <p>রিট আবেদনকারী অ্যাডভোকেট ইউনুছ আলী আকন্দ মনে করেন, সিটি করপোরেশনের এই নির্দেশনাই প্রমাণ করে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাংলা ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই একটি রিট করেছিলাম। হাইকোর্ট আদেশও দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই আদেশ উপেক্ষিত। রায় পালনই করেনি কেউ। রায় পালন না করা আদালত অবমাননা। কিন্তু পালন করছে না। শুধু চিঠি চালাচালি হয় বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে। হাইকোর্টের রায় কার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর মাঝে মাঝে নির্দেশনা দেয়। আর কিছুই করে না।’ ইউনুছ আলী আরো বলেন, ‘আদালত অবমাননার মামলা করলেও কোনো ফল পাওয়া যায় না। তিনি প্রশ্ন রাখেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রুয়ারি স্বীকৃতি পেলেও বাংলাদেশে বাংলার ব্যবহার সবখানে থাকবে না কেন? সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড ইংরেজিমুক্ত কবে হবে?’</p> <p>ব্যবসপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়। যারা লাইসেন্স দেবে তাদের দায়িত্ব হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ড পরিদর্শন করা। কিন্তু তা মানা হয় না। বিষয়টি এমনই গা-সহা হয়ে গেছে—শুধু ফেব্রুয়ারি এলেই এসব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড সরানোর প্রশ্নটি ওঠে। খোঁজ নিলে হয়তো দেখা যাবে, এই ভাষার মাসেও প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও দোকানে উঠছে ইংরেজিতে লেখা সুদর্শন সাইনবোর্ড।</p> <p> </p>