<p>মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে মুমিনের ঈমানি সম্পর্ক। তাঁকে ভালোবাসা, তাঁর আদেশ-নিষেধ মান্য করা ও তাঁর আদর্শ অনুসরণ করা মুমিনের অপরিহার্য কর্তব্য। তবে প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা হতে হবে অকৃত্রিম ও লৌকিকতামুক্ত। যেমন ভালোবেসেছিলেন সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ি, তাবে তাবেয়ি ও অলিরা। প্রিয় নবী (সা.)-এর খাঁটি প্রেমিকরা নিম্নে বর্ণিত কাজগুলো করে থাকেন—</p> <p><strong>সব কিছুর ওপর রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রাধান্য দেওয়া </strong>: আল্লাহ তাআলা তাঁর হাবিবকে আগের ও পরের সব সৃষ্টির ওপর প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি আদম সন্তানের সর্দার, এতে আমার কোনো গর্ব নেই, আমাকে প্রথমে কবর থেকে উঠানো হবে, আমি প্রথম সুপারিশকারী এবং প্রথমে আমার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে।’ সুতরাং মুমিনদের কর্তব্য হবে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে প্রাধান্য দেওয়া। সব কিছুর ওপর তাঁকে স্থান দেওয়া। আবু সুফিয়ান (রা.) মুসলমান হওয়ার আগে একদিন স্বীয় কন্যা উম্মুল মুমিনিন উম্মে হাবিবা (রা.)-এর সঙ্গে দেখা করতে মদিনায় আসেন। আবু সুফিয়ান (রা.) গৃহে প্রবেশ করে রাসুল (সা.)-এর বিছানায় বসতে চাইলে তাঁর কন্যা তাঁকে বসতে বারণ করেন। আবু সুফিয়ান বললেন, ‘হে কন্যা! আমার জন্য এ বিছানা উপযুক্ত মনে করছ না, নাকি এ বিছানার জন্য আমাকে উপযুক্ত মনে করছ না।’ কন্যা বলেন, ‘এটি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বিছানা। আর আপনি হলেন মুশরিক। আল্লাহর রাসুলের বিছানায় মুশরিকের বসা আমি পছন্দ করি না।’ অনুরূপভাবে সাহাবায়ে কেরাম রাসুল (সা.)-এর সম্মান, তাঁর কষ্ট লাঘব ও আদেশ-নিষেধ মানার ব্যাপারে সদা পাগলপারা ছিলেন।</p> <p><strong>তাঁর দরুদ পাঠ করা </strong>: নবীপ্রেমিক সদা তাঁর যথাযথ গুণকীর্তন  করেন, তাঁর প্রতি দরুদ পেশ করেন। ইরশাদ হয়েছে, অবশ্যই আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি সালাম পেশ করেন। হে ঈমানদাররা! তোমরা তাঁর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করো। (সুরা আহজাব : ৫৬)</p> <p>আল্লাহ তাআলা এখানে নির্দেশমূলক শব্দ ব্যবহার করেছেন। নির্দেশমূলক শব্দের মাধ্যমে ওয়াজিব প্রমাণিত হয়। তাই রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তি কৃপণ, যার সামনে আমার আলোচনা করা হচ্ছে, কিন্তু সে আমার প্রতি দরুদ পড়ে না।’ (তিরমিজি : ৫/৫৫১) রাসুল (সা.) অন্য জায়গায় বলেছেন, ওই ব্যক্তির নাক ধুলামিশ্রিত হোক, যার সামনে আমার আলোচনা করা হয়, কিন্তু আমার প্রতি দরুদ পড়ে না। (আহমদ) অনেক ইবাদতে দরুদ শরিফ পড়া হয়। যেমন—নামাজে, খুতবায়, জানাজায়, আজানের পর, দোয়ার সময় ইত্যাদি।</p> <p><strong>অধিক হারে তাঁর আলোচনা করা </strong>: ইবনে কাইয়েম (রহ.) বলেন, যখন প্রিয়জনের আলোচনা অধিক পরিমাণে করা হয়, তখন সে তার হৃদয়ে হাজির হয়। তাই মুমিন বান্দা প্রিয় নবী (সা.)-এর আলোচনা যত বেশি করবে, তার হৃদয়ে মহব্বত তত গভীর হবে।</p> <p><strong>আদবের সঙ্গে তাঁর আলোচনা করা </strong>: নবীপ্রেমিক প্রিয় নবীর নাম ধরে আলোচনা না করে বরং গুণবাচক শব্দ নিয়ে তাঁর আলোচনা করেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘রাসুলের আহ্বানকে তোমরা তোমাদের একে অপরকে আহ্বানের মতো গণ্য কোরো না।’ (সুরা নুর : ৬৩) আল্লাহ তাঁর হাবিবকে পরিচয়দানের মাত্র চার জায়গায় ‘মুহাম্মদ’ নাম উল্লেখ করেছেন। এ জায়গাগুলো হলো—সুরা আলে ইমরান : ১৪৪, সুরা আহজাব : ৪০, সুরা মুহাম্মদ-২, সুরা আল ফাতহ : ২৮। অন্য জায়গায়—মুজ্জাম্মিল, মুদ্দাসিসর, ইয়াসিন ইত্যাদি ছদ্মনামে ডেকেছেন।</p> <p><strong>তাঁর বাণীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা </strong>: যারা বিশ্বনবীর প্রেমিক, তারা তাঁর বাণীকে আদবের সঙ্গে শ্রবণ করেন, হাদিসের পাঠে আদবের সঙ্গে বসেন। হাদিসের রঙে নিজেকে রঙিন করার চেষ্টা করেন। ইমাম মালেক (রহ.) হাদিসের পাঠদানের আগে হাদিসের সম্মানার্থে অজু করতেন, উত্তম পোশাক পরতেন, টুপি পরতেন ও দাড়ি আঁচড়াতেন।</p> <p><strong>তাঁর বাণীকে সত্য বলে বিশ্বাস করা</strong> : ঈমানের মূল হলো, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বাণীকে সত্য বলে বিশ্বাস এবং তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে সংবাদ দিয়েছেন, তা সত্য বলে স্বীকার করা। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘নক্ষত্রের কসম, যখন অস্তমিত হয়। তোমাদের সঙ্গী পথভ্রষ্ট হননি ও বিপথগামীও হননি এবং প্রবৃত্তির তাড়নায় কথা বলেন না। কোরআন অহি, যা প্রত্যাদেশ হয়। (সুরা আন-নাজম : ১ -৪)</p> <p><strong>রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আনুগত্য করা</strong> : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কথা ও কাজ মেনে নেওয়ার মূল হলো তাঁর আনুগত্য করা। আল্লাহ তাআলা আনুগত্য প্রসঙ্গে ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি রাসুলের হুকুম মান্য করবে, সে আল্লাহর হুকুম মান্য করল। আর যে ব্যক্তি বিমুখতা অবলম্বন করল, আমি আপনাকে তাদের জন্য রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করে পাঠাইনি।’ (সুরা নিসা : ৮০) আরো ইরশাদ করেন, ‘বলুন! যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাসো, তবে আমার আনুগত্য করো, আল্লাহ তাআলা তোমাদের ভালোবাসবেন।’ (সুরা আলে ইমরান : ৩১) অন্য জায়গায় ইরশাদ করেন, ‘আনুগত্য করো আল্লাহ ও রাসুলের।’ (আলে ইমরান : ১৩২)</p> <p><strong>রাসুল (সা.)-কে সাহায্য-সহযোগিতা করা</strong> : রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সাহায্য করা, তাঁকে হেফাজত করা ইত্যাদি প্রসঙ্গে বহু আয়াত রয়েছে। যেমন—আল্লাহর বাণী : ‘এই ধন-সম্পদ দেশত্যাগী নিঃস্বদের জন্য, যারা আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি লাভের অন্বেষণে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাহায্যার্থে নিজেদের বাস্তুভিটা ও ধন-সম্পদ থেকে বহিষ্কৃৃত হয়েছে, তারাই সত্যবাদী।’ (সুরা আল হাশর : ৮) হজরত আবু তালহা (রা.) উহুদের যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে ঢালস্বরূপ হেফাজত করেছেন।</p> <p><strong>সাহাবায়ে কেরামকে সম্মান করা</strong> : রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার সাহাবিদের গালি দিয়ো না। তোমাদের কেউ যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণ ব্যয় করো, তার পরও তাদের সামান্য কাছে যেতে পারবে না।’ (মুসলিম) রাসুল (সা.) বলেছেন, আমার প্রত্যেক সাহাবি ন্যায়পরায়ণ। স্বয়ং আল্লাহ তাআলা তাদের প্রশংসা করেছেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ ওই সব মুমিনের প্রতি সন্তুষ্ট, যারা গাছের নিচে আপনার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেছে। তিনি জানেন, তাদের অন্তরে কী রয়েছে।’ (সুরা আল ফাতহ : ১৮) আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন, ‘মুহাম্মদ আল্লাহর রাসুল ও তাঁর সহচররা কাফিরদের প্রতি বজ্রকঠোর, নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানুভূতিশীল। আল্লাহর অনুগ্রহ ও সন্তুষ্টি কামনায় আপনি তাদের রুকু ও সিজদারত দেখবেন। তাদের মুখমণ্ডলে রয়েছে সিজদার চিহ্ন।’ (সুরা আল ফাতহ : ২৯)</p> <p><strong>রাসুল (সা.)-এর স্ত্রীদের সম্মান করা</strong> : রাসুল (সা.)-এর স্ত্রীরা হলেন মুমিনদের মাতৃতুল্য। নবীপ্রেমিকরা তাঁদের অবশ্যই ভালোবাসেন। ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, যে ব্যক্তি হজরত আবু বকর (রা.)-কে গালি দেয়, তাকে বেত্রাঘাত করা হবে। আর যে ব্যক্তি হজরত আয়েশা (রা.)-কে গালি দেবে, তাকে হত্যা করা হবে। তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি প্রত্যুত্তরে বলেন, যে তাদের গালি দিল, সে কোরআনের বিরোধিতা করল। (আস সারেমুল মাসলুল : ৫৭১) ইবনে কাসির বলেন, ওলামায়ে কেরাম এ ব্যাপারে একমত যে কোরআন মজিদের আয়াত নাজিল হওয়ার পর যে ব্যক্তি আয়েশা (রা.)-কে গালি দেয়, সে কাফির। কেননা সে কোরআনকে বিশ্বাস করে না।</p> <p><strong>তাঁর সুন্নাতকে হিফাজত করা</strong> : সুন্নাতকে হিফাজত করার অর্থ হলো, তাঁর সুন্নাতগুলো বিদআত থেকে মুক্ত রাখেন, সুন্নাত অনুযায়ী আমল করেন, পরিবর্তন-পরিবর্ধন থেকে মুক্ত রাখেন, হুবহু অন্যের কাছে বর্ণনা করেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা ওই ব্যক্তির চেহারা উজ্জ্বল রাখুন, যিনি আমাদের থেকে শুনে হুবহু অন্যের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, অনেক শ্রবণকৃত ব্যক্তি শ্রবণকারী থেকে অধিক সংরক্ষণকারী হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমার কথায় যে ব্যক্তি এসব কথা অন্তর্ভুক্ত করে যা আমার কথা নয়, তা প্রত্যাখ্যাত।’ (বুখারি : ৩/১৬৭)</p> <p><strong>তাঁর সুন্নাতগুলো প্রচার করা</strong> : মহানবী (সা.)-কে ভালোবাসা ও সম্মান করার পূর্ণতা হলো তাঁর সুন্নাতগুলো প্রচার করার ব্যাপারে আগ্রহী হওয়া। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আমার থেকে একটি কথা জানলেও তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও। (সহিহ বুখারি : ৩/১৪৫) বিদায় হজের ভাষণের সর্বশেষ কথা ছিল, তোমরা যারা উপস্থিত, তারা আমার কথাগুলো অনুপস্থিতদের পৌঁছে দাও। তাঁর এ কথা শুনে আরাফাতের ময়দানে উপস্থিত সোয়া লাখ সাহাবির বেশির ভাগই গোটা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে দাওয়াত পৌঁছাতে চলে যান। তাঁর সুন্নাতগুলো প্রচার করা এবং মানুষদের শেখানো তাঁকে ভালোবাসার অন্যতম নিদর্শন।</p> <p><strong>তাঁকে প্রেরণের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা</strong> : আল্লাহ তাআলা দ্বিনকে বিজয়ী করার জন্য রাসুলকে প্রেরণ করেছেন। পবিত্র কোরআনে এসেছে : ‘তিনি আপন রাসুলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বিন সহকারে প্রেরণ করেছেন, যেন এ দ্বিনকে অন্যান্য দ্বিনের ওপর জয়যুক্ত করেন, যদিও মুশরিকরা তা অপ্রীতিকর মনে করে।’ (সুরা তাওবা : ৩৩) অন্য জায়গায় ইরশাদ করেন, ‘তিনি তাঁর রাসুলকে হেদায়েত ও সত্য দ্বিনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে একে অন্য সব দ্বিনের ওপর জয়যুক্ত করেন। সত্য প্রতিষ্ঠারূপে আল্লাহই যথেষ্ট।’ (সুরা ফাতহ : ২৮)</p> <p>অতএব, একজন নবীপ্রেমিকের প্রধান ও একমাত্র কাজ হলো, দ্বিনকে বিজয়ী করার নিমিত্তে সদা সক্রিয়ভাবে কাজ করা। যেমনটি করেছেন আমাদের প্রিয় নবীসহ অন্য নবী-রাসুলরা।</p> <p><strong>লেখক</strong> : প্রধান ফকীহ, আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।</p>