<p>জঙ্গি ও জঙ্গিবাদ শব্দদ্বয় ইংরেজি Militant, Militancy শব্দদ্বয়ের অনুবাদ। সম্প্রতি এগুলো আমাদের মধ্যে অতি পরিচিত ও অতি ব্যবহৃত। শব্দগুলো কিছুদিন আগেও এত প্রচলিত ছিল না। ব্যাবহারিকভাবে এগুলো নিন্দনীয় বা খারাপ অর্থেও ব্যবহৃত হতো না। শাব্দিক বা রূপকভাবে যোদ্ধা, সৈনিক বা যুদ্ধে ব্যবহৃত বস্তু বোঝাতে এ শব্দগুলো ব্যবহার হতো। আবার ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান ইন চিফকে ‘জঙ্গিলাট’ বলা হতো। (শ্রীশৈলেন্দ্র বিশ্বাস, সংসদ বাংলা-ইংরেজি অভিধান, পৃষ্ঠা ৪৬২)</p> <p>শক্তিমত্তা বা উগ্রতা বোঝাতেও এ শব্দ ব্যবহার করা হয়। Oxford advanced learners Dictionary-তে বলা হয়েছে, Militant adj. favouring the use of force or strong pressure to achieve one’s aim. Militant; person; esp. in politics. অর্থাৎ যে ব্যক্তি তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য শক্তি বা জোরালো প্রভাব ব্যবহার করে বা সমর্থন করে, সে-ই জঙ্গি। (A. S. Harby, Oxford advanced Learners Dictionary, p-738).কিন্তু আমরা বর্তমানে ‘জঙ্গি’ বলতে বুঝি বেআইনি সহিংসতা ও খুনখারাবি। এ অর্থে প্রসিদ্ধ ও সুপরিচিত পরিভাষা সন্ত্রাস। জঙ্গিবাদ মানে সন্ত্রাসবাদ (Terrorism)। কিন্তু আমরা পত্রপত্রিকা, বক্তৃতা-বিবৃতি ও লেখালেখি থেকে বুঝি যে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও চরমপন্থার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যারা সাম্যবাদ, সহিংসতা বা খুনখারাবিতে লিপ্ত হয়, তাদের আমরা চরমপন্থী (Extremist) বলি।</p> <p>আর যারা ইসলামের নামে বা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে উগ্রতা, অস্ত্রধারণ, সহিংসতা বা খুনখারাবিতে লিপ্ত হয়, তাদের আমরা জঙ্গি বলি। আর যারা প্রচলিত সাধারণ রাজনৈতিক দলের নামে বা কোনো দল, মতবাদ বা আদর্শের নাম না নিয়ে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য উগ্রতা, অস্ত্রধারণ এবং সহিংসতায় লিপ্ত হয়, তাদের সন্ত্রাসী বলি। আসলে এরূপ বিভাজন বা পার্থক্যের কোনো ভাষাগত বা তথ্যগত ভিত্তি আছে বলে জানা নেই। বস্তুত জঙ্গিবাদ বলতে আমরা যা বোঝাচ্ছি ও বুঝছি, সে অর্থটি প্রকাশের যথাযথ এবং সঠিক শব্দ হলো সন্ত্রাস।</p> <p>সন্ত্রাসের সংজ্ঞা নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। এ পর্যন্ত সন্ত্রাসের সর্বসম্মত গ্রহণযোগ্য কোনো সংজ্ঞা কেউ দিতে পারেনি। প্রতিটি রাষ্ট্র কিছু কর্মকাণ্ডকে সন্ত্রাস বলে। অথচ অন্য দেশে সেটিকে সন্ত্রাস মনে করা হয় না। আমেরিকার State University-র এক প্রফেসর তাঁর বইয়ে অকপটে স্বীকার করেছেন, ‘আমরা আমেরিকানরা যে কর্মকাণ্ডকে সন্ত্রাস বলে থাকি, এটাকে অন্য দেশে মুক্তিযুদ্ধ মনে করা হয় অথবা দখলদার বাহিনী থেকে দেশকে মুক্ত করা বলে মনে করা হয়।’</p> <p>এ জন্য বলা হয়, One man’s terrorist is another man’s freedom fighter.</p> <p>১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো একত্র হয়ে অনেক বিতর্কের পর সন্ত্রাসের একটি সংজ্ঞা দেন—‘সন্ত্রাস বলা হয় কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া শক্তি প্রয়োগ করাকে।’ যে দেশেই হোক, যে লোকই এ কাজ করুক না কেন, সে নিন্দার উপযুক্ত।</p> <p>অপর দিকে ইসলামের পরিভাষায় সন্ত্রাসের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে গিয়ে মুসলিম বিশ্বের শীর্ষ ফিকাহ পরিষদ—‘মুজমাউল ফিকহিল ইসলামী’ ২০০১ সালে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে ‘অন্যায়ভাবে কোনো ব্যক্তি, দল অথবা রাষ্ট্র যদি অন্য কোনো ব্যক্তির জান-মাল বা সম্মানের ওপর অযথা হস্তক্ষেপ, শক্তি প্রয়োগ, ত্রাস সৃষ্টি করে এটাই সন্ত্রাস।</p> <p>কোন পরিস্থিতি জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটায়</p> <p>একটি দেশে কেন জঙ্গিবাদ বা সহিংস উগ্রপন্থা বিস্তার লাভ করে, কেন এ ধরনের আদর্শ মানুষকে আকর্ষণ করে, কারা জঙ্গিবাদের প্রতি আকর্ষিত হয়? কয়েক দশক ধরেই সমাজবিজ্ঞানী, নিরাপত্তাবিষয়ক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকরা এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এ প্রশ্নগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে গত শতকের ষাটের দশকে, যখন সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি মানুষের আকর্ষণ তৈরি হয় এবং বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি সশস্ত্র বিপ্লবের পথে সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করে; যার প্রমাণ আমরা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতারের লেখায় খুঁজে পাই। তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘এ দেশে প্রথম থেকেই বাম জঙ্গি কার্যক্রম ছিল। কিছু বাম সংগঠন সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করতে চেয়েছে।’ (মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও আগ্রাসন, পৃষ্ঠা ১৯)</p> <p>এ প্রশ্নগুলো নতুন করে শক্তিশালী হয়ে ওঠে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের পর এবং সম্প্রতি আইএস ও নাইজেরিয়ার বোকোহারামের উত্থানের পর। বাংলাদেশে ২০০৪ সালে প্রায় সব কয়টি জেলার আদালতে একসঙ্গে বোমা বিস্ফোরণ এবং সম্প্রতি হলি আর্টিজানে হামলার পর।</p> <p>আইএস, বোকোহারামসহ জঙ্গি সংগঠনগুলো যুদ্ধবিধ্বস্ত কিংবা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত অঞ্চলগুলোতে তাদের নিজস্ব কর্তৃত্ব স্থাপনের মাধ্যমে নিজেদের রাষ্ট্র, যাকে তারা ‘খিলাফত’ বলে বর্ণনা করে, প্রতিষ্ঠা করে এবং সারা পৃথিবীর মুসলিমদের প্রতিনিধিত্বের দাবিদার হয়ে ওঠে। অধ্যাপক আলী রিয়াজ বলেন, অনেক গবেষক মনে করেন, দরিদ্র সুযোগবঞ্চিত এবং ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণকারীরাই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। এই ধারণা সম্প্রতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে শুরু করে। কেননা দেখা যায় যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনের বেশির ভাগ নেতা কিংবা আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীরা দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত কিংবা ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষিত নয়। গবেষকরা অবশেষে জঙ্গিবাদ বিস্তারের চালিকাগুলোকে চার ভাগে ভাগ করেন। যথা—অভ্যন্তরীণ সামাজিক-অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বৈশ্বিক। (প্রথম আলো, তারিখ ৭-১০-১৫, পৃষ্ঠা ১১)</p> <p>হলি আর্টিজানসহ সম্প্রতি বাংলাদেশে যেসব জঙ্গি বিভিন্ন হামলার সঙ্গে জড়িত এবং বিভিন্ন অভিযানে আটক বা নিহত হয়, তাদের প্রায় সবাই অভিজাত পরিবারের ছেলে এবং দেশ-বিদেশের নামকরা আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী অথবা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এটা স্বীকার করে।</p> <p>ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীরের মতে, ‘জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদ’ প্রসারের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইসলাম নিয়ে পাশ্চাত্য ষড়যন্ত্র, ইসরায়েল, সাম্রাজ্যবাদ, তেল ও ধর্ম, বিশ্বব্যাপী মুসলিম নিধন, মুসলিম দেশে ইসলাম দমন, বেকারত্ব হতাশা ইত্যাদি। (ড. খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ)</p> <p>ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন তাঁর বই ‘মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত’-এ লিখেছেন, ‘পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্র, ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলকে মদদদান এবং তেলসহ প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের হীন-অভিপ্রায় জঙ্গিবাদ সম্প্রসারণের জন্য দায়ী।’</p> <p>ইসলাম বনাম জঙ্গিবাদ</p> <p>১১/১-এর পর থেকে বিশ্বের শক্তিশালী প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে জঘন্য কুৎসা উদিগরণ করা হচ্ছে, কখনো সরাসরি, কখনো ইঙ্গিতে। এরা ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম বলে অপপ্রচার করতে থাকে এবং এর সুবিধা ভোগ করে আসছে অদ্যাবধি। অথচ এ ঘটনার রহস্য এখনো ঘোলাটে অবস্থায় রয়েছে। বর্তমানে পশ্চিমারা জিহাদ ও ইসলামী পুনর্জাগরণকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে দেখছে। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই আমরা বুঝতে পারব, দুয়ের মাঝে ফারাক অনেক বিশাল। লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের দিক থেকে উভয়ে যেমন ভিন্ন, ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া বিবেচনায়ও দুটি ভিন্ন। তেমনি কার্যপন্থার দিক দিয়ে উভয়ের দূরত্ব যোজন যোজন। সাম্রাজ্যবাদ ও জঙ্গিবাদের লক্ষ্য পার্থিব ক্ষমতা দখল ও ভোগ, স্বজাতির আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, ভিন্ন জাতিকে দাস বানানো, পণ্যের বাজার সৃষ্টি করা ইত্যাদি। এসব লক্ষ্যকে কখনো মহৎ বলা যায় না। পক্ষান্তরে ইসলামী জিহাদের উদ্দেশ্য মানবতার মুক্তি, জুলুমের অবসান, সাম্য প্রতিষ্ঠা, ইনসাফ তথা ন্যায়বিচার কায়েম করা প্রভৃতি। সুতরাং এখানে জিহাদের নামে আল্লাহর নামের দোহাই দিয়ে বোমাবাজি, বিদেশি,  ভিন্নধর্মীদের শিরশ্ছেদ, যৌনতা, অপহরণ, আত্মঘাতী হামলা করে জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি এবং পৃথিবীকে অশান্ত করার কোনো সুযোগ নেই। যারা এসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত, তারা মূলত ইসলামকে ব্যবহার করে ইসলামেরই ক্ষতি করছে। আইএস, বোকোহারাম ইত্যাদি জঙ্গি সংগঠনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে ইসলামের সৌন্দর্য এবং বিশ্বব্যাপী ইসলামের অগ্রযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে এগুলো সৃষ্টি করে এবং জিইয়ে রেখে সুবিধা নিচ্ছে সাম্রাজ্যবাদীরা। যুক্তরাষ্ট্র তার রমরমা অস্ত্র ব্যবসা স্থায়ী করছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত জনপদ ও রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের টেন্ডার হাতিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কনস্ট্রাকশন কম্পানিগুলো। ক্ষমতাসীন মুসলিম শাসকদের হত্যা করে তাদের তাঁবেদার সরকার গঠন করে আসছে। তার উত্কৃষ্ট নজির মোয়াম্মার গাদ্দাফি এবং সাদ্দাম হোসেন। জন পার্কিংস করপোরেটক্রেসির আদলে আমেরিকার এসব ছলচাতুরী এবং ষড়যন্ত্রকে ভালোভাবেই তুলে ধরেন তার অনবদ্য সৃষ্টি ‘Confession of an economic hit man’ গ্রন্থে।</p> <p>আসলে ধর্মীয় জঙ্গিবাদ শুরু হয় ইহুদি উগ্রবাদীদের দ্বারা। মানব ইতিহাসে প্রাচীন যুগের প্রথম প্রসিদ্ধ সন্ত্রাসী কর্ম ছিল ইহুদি সিলটদের (Zealots) সন্ত্রাস। (Encyclopedia of Britannica CD Version 2005. Article-on Terrorism).</p> <p>এর নিদর্শন হলো, তারা নিরীহ ফিলিস্তিনিদের নির্মমভাবে হত্যার মাধ্যমে এখনো অব্যাহত রেখেছে। এভাবে অন্য ধর্মের, বিশেষভাবে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ক্রুসেডের নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ইতিহাস আমাদের ভাবিয়ে তোলে। এবং এই রকম সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তারা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে; যাকে বিশ্ব মিডিয়া আড়াল করার চেষ্টা করে এবং বিভিন্ন যুক্তিতে এসবের বৈধতা দানের অপপ্রয়াস চালায়। এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, তাদের ক্রুসেড বর্তমানেও বিদ্যমান রয়েছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডাব্লিউ বুশের কথায় এবং কর্মকাণ্ডে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এম সাখাওয়াত হোসেন প্রশ্ন রেখে বলেন, কে বলে পশ্চিমারা ধর্মান্ধ নয়? (সূত্র : বি. জে. এম. সাখাওয়াত হোসেন, মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত)।</p> <p>লেখক : ইসলামী গবেষক</p>