<p> বরিশাল নগরের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী নৌকায় করে সদর উপজেলার চরকাউয়ায় গিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের বাড়ি ও মন্দিরে আগুন দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানেও এমন কয়েকজনের নাম জানা গেছে, যারা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।</p> <p> যে খুনের ঘটনার জের ধরে সনাতন ধর্মাবলম্বী ওই পরিবারগুলো হামলার শিকার হয়েছে সেই পারভেজের ভাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এমনকি খুনের ঘটনার পর ওই রাতে চরআইচা এলাকায় ছাত্রলীগের একজন নেতাও গিয়েছিলেন। সেখানে হামলার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।</p> <p> তবে ছাত্রলীগের ওই নেতা হামলার সঙ্গে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, পারভেজের ভাই শামীম গাজী ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন।</p> <p> গত শুক্রবার সকালে চরকাউয়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ি ও মন্দিরে হামলা হয়। আগুনে ১৩টি বসতঘর ও দুটি মন্দির পুড়ে গেছে। আগের দিন বৃহস্পতিবার রাতে আগের বিরোধের জের ধরে খুন হন পাশের চরআইচা গ্রামের পারভেজ। এর জের ধরে ওই হামলা হলেও এর পেছনে অন্য কোনো পরিকল্পনা থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।</p> <p> এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি অনুসন্ধান চালাচ্ছে।</p> <p> তদন্ত কমিটির প্রধান আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ঘটনার নির্মমতার বর্ণনা দিলেও কারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করতে চাইছে না ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। তিনি আরো বলেন, 'তদন্তকালে বেশ কিছু তথ্য আমরা পেয়েছি, যা এই মুহূর্তে প্রকাশ করা যাচ্ছে না।'</p> <p> এ ছাড়া কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরের খুঁজছে তদন্ত দল। এর মধ্যে, আগুন দেওয়ার সময় এতো লোক কোথা থেকে কিভাবে এলো। তারা কি চরআইচা গ্রামের না বাইরে থেকে এসেছে। সেটা হলে তারা কারা। তাদের এখানে আনার পেছনে কারা কারা কাজ করেছে।</p> <p> হামলায় অংশ নেয় ছাত্রলীগকর্মীরা : নগরীর সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক (মুসলিম হল) হোস্টেলের অন্তত ৫০ জন শিক্ষার্থী ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারাই নৌপথে শহর থেকে ওই গ্রামের পেছন দিয়ে গিয়ে আগুন দিয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা নিশ্চিত করেছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত রয়েছে- এমন বেশ কয়েকজনের নাম জানা গেছে।</p> <p> হোস্টেলের এক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, শুক্রবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ওই শিক্ষার্থীরা হোস্টেল ছাড়েন। ছাত্রলীগের অনুসারী শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ছিল শাকিল হাওলাদার, কে এম রফিক, জাকারিয়া, জিয়া, সজীব ও আরিফ। তাঁরা সবাই কলেজ শাখা ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত। ছাত্রলীগের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তাঁদের প্রথম সারিতে অংশ নিতে দেখা যায়।</p> <p> চরকাউয়ার সাবেক এক জনপ্রতিনিধি বলেন, বিএম কলেজের শিক্ষার্থীরা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে নগরের চাঁদমারী ঘাট থেকে কীর্তনখোলা নদী পার হয়ে চরকাউয়ার রুনা ইটভাটার পাশের খেয়াঘাটে নামে। তারা ইটভাটার পাশ ধরে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়ির পেছনে অবস্থান নেয়। তখন সকাল সাড়ে ৯টা বাজে। আরো তিন-চারটি নৌকায় করে একই সময় শতাধিক নারী, পুরুষ, কিশোর একইভাবে হিন্দুদের বাড়ির পেছনে অবস্থান নেয়। তারা নিহত পারভেজের আত্মীয়। তাদের বাড়ি সদর উপজেলার কর্ণকাঠি গ্রামে। একপর্যায়ে তারা সংগঠিত হয়ে হিন্দুদের বাড়িতে ভাঙচুর-লুটপাট চালায়। শেষে বাড়িগুলোতে পেট্রল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই শিক্ষার্থীরা দক্ষিণ চরআইচার পালবাড়ি হয়ে নাপিতের হাটখোলা দিয়ে আবার নৌপথে চাঁদমারী খেয়াঘাটে ফেরে।</p> <p> কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষার্থীরা শহরে আসার সময় পালবাড়ি অতিক্রমকালে ওই এলাকার নির্মল চন্দ্র পালকে মারধর করে। পাশাপাশি কৃষ্ণা রানী পালের বাড়িতে ভাঙচুর চালায়।</p> <p> সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, আগুন দেওয়ার সময় শিক্ষার্থীরা অগ্রভাগে থাকলেও তাদের সহযোগিতা করেছেন চরআইচা গ্রামের জাকির গাজী, নাসির গাজী ও মাসুদ হাওলাদার। এ তিনজনই বিএনপি ও যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।</p> <p> নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্ষতিগ্রস্তরা জানায়, নিহত পারভেজ গাজীর ভাই শামীম গাজী মহানগর ছাত্রলীগের প্রস্তাবিত কমিটির সদস্য। শামীম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি জসিম উদ্দীনের সঙ্গে রাজনীতি করেন। তাই শামীমের ভাই নিহত হওয়ার খবর শুনে বৃহস্পতিবার রাতেই জসিম চরআইচা গ্রামে গিয়েছিলেন বলে স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে। তাদের ভাষ্য মতে, রাতে জসিম চরকাউয়া মাতৃ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে স্থানীয়দের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। তাঁর উপস্থিতি টের পেয়ে ওই রাতেই হিন্দু পরিবারের পুরুষ সদস্যরা বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান।</p> <p> ছাত্রলীগ নেতারা যা বললেন : অভিযোগ প্রসঙ্গে শাকিল হাওলাদার কালের কণ্ঠকে বলেন, মুসলিম হলের রাজনীতি দুটি ভাগে বিভক্ত। এক পক্ষে ভোলা, বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ ও হিজলার শিক্ষার্থীরা, অন্য পক্ষে রয়েছে বরিশারের বাকেরগঞ্জ আর পটুয়াখালীর বাউফলের শিক্ষার্থীরা। যাদের হামলার সঙ্গে জড়ানোর হচ্ছে তারা ভোলার অনুসারী। তিনি দাবি করেন, 'প্রতিপক্ষরাই আমাদেরকে ফাঁসাতে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে। ঘটনার দিন আমি কিংবা জাকারিয়া, রফিক, জিয়া বরিশালে ছিলাম না।' তিনি জানান, আগুন দেওয়ার পর আরিফ ও জুবায়ের আলমকে সঙ্গে নিয়ে ছাত্রলীগ নেতা মঈন তুষার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি জসিম উদ্দীন বলেন, 'শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পারভেজের লাশ দেখতে গিয়েছিলাম। কারণ মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষপর্যায়ের নেতারা সেখানে যাওয়ার জন্য বলেছিলেন।' তিনি দাবি করেন, শামীম গাজী ছাত্রলীগের কেউ নন। এমনকি ঘটনার সঙ্গে বিএম কলেজের শিক্ষার্থীদের জড়িত থাকার বিষয়টি তিনি অবগত নন। যারাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেন ছাত্রলীগের এ নেতা।</p> <p> সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চরকাউয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম ছবি বলেন, আগুন দেওয়ার ঘটনাটি ঘটিয়েছে হাতে গোনা ২৫-৩০ জন লোক। ওই লোকগুলো কারো পরিচিত নয়।</p> <p> সাক্ষ্য দিতে আসেননি ইউপি সদস্য : গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আবুল কালাম আজাদ ও জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফখরুল আহমেদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে ইউনিয়ন পরিষদে উপস্থিত থেকে সাক্ষ্যপ্রদান ও তদন্ত কমিটিকে সহযোগিতা করার জন্য পশ্চিম চরআইচা ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রিয়াজুল ইসলাম সবুজকে উপস্থিত থাকার জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি গতকাল তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হননি। এর আগে তাঁর বরিশাল নগরের ভাড়া বাসায় পুলিশ অভিযান চালিয়েছিল।</p> <p> তদন্ত কমিটির প্রধান আবুল কালাম আজাদ কালের কণ্ঠকে বলেন, গুজবের ইন্ধনদাতা এবং বাড়িতে এসে আগুন দেওয়ার সময় কারা সামনের দিকে ছিল তাদের চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।</p> <p>  </p> <p>  </p> <p>  </p>